খুলনা | সোমবার | ১৯ মে ২০২৫ | ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ইসলামের ইতিহাসে আশুরা ও কারবালা

|
১২:২০ এ.এম | ১৭ জুলাই ২০২৪

ইসলামের ইতিহাসে আশুরা ও কারবালা গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। ‘আশুরা’ আরবি শব্দ, যার অর্থ ‘দশম’। মহররম মাসের দশম দিবসকে বলা হয় আশুরা। আর মহররম হচ্ছে হিজরি বর্ষের প্রথম মাস। মুসলমানদের বছর গণনার প্রথম মাসের দশম দিবসটি সৃষ্টির শুরু থেকেই বিভিন্ন কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। আশুরা দিবসের সর্বশেষ সংযোজন কারবালা প্রান্তরের এক মর্মান্তিক ঘটনা। ইসলামের আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই এ দিনটি ছিল পবিত্র ও সম্মানিত। প্রাচীন আরবের রীতিতে যে মাসগুলোতে যুদ্ধ করা হারাম ছিল, তার মধ্যে মহররম অন্যতম। আল­াহ নিজেই এ মাসকে ‘মর্যাদাপূর্ণ’ বলে ঘোষণা করেছেন।
‘মহররম’ শব্দের অর্থও সম্মানিত। আল­াহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল­াহর কাছে গণনা হিসাবের মাস হলো ১২টি। যেদিন থেকে তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এর মধ্যে চারটি মাস বিশেষ সম্মানিত’ (সুরা তওবা : ৩৬)। সম্মানিত চারটি মাস হলো-মহররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ। মহররম মাসের দশ তারিখকে বলা হয় আশুরা। আশুরা মানে দশম দিবস। 
আশুরা দিবসের ইতিহাস : কারবালায় ইমাম হোসাইন (রাঃ)-এর মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি’র বহু আগে থেকেই আশুরার গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত। এ দিনে হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়, হযরত নূহ (আঃ) মহাপ্লাবনের শেষে জুদি পাহাড়ে অবতরণ করেন, হযরত ইবরাহিম (আঃ)-কে অগ্নিকুন্ড থেকে মুক্তি দেওয়া, হযরত মুসা (আঃ) তুর পর্বতে আল­াহর সঙ্গে কথা বলেন, তাঁর শত্র“ ফেরাউনের নীল নদে ভরাডুবি হয়। এই দিনে হযরত আইয়ুব (আঃ) রোগ থেকে মুক্তি পান। হযরত ইয়াকুব (আঃ) তাঁর প্রিয় পুত্রকে ফিরে পান। হযরত ইউনুস (আঃ) মাছের পেট থেকে দজলা নদীতে বের হয়েছিলেন এই দিনে। হযরত সুলাইমান (আঃ) এই দিনে পুনরায় রাজত্ব ফিরে পান।
হযরত ঈসা (আঃ) পৃথিবীতে আগমন করেন এবং তাকে আকাশে তুলে নেওয়া হয় এই দিনেই। হযরত জিব্রাইল (আঃ) সর্বপ্রথম আল­াহর রহমত নিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর কাছে আগমন করেছিলেন। মহররমের কোনো এক শুক্রবার ইস্রাফিল (আঃ)-এর শিঙায় ফুৎকারের মাধ্যমে পৃথিবী ধ্বংস হবে। নবীজির ইন্তেকালের কয়েক দশক পর হিজরি ৬০ সালে এ দিনেই প্রিয় নবীর (সাঃ) প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হোসাইন (রাঃ) ফুরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে স্বপরিবারে শাহাদাত বরণ করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে ঘৃণ্যতম বর্বর হত্যাকান্ডে মেতে ওঠে ইয়াজিদের পিশাচ বাহিনী। কারবালার ঘটনা নিঃসন্দেহে জঘন্যতম এক ঘটনা। এ ঘটনা আমাদের শেখায় হকের পক্ষে অবিচল থাকার, ত্যাগ ও আত্মত্যাগের এবং জালিমের সামনে মাথা নত না করার শিক্ষা। তবে ইসলামে আশুরার মাহাত্ম্য কেবল এ কারণে নয়। মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) ২০ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার পর ৬০ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগে মজলিসে শূরা ও সামাজিক নেতাদের পরামর্শক্রমে তিনি তার পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী শাসক হিসেবে মনোনয়ন দেন। তার মৃত্যুর পর ইয়াজিদ খেলাফতের দাবি করলে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের কিছু এলাকার মানুষ তা মেনে নেন। পক্ষান্তরে মদিনার অধিকাংশ মানুষ, ইরাকের অনেকে বিশেষ করে কুফার জনগণ তা মানতে অস্বীকার করেন। কুফার জনগণ নবী দৌহিত্র হযরত হোসাইন (রাঃ)-কে খলিফা হিসেবে গ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কুফার লক্ষাধিক মানুষ ইমাম হোসাইনকে খলিফা হিসেবে বাইয়াতপত্র প্রেরণ করেন। মদিনায় অবস্থানরত সাহাবিরা এবং ইমাম হোসাইনের নিকটাত্মীয়রা ইমামকে কুফায় যেতে বারণ করেন। কারণ তারা আশঙ্কা করছিলেন, ইয়াজিদের পক্ষ থেকে বাঁধা এলে ইরাকবাসী ইমাম হোসাইনের পক্ষ ত্যাগ করবে। বাস্তবে সেটি হয়েছিল এবং কুফাবাসী ইমাম হোসাইরে পক্ষ ত্যাগ করে।
অতঃপর আশুরার দিন (১০ মহররম) সকাল থেকে ইবনে জিয়াদের বাহিনী হোসাইন (রাঃ)-এর ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে এবং ফুরাত নদী থেকে পানি সংগ্রহের সব পথ বন্ধ করে দেয়। হযরত হোসাইন (রাঃ)-এর শিবিরে শুরু হয় পানির জন্য হাহাকার। হোসাইন (রাঃ) বাতিলের কাছে মাথা নত না করে সঙ্গীদের নিয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকেন। এই যুদ্ধে একমাত্র ছেলে হযরত জয়নুল আবেদিন (রহঃ) ছাড়া পরিবারের শিশু, কিশোর ও মহিলাসহ পুরুষ সঙ্গীরা সবাই একে একে শাহাদাতের অমীয়সুধা পান করেন। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত ইমাম হোসাইন একাই বীর বিক্রমে লড়াই চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত নির্মম ও নির্দয়ভাবে ইমাম হোসাইনকে শহিদ করা হয়। সিনান বা শিমার নামক এক পাপিষ্ঠ তার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। ইয়াজিদের বাহিনী কারবালা প্রান্তরে জয়লাভ করলেও তারা মূলত পরাজিত হয়। ইতিহাস সাক্ষী, ইমাম হোসাইন ও তার সঙ্গীদের হত্যায় জড়িত প্রতিটি ব্যক্তি কয়েক বছরের মধ্যেই মুখতার সাকাফির বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। মাত্র চার বছরের মধ্যে ইয়াজিদ মৃত্যুবরণ করে এবং তার পুত্রেরও কয়েক দিনের মধ্যে মৃত্যু হয়। এরপর আর কোনো দিন তার বংশের কেউ শাসন ক্ষমতা লাভ করেনি। কারবালার প্রান্তরে মহানবী (সাঃ)-এর দৌহিত্র হযরত হোসাইনকে (রাঃ) মর্মান্তিকভাবে শহিদ করার ঘটনা সত্যিই প্রতিটি মুমিনের গা শিউরে ওঠার মতো। এ রক্তক্ষয়ী বেদনাবিধুর হৃদয়বিদারক ঘটনা মুসলিম জাতির সর্বাধিক বিয়োগান্তক ট্র্যাজেডি’র অন্যতম। বিশ্ব মুসলিমের কাছে ঐতিহ্যমন্ডিত আশুরার দিনে অত্যাচারী ইয়াজিদ মানুষের জীবনের আনন্দকে হত্যা করতে চেয়েছিল। চেয়েছিল পবিত্রতাকে কলুষিত করতে। কিন্তু পাষাণ হৃদয়ের শিমারের খঞ্জর হযরত হোসাইন (রাঃ)-এর শিরচ্ছেদ করলেও মানুষের মহত্ত¡ আর মহানুবতাকে হত্যা করতে পারেনি। বরং হক-বাতিলের আমৃত্যু লড়াই অব্যাহত রাখার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে কারবালার এ মর্মস্পর্শী ঘটনা। ত্যাগ ও তিতীক্ষার নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন নবী দৌহিত্র হযরত হোসাইন (রাঃ)। সেদিন হকেরই বিজয় হয়েছিল। ফলে ইতিহাসের সোনালি পাতায় ইমাম হোসাইন (রা.) আজও বেঁচে আছেন আদর্শিক প্রেরণা হিসেবে।
 

্রিন্ট

আরও সংবদ