খুলনা | শনিবার | ১২ অক্টোবর ২০২৪ | ২৭ আশ্বিন ১৪৩১

বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা হ্রাসে বৃক্ষের ভূমিকা

মোঃ আবদুর রহমান |
০১:১০ এ.এম | ২৮ এপ্রিল ২০২৪


বৃক্ষ প্রকৃতির এক অমূল্য সম্পদ। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বৃক্ষ মানুষের নিত্য সঙ্গী। এদের ছাড়া মানব জীবন অচল। যুগযুগ ধরে এরা নীরবে মানবতার সেবা করে আসছে। বৃক্ষরাজি আছে বলে মানুষ বেঁচে আছে। দৈনন্দিন জীবনে বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। বৃক্ষ আমাদের খাদ্য, পরিধেয় বস্ত্র, বাসস্থান, আসবাপত্র, যানবহন, কৃষি যন্ত্রপাতি, ওষুধ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ছায়া, ফুল-ফল, কাঠ ও জ্বালানির যোগান দেয়। কাঠ ও ছায়াদান ছাড়াও সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর ফল পেতে ফল গাছের জুড়ি নেই। অন্যান্য জীবজন্তু বিশেষ করে পশুপাখিও আশ্রয়স্থল হচ্ছে বন ও গাছপালা।
গাছ আমাদের জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন সরবরাহ এবং ক্ষতিকারক কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে পরিবেশকে নির্মল রাখতে সাহায্য করে থাকে। এক হেক্টর সবুজ বনভূমির অর্থ প্রত্যেহ ৬০০ থেকে ৬৫০ কেজি অক্সিজেন এবং তৎসহ ৯০০ কেজি পরিমাণ মানুষের ক্ষতিকারক কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বিলোপ। তাই বৃক্ষকে বলা হয় অক্সিজেনের জীবন্ত আঁধার। সবচেয়ে বড় কথা, প্রচুর বৃক্ষরাজি না থাকলে মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তু অক্সিজেনের অভাবে বেঁচে থাকতে পারতো না। গাছপালা বায়ু মন্ডলকে পরিশোধিত রাখে বলেই মানুষ, জীবজন্তু ও পশুপাখি বেঁচে আছে।
গাছপালার দ্বারা একটি দেশের আবহাওয়া নিয়ন্ত্রিত হয়। রাস্তা, ঘর-বাড়ি ও ভূমি ক্ষয় রোধ হয়। নদী-নালার পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হয়। বৃষ্টিপাতের সহায়তা করতেও গাছ অপরিহার্য। স্পঞ্জ যে ভাবে পানি ধরে রাখে গাছও  সে ভাবে মাটির ভিতরের পানিকে ধরে রাখতে সাহায্য করে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেও বৃক্ষের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীদের মতে, তাপদগ্ধ গ্রীষ্মের দিনে একটি বড় গাছ প্রস্বেদন (Transpiration) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রায় ১০০ গ্যালন পানি চারদিকের বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। ফলে তার আশপাশের তাপমাত্রা কমে গিয়ে পরিবেশ শীতল হয়। আর এই শীতলতার পরিমাণ ঘরের মধ্যে বেশ’কটি এয়ারকন্ডিশনের শীতলকরণের সমান। 
গাছপালা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে এবং বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে ভূমি ও বায়ুমন্ডলের আর্দ্রতা বাড়ায়। ঝড়, তুফান, বন্যা-খরা ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ¡াসের তান্ডব হতে দেশের লোকজন, পশুপাখি ও ঘরবাড়ি রক্ষা করতে বৃক্ষরাজির অবদান সর্বজন স্বীকৃত। রাস্তা, বাড়ি, স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। এক কথায় খাদ্য, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, নির্মল পরিবেশ তথা দেশকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে তুলতে গাছ-পালার অবদান অপরিসীম। 
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, কোন দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য তার মোট ভূখন্ডের অন্তত: শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে মোট বনভূমির পরিমাণ শতকরা ১৮ ভাগ মাত্র। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাতে  ব্যাপকহারে গাছপালা কাটা হচ্ছে। কিন্তু সে হারে বৃক্ষরোপণ ও তার রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না। ফলে গাছপালার ঘাটতির কারণে একদিকে যেমন আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় গাছপালাজাত দ্রব্যের অভাব ঘটছে, অপরদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। দেশে বন্যা, খরা, উপকূলীয় অঞ্চলে সিডর, আইলা, মহাসেন, ফণি, বুলবুল, আম্ফান ও ইয়াসের মতো মারাত্মক সামুদ্রিক জলোচ্ছ¡াস, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা, আবহাওয়ার উষ্ণতা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস, ভূমিক্ষয়, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, উত্তরাঞ্চলে মরু বিস্তারের আশঙ্কা ইত্যাদি বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। এছাড়া বৈশ্বিক জলবায়ু প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের তাপমাত্রা প্রাক শিল্পায়ন যুগ থেকে বর্তমানে ১.১৫ ডিগ্রি সেলিসিয়াস বেড়ে গেছে। কার্বনসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস বায়ুমন্ডলকে এতটাই উত্তপ্ত করেছে যে, বিজ্ঞানীরা আগামী কয়েক দশকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন। এ পরিস্থিতির মোকাবেলায় সত্যিকারের দেশপ্রেমের মনোভাব নিয়ে প্রতিটি নাগরিকের অধিক বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণের দায়িত্বভার হাতে নিতে হবে। আশার কথা, বৃক্ষ সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি ও নির্মল পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষে প্রতি বছর দেশে জাতীয়ভাবে বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণের কর্মসূচি নেওয়া হয়। কাজেই নিজের প্রয়োজন, জাতীয় স্বার্থে ও দেশের কল্যাণে এবং আমাদের অস্তিত্ব রক্ষায় সকলকেই বেশি করে বৃক্ষরোপণ ও তা সংরক্ষণের কাজে ব্রতী হতে হবে।
সারা বছরই বৃক্ষরোপণ করা যায়। তবে বর্ষাকাল বৃক্ষের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। আপনার নিজের সম্পদ এবং জাতীয় সম্পদ বাড়ানোর জন্য বসতবাড়ির আশেপাশের পতিত জায়গায়, পুকুর পাড়ে, রাস্তার পাশে, খাল বা নদীর ধারে, রেল লাইন ও বাঁধের পাশে, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, অফিস-আদালত, কল-কারখানা, ঈদগাহ, গোরস্থান, শ্মশান ও মন্দিরের খালি জায়গায় ব্যাপক হারে গাছ লাগানো উচিত। আসবাবপত্র ও গৃহ নির্মাণের জন্য সেগুন, মেহগনি, শিলকড়ই, গজারী, জারুল এবং জ্বালানি কাঠের জন্য কড়ই, ইপিল-ইপিল, রেইন্ট্রি তেঁতুল, বাবলা ইত্যাদি এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টি সমৃদ্ধ ফল যেমনÑ আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, সফেদা, জামরুল, আমড়া, বেল, লেবু, কামরাঙা, নারিকেল ইত্যাদির উন্নত চারা/কলম সংগ্রহ করে লাগাতে হবে। এছাড়া নানা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য নিম, অর্জুন, হরিতকি, বাসক, আমলকি, তুলসি, বহেরা, মহুয়া এসব ঔষধি গুণ সম্পন্ন বৃক্ষের চারা রোপণ করা উচিত।
বৃক্ষের চারা রোপণের নিয়মাবলী ঃ বৃক্ষের চারা রোপণের কতিপয় মৌলিক নিয়ম-কানুন রয়েছে। এগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ না করলে কাংখিত ফল লাভ করা যায় না। নির্দিষ্ট দূরত্বে বৃক্ষের চারা রোপণ করতে হবে। কেননা, সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ না করলে ছায়ার কারণে গাছের বৃদ্ধি ভাল হয় না। বনজ বৃক্ষের চারা রোপণের উত্তম দূরত্ব হলো ২ ী ২ মিটার বা ২.৫ী২.৫ মিটার। জ্বালানির জন্য যদি ইপিল-ইপিল লাগানো হয় তবে ১ী১ মিটার দূরত্বে লাগানো যেতে পারে। বনজ বৃক্ষের চারা রোপণের জন্য ৪৫ সে.মি. লম্বা, ৪৫ সে.মি. চওড়া ও ৪৫ সে.মি. গভীর করে গর্ত করে গর্তের মাটি ১০-১২ দিন রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। প্রতিটি গর্তের ওপরের স্তরের মাটির সাথে পঁচা গোবর বা আবর্জনা সার ৬ কেজি, ইউরিয়া ১২৫ গ্রাম, টিএসপি ১০০ গ্রাম ও ১২৫ গ্রাম এম,ও,পি সার ভালভাবে মিশিয়ে গর্তটি পুনরায় ভরাট করতে হবে। গর্তের ভরাট মাটি জমির সাধারণ সমতল হতে ৫ সে.মি. (২ ইঞ্চি) পরিমানে উঁচু রাখতে হবে।
সার মিশানো মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করে ১০-১২ দিন পর গর্তের ঠিক মাঝখানে চারা বসিয়ে চারপাশের মাটি হাত দিয়ে হালকাভাবে চেপে বসিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনবোধে গোড়ায় আরও কিছু মাটি দিয়ে চেপে বসিয়ে দিতে হবে। যাতে চারার চারপাশের মাটি জমির সমতল থেকে একটু উঁচু ও ঢালু অবস্থায় থাকে। এতে করে চারা গাছের গোড়ায় বর্ষার পানি জমতে পারে না। চারা রোপণের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনক্রমেই গাছের গোড়ায় শিকড়সহ মাটির বলটি ভেঙে না যায়। পলিথিন ব্যাগ বা টবে চারা/কলম সংরক্ষিত থাকলে ব্যাগ বা টব সাবধানে খুলতে হবে। চারার গোড়ায় যে পর্যন্ত মাটি থাকে লাগানোর সময় ঠিক ততটুকু গর্তে পুঁতে দিতে হয়। চারা রোপণের পর বর্ষা না হলে গোড়ায় পানি সেচ দিয়ে গর্তের মাটি ভাল করে ভিজিয়ে দিতে হবে।
ঝড়ে বা বাতাসে চারা হেলে বা পড়ে না যায় সেজন্য গোড়া থেকে ১০-১৫ সে.মি. দূরে একটি শক্ত খুঁটি পুঁতে তার সাথে চারা বেঁধে দিতে হয়। গরু ছাগলের উপদ্রব থেকে রক্ষার জন্য চারা গাছের চারদিক মজবুত ঘের-বেড়া দিতে হবে। ঘের-বেড়া দেয়ার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন চারা আলো-বাতাস পায় এবং ডালপালা ছড়িয়ে পড়ার জন্য উপযুক্ত ফাঁকা স্থান থাকে। সাধারণত বাঁশ দিয়ে বেড়া নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি চারার জন্য ২৫০ সে.মি. উঁচু খাঁচি দ্বারা বেড়া দেয়া যেতে পারে। চারা ঠিক মাঝখানে রেখে খাঁচি বসিয়ে খাঁচির দু’পার্শ্বে ২টি খুঁটি পুঁতে শক্ত করে বেঁধে দিতে হবে।
পরিশেষে বলা প্রয়োজন যে, বৃক্ষরোপণ করার ন্যায় রোপিত চারার যতœ ও সংরক্ষণ করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। রোপিত চারার সুষ্ঠু পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আমাদের দেশে প্রতি বছর অনেক চারা নষ্ট হয়ে যায়। তাই রোপিত বৃক্ষের চারা যতœ, পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে চারা গাছকে বড় গাছে পরিণত করতে হবে।
লেখক : উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা (অবঃ) উপজেলা কৃষি অফিস রূপসা, খুলনা। মোবাইলঃ ০১৯২৩৫৮৭২৫৬
ইমেইল: [email protected]

্রিন্ট

আরও সংবদ