খুলনা | বুধবার | ২৩ অক্টোবর ২০২৪ | ৭ কার্তিক ১৪৩১

এক মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের করণীয়

ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন |
০১:৫৪ এ.এম | ১০ মে ২০২৪


ইসলাম মানবতার মুক্তি ও কল্যাণের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত একমাত্র জীবনাদর্শ যেখানে রয়েছে অধিকার ও কর্তব্যের সুন্দর সমন্বয়। সবাইকে দেয়া হয়েছে তার প্রাপ্য অধিকার। ইসলাম যেসব হক বা অধিকার দিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো, এক মুসলমান ভাই এর উপর অন্য মুসলমান ভাইয়ের হক। রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক মুসলমানের প্রতি অন্য মুসলমানের সুনির্দিষ্ট ছয়টি হকের কথা বলেছেন, ১) যখন সাক্ষাৎ হয় তখন তাকে সালাম করবে, ২) যখন দাওয়াত দেয় তখন দাওয়াত কবুল করবে, ৩) যখন তার হাঁচি আসে (এবং আলহামদুলিল্লাহ বলে) তখন তার জওয়াবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলবে ৪) যখন অসুস্থ হয় তখন তাকে দেখতে যাবে, ৫) যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তার জানাযার সাথে যাবে এবং ৬) তার জন্য তাই পছন্দ করবে যা নিজের জন্য পছন্দ করে। (ইবনে মাজাহ)। 
এই হাদীসে মুসলমানের প্রথম হক হচ্ছে, যখন সাক্ষাৎ হয় তখন তাকে সালাম করবে।
নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরতে সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম যখন রাস্তায় চলতেন, তখন নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে যার সঙ্গেই তাঁর দেখা হতো, তাকে তাঁরা সালাম দিতেন। আমাদেরকেও রাসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও হযরতে সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুমদের অনুসরণে মুসলিম নারী-পুরুষ শিশু-বৃদ্ধ সকলকে সালাম প্রদান করতে হবে। এতে সকলের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে ও পারস্পরিক হৃদ্যতা বৃদ্ধি পাবে।
দ্বিতীয় হক হচ্ছে, দাওয়াত কবুল কর । মানুষের জীবনে এমন কিছু সময় আছে, যেগুলোতে মানুষের আনন্দ-উচ্ছ¡াস স্পন্দিত হয়। যেমন বিয়ে-শাদি, সন্তান লাভ ও কর্মে সফলতা ইত্যাদি। তখন আনন্দিত ব্যক্তি অন্যান্যদেরকেও এতে সম্পৃক্ত করতে চায়। তাই ওলিমা ইত্যাদির মাধ্যমে অন্যদের আমন্ত্রণ জানায় এবং আনন্দিত মেহমানদের শুভাগমনে সেই ব্যক্তি খুবই খুশি হয়। সুতরাং, এহেন কাজে অংশগ্রহণ করে মুসলমানকে খুশি করা তার হক। এমন যেন না হয় গরীব সম্ভ্রান্ত নয়, আয়োজন ভালো নয় অতএব দাওয়াত কবুল করা যাবে না। মুসলমানের অন্তর খুশি করার নিমিত্তে দাওয়াত কবুল করা চায়। কেননা রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বকরির পায়ার জন্যও যদি আমি নিমন্ত্রিত হই, কবুল করে নেব।’ (সহীহ বুখারী, সুনানে তিরমিযী) হ্যাঁ, যদি উক্ত অনুষ্ঠানে শরিয়ত পরিপন্থী কোন কাজ হয় এবং আমন্ত্রিত ব্যক্তি তা প্রতিহত করার ক্ষমতা না রাখে তাহলে সে অনুষ্ঠানে না আসাই ভাল। (ইসলাম আওর হামারী জিন্দেগী)
তৃতীয় হক হচ্ছে, যখন তার হাঁচি আসে (এবং আলহামদুলিল­াহ বলে) তখন তার জওয়াবে ইয়ারহামুকাল­াহ বলবে।
এক হাদীসে আছে, ‘হাই শয়তান হতে আসে আর হাঁচি আসে আল­াহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে’ (বুখারী, তিরমিযী)
চতুর্থ হক হচ্ছে, যখন অসুস্থ হয় তখন তাকে দেখতে যাবে।
আবদুল্লাহ ইবনে নাফে’ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, হযরত আবু মূসা রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত হাসান ইবনে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে অসুস্থাবস্থায় দেখতে আসলেন। হযরত আলী রাযিয়াল­াহু আনহু বললেন, যে কোন মুসলমান কোন অসুস্থকে দেখতে যায়, যদি সে সকালে যায় তবে তার সাথে সত্তর হাজার ফেরেশতা যান এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য ইস্তেগফার (অর্থাৎ গুনাহমাফির দোয়া) করতে থাকেন। আর সে (এই রুগী দেখার বিনিময়ে জান্নাতে একটি বাগান লাভ করবে। আর যদি সন্ধ্যায় রুগী দেখতে যায় তবে তার সাথে সত্তর হাজার ফেরেশতা যান এবং তারা সকলে তার জন্য ইস্তেগফার করতে থাকেন, আর সে এর বিনিময়ে জান্নাতে একটি বাগান লাভ করবে। (হায়াতুস সাহাবাহ)
পঞ্চম হক হচ্ছে, যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তার জানাযার সাথে যাবে।
‘রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানাযার পেছনে চলার অনেক ফযীলত বর্ণনা করেছেন। এক হাদীসে তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নামায আদায় হওয়া পর্যন্ত জানাযার সঙ্গে থাকবে, সে ‘এক কীরাত সওয়াব পাবে। যে ব্যক্তি লাশ দাফন পর্যন্ত উপস্থিত থাকবে, সে ‘দুই কীরাত’ সওয়াব পাবে। এক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! দুই কীরাত পরিমাণটা কি? রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বললেন, দুই কিরাত বড় দু’টি পাহাড়ের সমান।’ (বুখারী, মুসলিম)। মোটকথা জানাযার নামায পড়া ও দাফন পর্যন্ত শরীক থাকা অনেক বড় সওয়াবের কাজ।
ষষ্ঠ হক হচ্ছে, তার জন্য তাই পছন্দ করবে যা নিজের জন্য পছন্দ করে।
মুসলমানরা পরস্পরের মান-ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধান, দুঃখ-কষ্টে অংশগ্রহণ, গঠনমূলক সমালোচনা, উপদেশ-নছীহত, একত্রে বসবাস সহ সার্বিক বিষয়ে পরস্পরের সহযোগি হবে। নো’মান বিন বাশীর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সকল মুমিন এক ব্যক্তির মত। যদি তার চক্ষু অসুস্থ হয়, তখন তার সর্বাঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর যদি তার মাথায় ব্যথা হয়, তখন তার সমস্ত দেহই ব্যথিত হয়’। (মুসলিম)
ইমাম গাযযালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর কিমিয়ায়ে সা’দাতে সাধারণ মুসলমানদের প্রতি পনেরটি কর্তব্যের কথা লিখেছেন নিম্নে তা বর্ণনা করা হলো : ১) নিজের নিকট যা অপছন্দনীয় তা অপর মুসলমানের জন্যও পছন্দ না করা। ২) হাত ও রসনা দিয়ে অপর মুসলমানকে কষ্ট না দেওয়া। ৩) কারো সাথে অহংকার না করা। ৪) কোন মুসলমান সম্বন্ধে পরোক্ষ নিন্দুকের কথায় কর্ণপাত না করা। ৫) তিনদিনের বেশী কোন প্রিয়জনের সাথে কথাবার্তা বন্ধ না রাখা। ৬)  বয়োজ্যেষ্ঠগণকে সম্মান ও কণিষ্ঠগণকে স্নেহ করা। ৮) সকল মুসলমানের সাথে খুশির সাথে সাক্ষাৎ করা এবং তাদের সাথে প্রফুল­ থাকা। ৯) কোন মুসলমানের সাথে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ না। ১০) প্রত্যেককে তার পদমর্যাদা অনুযায়ী সম্মান করা। ১১) মুসলমানদের মধ্যে পরস্পর বিবাদ-মিমাংসা করে দেওয়ার চেষ্টা করা। ১২) মুসলমানের সকল ত্র“টি ও গোপনীয় দোষ গোপন রাখা। ১৩) মিথ্যা অপবাদের স্থান হতে দূরে থাকা। ১৫) কোন মুসলমান অনুপস্থিতিতে কেউ তাকে গালি দিতে আরম্ভ করলে এবং তার ধন-সম্পত্তি কিংবা মান-সম্ভ্রম নষ্ট করতে উদ্যত হলে তার স্থলবর্তী হয়ে তার পক্ষ হতে প্রতি উত্তর প্রদান করা ও তাকে অত্যাচার-উৎপীড়ন হতে রক্ষা করা।
মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে এক মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের যেসব হক রয়েছে, তা যথার্থরূপে আদায় করা তাওফিক দান করুন, আমিন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। 
সংকলক : লেখক ও গবেষক।

্রিন্ট

আরও সংবদ