খুলনা | বুধবার | ১৫ জানুয়ারী ২০২৫ | ২ মাঘ ১৪৩১

দেশের গন্ডি পেরিয়ে বাড়ছে বিদেশী রোগীর সংখ্যা

টেস্ট টিউব চিকিৎসার স্বপ্ন ছুঁয়েছে বাংলাদেশ

পারভেজ মোহাম্মদ |
০১:৩৫ এ.এম | ০৮ জুন ২০২৪


দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর, বছর গড়িয়ে যুগ। শুধু একটি কান্নার আওয়াজের অপেক্ষায় দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিচ্ছে দু’টি প্রাণ। হতাশা আর সামাজিক চাপে ফিকে হয়ে গেছে ফুলেল ভালোবাসা। একটি সন্তানের স্বপ্ন যেন অধরায় রয়ে গেল। যুগ পেরিয়ে ফিঁকে হওয়ার ভালোবাসার জুটি বাঁধার দিনটি ঠেকেছে ২১ বছরে। অবশেষে সেই মহেন্দ্রক্ষণ। একটি কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো শীততপ নিয়ন্ত্রিত শক্ত কাঁচের আবরণ ভেদ করে। ততক্ষণে চোখের কোনে তীব্র নোনা জল জমাট বেঁধেছে অসীত-নন্দিতা দম্পতির চোখের কোনে। নাড়ি ছেড়া ধন বুকে নিয়েই অঝরে নোনা জলের বাঁধ ভেঙেছে আনন্দাশ্র“ হয়ে। নিঃসন্তান এমন অনেক দম্পতির মুখে হাসি ফোঁটানোর মহান ব্রত নিয়ে দেশেই আন্তর্জাতিক মানের সেবা নিয়ে প্রস্তুত বাংলাদেশ ফার্টিলিটি হাসপাতাল লিঃ। দেশের সুনাম ও স্বল্প ব্যয়ে ঢাকার রামপুরায় (বনশ্রী) অবস্থিত এ বেসরকারি হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন কপিলমুনির কৃতি সন্তান দেশ বরেণ্য ব্যক্তি ডাঃ এস এম খালিদুজ্জামান। 
আইভিএফ, আইসিএসআই, আইইউ, মেয়েদের বন্ধ্যাত্ব যাচাই, পুরুষের বন্ধাত্ব যাচাই, শুক্রাণু সংরক্ষণসহ নানা সেবা প্রদান করে বাংলাদেশ ফার্টিলিটি হাসপাতাল লিঃ। দেশের অধিকাংশ বন্ধ্যা দম্পতি সঠিক সমাধান না পেয়ে চিকিৎসা করাতে চলে যায় বিদেশে। ব্যয় করেন বিশাল অর্থ। এতে করে নষ্ট হচ্ছে দেশের অর্থ ও সুনাম। কেউ কেউ সফল হলেও ব্যর্থতার সংখ্যাও কম না। আবার কোন কোন দম্পতি অর্থের অভাবে চিকিৎসা না পেয়ে রয়ে যান নিঃসন্তান বাবা-মা হিসেবে। কিন্তু অনেকেই জানেন না দেশেই সম্ভব বন্ধ্যাত্বের সর্বাধুনিক চিকিৎসা। বাংলাদেশ ফার্টিলিটি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বন্ধ্যাত্বের কারণ নির্ণয় করে ওষুধ ও সার্জারির পাশাপাশি সর্বাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি আইভিএফ বা আইইউআই-এর মাধ্যমে মায়েদের গর্ভ ধারনের সুযোগ করে দিয়ে থাকেন। ২০২২ সালের মার্চ মাসে হাসপাতালটি কার্যক্রম শুরু হয়। ইতোমধ্যে ডোনার বিহিন আইভিএফ পদ্ধতিতে বাংলাদেশ তথা এশিয়া মহা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং বহির্বিশ্বে রোগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। 
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ডাঃ এস এম খালিদুজ্জামান জানান, কুয়েত, সৌদি আরব, বাহারাইন, মালেশিয়া, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, ইউকে, ফ্রান্স, জার্মানিসহ ১৫ টির মত দেশ থেকে রোগীরা চিকিৎসা নিয়েছেন এবং সফলতাও এসেছে। অসাধারণ এক মুহূর্ত। 
কোলে মাত্র ৪ দিনের ফুটফুটে কন্যা সন্তান। আবেগ ভালোবাসায় আপ্লুত মিতু-বোরহান দম্পতি। এ প্রাপ্তি তাদের মহান ধরা দেয়নি। পাড়ি দিতে হয়েছে লড়াই সংগ্রামের দীর্ঘ পথ। 
মিতু বলেন, এটা ভাষায় বলা যাবে না। এটা আল­াহ পাকের দেয়া রহমত। আল­াহ পাক আমাকে যা দিয়েছে, আমি অনেক খুশি। বোরহান বলেন, বইলা বোঝাইতে পারবো না। আমরা কতটা হ্যাপি। 
ইতোপূর্বে প্রসবের চার দিন পর মারা যায় অধরা আক্তার মিতুর গর্ভের সন্তান, এরই মাঝে ধরা পড়ে ফলুরিযান টিউব ব্লক। এতে সন্তান ধারনের ক্ষমতা হারান তিনি। এরপর দেশ-বিদেশে অনেক অর্থ খরচ করেও কোন সুফল মেলেনি। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন মিতু। সন্তানের আশা ছেড়ে দিয়ে ছিলেন তারা। এই মধ্যে একটা ইউটিউবে ভিডিও দেখে সন্ধান মেলে এক মানবিক ডাক্তারের। ডাঃ এস এম খালিদুজ্জামান। তার প্রচেষ্টাতে টেস্ট টিউব পদ্ধতির মাধ্যমে স্বপ্ন পূরণ হলো তাদের। 
মিতু বলেন, উনি যে মানব সেবার জন্যই আসছেন এটা আমি প্রথম দিনেই বুঝেছি। প্রথমদিনে মাত্র ২ হাজার টাকা জমা দিয়ে আমি ট্রিটমেন্ট শুরু করি যেখানে ৩ লাখ সাড়ে তিন লাখ টাকা জমা এমাউন্ট। এটা নরমল প্রেগনেন্সির মতই। বোরহান বলেন, টানা চার বছর আমার স্ত্রীর শুধু অঝরে কান্না। আমার বাবু লাগবে। 
বন্ধাত্বের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে অনেক দম্পতি এখন টেস্ট টিউব পদ্ধতিতে সন্তান নিয়ে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশের অনেকের মাঝে এসব নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। সে সব ভুল ও নানা নেতিবাচক ধারণা পাল্টে দিতেই ডাঃ খালিদুজ্জামান প্রতিষ্ঠা করেন ফার্টিলিটি হাসপাতাল। 
ডাঃ খালিদ বলেন, অন্যান্য জায়গায় শুরু হয়েছে টেস্ট টিউব বেবী কিন্তু বাংলাদেশ ফার্টিলিটি হাসপাতালে   আমরা ভিন্ন আঙ্গিকে শুরু করেছি। এখানে আমরা চেষ্টা করেছি গার্মেন্ট ওয়ার্কর, ট্রাক ড্রাইভার থেকে শুরু করে উচ্চ শ্রেণি শিল্পপতি পর্যন্ত এখানে ট্রিটমেন্ট নিয়েছেন। টেস্ট টিউব বেবী কৃত্রিম উপায়ে জন্ম দেওয়া কোন শিশু নয় এটি মূলত একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। যেখানে প্রাকৃতিক  ভাবেই প্রযুক্তির মাধ্যমে বাবার স্পাম ও মায়ের ডিম্বানুর মিলন ঘটানো হয়। তাই ধর্মীয় ভাবেও কোন বাধা নেই বলে জানান এই চিকিৎসক। টেস্ট টিউব বলতে অনেকের মধ্যে ধারনা থাকে যে অন্যের বাচ্চা যা ধর্মীয় ভাবে নিষিদ্ধ। আসলে কিন্তু তা না। এটা হচ্ছে তাদেরই শুক্রাণু কীট ও ডিম্বানুর মিলনের যে পার্টটি টিউবের ভেতর হওয়ার কথা ছিল এই কাজটি বাইপাস করে বাইরে ওই টেমপারেচার এবং নিউট্রিশন মেনটেন করে আমরা একটা পার্ট করে দিচ্ছি এবং পরবর্তীতে ঐ ফিমেল পার্টনারের জরায়ুতেই এটা আমরা প্রতিস্থাপন করি। 
চিকিৎসা পদ্ধতি ও নানা দিক তুলে ধরেন হাসপাতালটির ব্যবস্থাপক পরিচালক ডাঃ রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, আমাদের সফালতার ৫০ থেকে ৬০%। আমরা মূলত স্বল্প খরচে আন্তর্জাতিক মানের সেবা, দেশে এ লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ ফার্টিলিটি হাসপাতাল প্রচালিত করে যাচ্ছি। আমাদের চেয়ারম্যান স্যার দীর্ঘ ১৫ বছর এভারকেয়ার হাসপাতাল পূর্বের এ্যাপোল হাসপাতাল সার্ভিস দিয়েছে। আমি ১২ বছর বাংলাদেশে দিয়েছি প্রথম টেস্ট টিউবে শিশুর জন্ম হয় ২০০১ সালে ২৯ মে ঢাকার একটি ক্লিনিকে। তবে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা সেবা থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ফার্টিলিটি হাসপাতাল দেশেই আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা সেবা প্রদান করে আসছে।   
ইসলামের দৃষ্টিতে এর বৈধতা কতটুকু এমন প্রশ্নের জবাবে ডাঃ এস এম খলিদুজ্জামান বলেন, আলহামদুলিল­াহ, আমরা ইসলামী নিয়ম আনুসরণ করে যথার্থ হালাল উপায়ে এ পদ্ধতি অবলম্বন করি। সাধারণত যৌন মিলনের মাধ্যমে স্বামীর বীর্য স্ত্রীর জরায়ুতে প্রতিষ্ঠা হয়। আর তা থেকেই জন্ম নেয়া সন্তান। এটাই প্রাচীন কাল থেকে সন্তান জন্ম দানের রীতি। আধুনিক কাল থেকে অবশ্য যৌন মিলন ছাড়াও স্বামীর বীর্য স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপনের কৃত্রিম ব্যবস্থা মানুষ আবিষ্কার করেছে। বর্তমান যুগে এ কারনে যৌন মিলন ছাড়াও সন্তান জন্ম নিচ্ছে। কৃত্রিম গর্ভ সঞ্চারের নব আবিস্কৃত এ পদ্ধতির নাম আইভি এফ বা টেস্টটিউব। টেস্টটিউব গর্ভ সঞ্চার করে তা মানব জরায়ুতে স্থাপন করা ইসলাম অবৈধ মনে করে না। তবে সে ক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রীর কাছ থেকেই বীর্য ও ডিম্বানু সংগ্রহ করতে হবে। অন্য কোন পুরুষ বা নারীর কাছ থেকে বীর্য ও ডিম্বানু সংগ্রহ করে তা দ্বারা গর্ভ সঞ্চার করা যাবে না। টেস্টটিউবে সঞ্চারিত ভ্র“ণ অবশ্যই স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করতে হবে। অন্য কোন মহিলার জরায়ুতে তা স্থাপন করা যাবে না। স্বামীর বীর্য ও স্ত্রীর ডিম্বানু নিয়ে টেস্টটিউবে গর্ভ সঞ্চারের বিষয়টি অবশ্যই স্বামীর জীবর্দ্দশায় হতে হবে। স্বামীর মৃত্যুর পর বীর্য ব্যাংকে রক্ষিত তার বীর্য দ্বারা কিছুতেই গর্ভ সঞ্চার করা যাবে না। বাংলাদেশ ফার্টিলিটি হাসপাতাল শতভাগ ইসলামী নিয়ম অনুসরণ করে এ কার্যক্রম করে থাকে।

্রিন্ট

আরও সংবদ