খুলনা | রবিবার | ১০ নভেম্বর ২০২৪ | ২৬ কার্তিক ১৪৩১

শত্রুর জন্য করণীয়

ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন |
০১:০৬ এ.এম | ২০ এপ্রিল ২০২৪


বদরের যুদ্ধ! ইসলামের শত্রুদের সাথে মুসলমানদের প্রথম যুদ্ধ। যে শত্রুরা রসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর মাতৃভূমি মক্কা হতে বিতাড়িত করেছিল। মহান আল্লাহ তা’য়ালা তাদের বিপক্ষে মুসলমানদের বিজয় দান করলেন। এ যুদ্ধে শত্রুদের অনেকে প্রাণ হারাল আবার অনেকে মুসলমানদের হাতে বন্দি হল। যেহেতু কোন জেলখানাও ছিল না আবার কোন সুরক্ষিত জায়গাও ছিলনা যেখানে যুদ্ধ বন্দিদের রাখা যায়। তাই বন্দিদেরকে মসজিদে নববীর খুঁটির সাথে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছিল। সারারাত তারা এ অবস্থাতেই ছিল। ফজরের নামাজের পর নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখলেন তাদের শক্ত করে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের বললেন আরে তোমরা তোমাদের ভাইদের শক্ত করে বেঁধে রেখেছো, সারারাত তারা নড়াচড়া করতে পারেনি আবার ঘুমাতেও পারেনি, তাড়াতাড়ি বাঁধন ঢিলা করে দাও। নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানে বন্দিদেরকে শত্র“ বলে আখ্যায়িত করতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করলেন না তিনি বললেন ‘তোমাদের ভাইদের’।
ক্ষতিকর যে কোন বস্তু বা ব্যক্তিকেই শত্রু বলা হয়। অর্থাৎ যে কেউ যে কোন ভাবে আমার ক্ষতি পৌঁছুতে পারে সেই আমার শত্রু। সহজ ভাষায় প্রতিপক্ষ কিংবা প্রতিদ্ব›দ্বী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে শত্রু মনে করা হয়। যেমন যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষ আমার শত্রু কারণ তারা যে কোন সময় আমার জীবনটা শেষ করে দিতে পারে।
মহান আল্লাহ তা’য়ালা রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এতটাই দয়ালু করে দুনিয়াতে পঠিয়েছিলেন যে, তিনি শুধু বন্ধুরই কল্যাণকামী ছিলেন না শত্রুরও কল্যাণকামী ছিলেন।
ইসলামের প্রাথমিক যুগের কথা। নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল­াম যখন দাওয়াতের কাজ শুরু করলেন তখন আরবে দু’টি ভাগ হলো, এক-দারুল আরকাম, দুই-দারুল নদওয়া। দারুল আরকামের সদস্য হলো ঐ সমস্ত নিপীড়িত মানুষেরা যারা নতুন ইসলাম গ্রহণ করেছেন যাদের প্রধান হলেন নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আর দারুল নদওয়ার সদস্য হলো কাফের মুশরিকরা যাদের প্রধান হলো আবু জেহেল, আবু লাহাব, উতবা, সাইবা অনেকে। দারুল নদওয়ার সদস্যরা সব সময় এই চিন্তা আর গবেষণায় লিপ্ত যে দারুল আরকামের সদস্যদের কিভাবে ক্ষতি করা যায়, ধ্বংস করা যায়, হত্যা করা য়ায়, পৃথিবী হতে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায়। অন্যদিকে দারুল আরকামের দুর্বল লোক গুলি সারাদিন পরামর্শ করে, যে লোকগুলি আমাদের সহ্য করতে পারেনা, আমাদের অস্তিত্বকে বরদাস্ত করতে পারেনা, পৃথিবীর বুক হতে আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় তারা কিভাবে হেদায়েত পেয়ে যায়, কিভাবে অনন্তকালের জাহান্নামের আগুন হতে বেঁচে যায়, আর সারা  রাত তাদের হেদায়েতের জন্য দোওয়া কান্নাকাটি করেন।
সে সময় কাফেরদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের উপর যে পরিমাণ অত্যাচার করা হয়েছে তা অবর্ণনীয়। ইতিহাসের পাতা তা দিয়ে পরিপূর্ণ। মুসলমানেরা মক্কা শরিফ থেকে মদিনা শরিফে হিজরত করতে বাধ্য হলেন। নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বারবার মক্কার দিকে তাকাচ্ছেন আর অশ্র“সিক্ত নয়নে বলছেন হে মক্কা তুমি আমার কাছে ছিলে পৃথিবীর মধ্য সবচেয়ে প্রিয় ভূমি, যদি তোমার অধিবাসিরা আমাকে বের করে না দিত।
মদিনাতে হিজরত করার পরও কাফেররা সব রকমের নির্যাতন ও যুদ্ধ লিপ্ত ছিল। ধীরে ধীরে আল্লাহ নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শক্তি ও বিজয় দান করলেন। এই সেই মক্কা; যেখানে তার অধিবাসীগণ মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে থাকতে দেয়নি। আজ আট বছর পর তিনি সেখানে ফিরে আসছেন। আসছেন বিজয়ীরূপে। বিজয়ী নবী আজ জন্মভূমি মক্কায় প্রবেশ করছেন, যে শহরের অধিবাসীগণ একদিন তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। একদিন এই শহরের অধিবাসীগণ তাঁর চলার পথে কাঁটা পুঁতে রাখতো, তাঁর পবিত্র শরীরে ময়লা-আবর্জনা ফেলার চেষ্টা করতো, তাঁর গায়ে পাথর ছুঁড়ে মারতো, আজ সেখান তিনি প্রবেশ করছেন বিজয়ীরূপে। যদি তিনি না হয়ে অন্য কেউ হত তাহলে প্রবেশ করত বুক টান করে, গর্দান উঁচু করে, এবং এই শ্লোগান দিতে দিতে- সর্বময় কর্তৃত্ব আজ আমার, আর কারও নয়। কিন্তু না, সেই দর্পিত ভঙ্গি আজ প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেই। তিনি প্রবেশ করলেন বিনয়ী ভঙ্গিতে।
পন্ডিত সুন্দর লাল লিখেছেন হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয়ের সময় যে কাজ করেছেন তার সে অবদানের কথা পৃথিবীর ইতিহাস কখনও ভুলতে পারবে না,  যারা তাঁকে কষ্ট দিয়েছে, অবিরাম অবিচার করেছে, তাঁকে লাঞ্চিত করেছে তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। পৃথিবীর সেনা কর্মকান্ডের ইতিহাসে এ এক বিস্ময়কর উপমা। (ঈমান জাগানিয়া সাক্ষাৎকার, ৪ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৫০)
এজন্য স্মরণ রাখতে হবে ঘৃণা, রাগ এবং বিদ্বেষ শত্রুর সঙ্গে নয় বরং তার ভেতরকার শত্রুতার সঙ্গে। কাফেরের সঙ্গে নয় বরং তার ভেতরকার কুফরের সঙ্গে। পাপীর সঙ্গে নয় বরং তার ভেতরকার পাপের সঙ্গে। আমরা সাধারণতঃ শত্রুকে ক্ষমা করতে চাই না। সুযোগ পেলে এক হাত দেখে নেয়ার চেষ্টা করি। সবসময় প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকি। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি।
শত্রুকে বন্ধু বানাতে হলে শত্রুর দোষ-ত্র“টি খোঁজা থেকে বিরত থাকা। শত্রুর দোষ অন্বেষণ করার মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও আরো দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। পরস্পরের প্রতি ক্রোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। একে অপরের প্রতি দুর্নাম রটানোর ফলে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। শত্রুতা হ্রাস করতে হলে প্রতিপক্ষ সম্পর্কে মন্দ কথা প্রচার থেকে বিরত থাকা। কারণ পরস্পরের মন্দ কথা প্রচারের মাধ্যমে শত্রুতার ভিত্তি মজবুত হয়। তৃতীয় একটি পক্ষ এসে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করে। তখন পরস্পরের শত্রুতার ডাল-পালা বৃদ্ধি পেতে থাকে। শত্রুতা ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে।
এজন্য আমাদের প্রতিশোধ নেয়ার মনোভাব পরিহার করে বন্ধু-শত্রু সকলের খয়েরখাঁ হতে হবে। তাহলে সমাজে দ্ব›দ্ব সংঘাত হানাহানি দূর হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের তৌফিক দান করুন, আমিন। 
সংকলক : লেখক ও গবেষক।

্রিন্ট

আরও সংবদ