খুলনা | বৃহস্পতিবার | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

মামলা হয়নি, গ্রেফতারও নেই : জানাজায় হাজারো জনতার ঢল : রবিউল হত্যাকাণ্ড জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে : ভূমিমন্ত্রী

তিন বিষয় সামনে রেখে ইউপি চেয়ারম্যান রবি হত্যাকান্ডের তদন্তে পৃথক চার সংস্থা

নিজস্ব প্রতিবেদক ও ডুমুরিয়া প্রতিনিধি |
১২:৪৮ এ.এম | ০৮ জুলাই ২০২৪


জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার শরাফপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আ’লীগের সদস্য শেখ রবিউল ইসলাম রবিকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় রোববার রাতে সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মামলা হয়নি। এ ঘটনায় কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। হত্যার কারণও এখন উদ্ঘাটন করা যায়নি। 
জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক আধিপত্য, ব্যবসায়িক লেনদেন এবং ব্যক্তিগত কোনো দ্ব›েদ্বর কারণে হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। এ তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থা, র‌্যাব, সিআইডি ও পিবিআই পৃথক ভাবে তদন্ত করছে। 
এদিকে চেয়ারম্যান রবিকে হারিয়ে শোকাতুর হয়ে পড়েছে শরফপুরের মানুষ। রবির লাশ দেখতে গ্রামের কয়েকশ’ মানুষ ভিড় করেন। সবার চোখেই ছিল পানি। কান্না জড়িত কন্ঠে অনেককে বলতে শোনা যায়, রবির কোনো শত্র“ ছিল না। কেন হত্যা করা হলো চেয়ারম্যান রবিকে?
অন্যদিকে, হাজারো মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন নিহত শেখ রবিউল ইসলাম রবি। গতকাল রোববার বিকেলে বনিয়াখালি মওলানা ভাসানী মেমোরিয়াল ডিগ্রী কলেজ মাঠে নামাজে জানাজা শেষে উপজেলার ভুলবাড়িয়া গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে নিহতের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। 
ময়না তদন্ত শেষে বিকেল ৪টার দিকে মরদেহ এ্যাম্বুলেন্স যোগে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালে আ’লীগ, বিএনপি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণির হাজার হাজার মানুষ নিহত রবিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে নিহতের বাড়িতে যান ভূমিমন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ এমপি, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গাজী এজাজ আহম্মেদ, জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাইদুর রহমান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ আল-আমীন, এসিল্যান্ড মোঃ আরাফাত হোসেন, ভাইস-চেয়ারম্যান প্রভাষক গোবিন্দ ঘোষ ও শারমীনা পারভীন রুমা, ওসি সুকান্ত সাহা, ইউপি চেয়ারম্যান গাজী হুমায়ুন কবির বুলু, শেখ দিদারুল ইসলাম দিদার, মোঃ রফিকুল ইসলাম হেলাল, সুরঞ্জিত বৈদ্য, গোপাল চন্দ্র দে, শেখ হেলাল উদ্দিন, বিমল কৃষ্ণ সানা, তৌহিদিজ্জামান, জহুরুল হক, তুহিনুল ইসলাম, অধ্যক্ষ সমরেশ মন্ডল, মনোজিৎ বালা, সাবেক ভাইস-চেয়ারম্যান গাজী আব্দুল হালিম প্রমুখ।
এর আগে, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রোববার দুপুরে নিহত রবির মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। লাশ নিতে আসা নিহতের ভাগ্নে সাইফুর রহমান রাজু ও মোস্তাফিজুর রহমান জানান, নিহত রবি ২০১১, ২০১৬ ও ২০২১ সালে শরাফপুর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। শেষ দু’বার নৌকার প্রার্থীর বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে বিজয়ী হন। তিনি এলাকায় অনেক জনপ্রিয় ছিলেন। সর্বশেষ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে শরাফপুর ইউনিয়ন আ’লীগের যুগ্ম-আহবায়ক এএইচএম ওবায়দুল­াহ ও বিএনপি’র বিএম আলমগীর কবীরসহ কয়েকজন তাঁর কাছে পরাজিত হন। তিনি বেঁচে থাকলে অন্য কেউ সহজে চেয়ারম্যান হতে পারবেন না, সে কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে তাদের ধারণা।
মর্গের সামনে ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান গাজী এজাজ আহমেদ বলেন, নিহত রবি সদালাপী ও খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তিনবার নির্বাচনে তাঁকে কেউ হারাতে পারেনি। ইউপি নির্বাচনের প্রতিপক্ষরা তাঁকে হত্যা করতে পারে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ডুমুরিয়ার শরাফপুর ও বানিয়াখালি বাজারের দুই শতাধিক দোকানপাট বন্ধ। এলাকায় টহল দিচ্ছে পুলিশ। এছাড়া শরাফপুরের মওলানা ভাসানী মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজ ও বানিয়াখালি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কোনো ক্লাস হয়নি। নিহত রবি এ দু’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। দুপুর ১২টার দিকে রবির খুনীদের শাস্তির দাবিতে স্থানীয় লোকজন বানিয়াখালি বাজারে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
জেলা পুলিশ সুপার সাঈদুর রহমান বলেন, নিহত রবির সঙ্গে ইউপি নির্বাচন, ব্যবসা ও ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ডুমুরিয়া থানা পুলিশ, ডিবি, র‌্যাব, সিআইডি ও পিবিআই সবাই আলাদা ভাবে ঘটনার তদন্ত করছেন।
এদিকে, ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় নগরীর নিরালা এলাকায় রবির বাসায়। সেখানে নিহতের স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে মরদেহ ডুমুরিয়া উপজেলা আ’লীগ কার্যালয়ে নেয়া হয়। সেখানে দলের নেতা-কর্মীরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। আসরের নামাজের পর মওলানা ভাসানী মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজ মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশ নেন। পরে পারিবারিক কবরস্থানে মরদেহ দাফন করা হয়।
নিহত রবি ডুমুরিয়ার বৃত্তি ভুলবাড়িয়া গ্রামের মৃত শিক্ষক হাবিবার রহমান শেখের ছেলে। তিনবারের চেয়ারম্যান হলেও খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন রবিউল। তাঁর বাড়ি শরফপুর ইউনিয়নের ভুলবাড়িয়া গ্রামে। তবে পরিবার নিয়ে থাকতেন খুলনা নগরের নিরালা আবাসিক এলাকায়। তাঁর স্ত্রী শায়লা ইরিন খুলনায় আঞ্চলিক সমাজসেবা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রভাষক। তাদের বড় ছেলে তালহা জুবায়ের নগরীর নিরালা এলাকার এসওএস স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র এবং ছোট ছেলে ত্বকীর বয়স দুই বছর। রবিউল দুই ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে ষষ্ঠ।
ভূমিমন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ বলেন, চেয়ারম্যান রবিউল ইসলামের হত্যাকাণ্ড জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এক সময়ের আতঙ্কের উপজেলা হিসেবে পরিচিত হলেও গত প্রায় ২২ বছরে এ ধরনের কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। ওই সময় যাঁরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতেন, তাঁরা এখন ছদ্মবেশে এলাকায় আছেন।
খুলনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আসিফ ইকবাল বলেন, যেহেতু কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই, তাই কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে পুরো ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, ছাত্রলীগের হাত ধরে রাজনীতিতে হাতে খড়ি রবির।  তিনি শরফপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। সর্বশেষ ডুমুরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। ৪২ বছর বয়সের মধ্যে পরপর তিনবার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। শেষ দু’বার আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিপক্ষে প্রার্থী হয়ে জয়ী হয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ইউপি চেয়ারম্যান রবি শনিবার রাতে ডুমুরিয়া উপজেলা আ’লীগের কর্মী সভা শেষে মোটরসাইকেলে নগরীর নিরালা এলাকার বাসায় ফিরছিলেন। পথে রাত ১০টার দিকে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের গুটুদিয়া এলাকায় সন্ত্রাসীরা তাঁকে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ রবিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

্রিন্ট

আরও সংবদ