খুলনা | রবিবার | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৩১ ভাদ্র ১৪৩১

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান

পদত্যাগের পর দেশ ছেড়ে পালালেন শেখ হাসিনা, সঙ্গে আছেন রেহানাও

খবর প্রতিবেদন |
০১:১৬ এ.এম | ০৬ অগাস্ট ২০২৪


পদত্যাগের পর দেশ ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সঙ্গে তার বোন শেখ রেহানাসহ পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। সোমবার বেলা আড়াইটায় গণভবন থেকে একটি সামরিক হেলিকপ্টার শেখ হাসিনাকে নিয়ে যাত্রা করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তারা হেলিকপ্টারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। 
কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের যে দাবি আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের এক দফায় পরিণত হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হয়েছে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের ঐতিহাসিক ভূমিকার মাধ্যমে।
এর আগে শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি ভারতের রাজধানী নয়াদিলি­র কাছে উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদে অবতরণের খবর দেয় ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। এখন যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চেয়েছেন বলে খবর দিচ্ছে ভারতের বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে লিখেছে, শেখ হাসিনা ভারতে নয়, লন্ডনে আশ্রয় চেয়েছেন। তবে ভারতের দিলি­ হয়ে তিনি লন্ডনে যাবেন। সোমবার রাতটা হয়ত তারা দিলি­তে থাকবেন।
ভারতের আনন্দবাজার ও আজকাল : বাংলাদেশের পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম জল্পনামুখর হলেও তাঁর অবস্থান নিয়ে ভারত সরকার কোনো মন্তব্য করেনি। কাজেই কীভাবে তিনি সোমবার দুপুরে দেশ ছাড়েন, তা মোটামুটি জানা গেলেও ভারতের কোন প্রান্তে তিনি এলেন, সে বিষয়ে কোনো মহল নির্দিষ্ট করে কিছু জানায়নি। ফলে দিনভর চলেছে অন্তহীন জল্পনা।
সোমবার বিকেল সন্ধ্যা নাগাদ ভারতের গণমাধ্যমে খবর বেরোয়, শেখ হাসিনার বিমান দিলি­র উপকণ্ঠে উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদের কাছে হিন্দন বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করেছে। হিন্দন নদীর ধারে ভারতীয় বিমানবাহিনীর এই ঘাঁটি থেকে তিনি কোথায় যাবেন, সেই বিষয়টিও অজানা। জল্পনা একটাই, হাসিনা ও তাঁর বোন রেহানার পরবর্তী গন্তব্য নাকি লন্ডন।
অন্যদিকে গণমাধ্যম দ্য হিন্দু শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে পারেন। তাঁর সঙ্গে থাকা বোন শেখ রেহানা যুক্তরাজ্যের নাগরিক।
কোটা আন্দোলন নিয়ে ভারত সরকার বেশ কিছুদিন পর সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তরে শুধু জানিয়েছিল, সেখানে যা চলছে, তা সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এক সপ্তাহ পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওই একই মন্তব্য করে বলেছিলেন, তাঁদের আশা, দ্রুত শান্তি ফিরবে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
এসব খবরের মধ্যে রয়েছে ১. হাসিনা ঢাকা থেকে আগরতলা গেছেন। ২. তিনি ঢাকা থেকে কলকাতা গেছেন। ৩. ভারত থেকে হাসিনা বিশেষ বিমানে দিলি­ রওনা হয়েছেন। ৪. হেলিকপ্টারে চেপেই তিনি দিলি­ রওনা হয়েছেন। ৫. দিলি­ বিমানবন্দরে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
সর্বশেষ খবর হচ্ছে, শেখ হাসিনার বিমান উত্তর প্রদেশের হিন্দন বিমান ঘাঁটিতে নেমেছে। এখান থেকে তিনি লন্ডন রওনা হবেন।
ভারত কেন এমন নীরবতা পালন করছে, সেটা নিয়েও জল্পনা অন্তহীন। এই নীরবতার মধ্য দিয়ে এটাই বোঝা যাচ্ছে, পরিস্থিতি অনুধাবন না করে ভারত কোনো মন্তব্য করতে চায় না। ভারত বিরোধী মনোভাব এই মুহূর্তে বাংলাদেশে তীব্র। ভারত এমন কিছু বলতে বা করতে চায় না, যাতে হিতে বিপরীত হয়।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন এ বছরের ১১ জানুয়ারি। এর আগে ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদে নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেনা সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। এরপর ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন হয় একতরফা, যেখানে বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। এই নির্বাচন আগের রাতেই ব্যালটে সিল মারার ব্যাপক অভিযোগ ছিল। এ নির্বাচন ‘রাতের ভোট’ নামে পরিচিতি পায়। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হন। তবে এ নির্বাচনও বিতর্কিত। এতেও প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। নিজদলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী করে ‘ডামি’ প্রতিদ্ব›িদ্বতার আয়োজন করা হয়। এ নির্বাচনটিকে বিরোধীরা ‘ডামি নির্বাচন’ বলে আখ্যা দেন। ছয় মাসের মাথায় ব্যাপক ছাত্র ও গণবিক্ষোভের মুখে তিনি সোমবার পদত্যাগ করে হেলিকপ্টারযোগে দেশ ছেড়েছেন।
গণভবনে ঢুকে পড়েন হাজারো মানুষ : প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে ঢুকে পরেন হাজারো মানুষ। সোমবার দুপুর আড়াইটার পর থেকেই তারা গণভবনে ঢুকতে শুরু করেন। গণবিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বোনকে নিয়ে ঢাকা ছাড়েন।
যা বলেছে আনন্দবাজার : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইস্তফা দিয়েছেন। বোন রেহানাকে নিয়ে তিনি ‘গণভবন’ ছেড়েছেন বলে খবর। তাঁকে কপ্টারে করে ‘নিরাপদ’ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে পাঠানো হচ্ছে। বাংলাদেশে সেনার অধীনে তদারকি সরকার গঠিত হতে পারে। 
সূত্রের খবর, তার আগে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর তরফে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে সময় বেঁধে দেওয়া হয় ইস্তফা দেওয়ার জন্য। ৪৫ মিনিট সময় তাঁকে দেওয়া হয়েছিল বলে খবর। তার পরেই তিনি ইস্তফা দিয়েছেন। বাংলাদেশ গণমাধ্যম সূত্রে খবর, দেশ ছাড়ার আগে হাসিনা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ রেকর্ড করতে চেয়েছিলেন। তাঁকে সেই সুযোগও দেয়নি বাংলাদেশ সেনা। কিছুক্ষণ পরে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
কপ্টারে দেশ ছেড়েছেন হাসিনা। একটি সূত্রের দাবি, হাসিনা নয়াদিলি­র সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে উদ্ধারের জন্য ভারত থেকে বাংলাদেশে বিমান পাঠানো হবে না বলে জানিয়ে দেয় নয়াদিলি­। ভারতের তরফে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের আকাশসীমায় ভারত কোনও বিমান পাঠাবে না। কারণ তাতে আইন লঙ্ঘিত হতে পারে। ভারত থেকে জানানো হয়, হাসিনাকে ভারতে পৌঁছাতে হবে। তার পর সেখান থেকে তাঁকে দিলি­তে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। কপ্টারে ঢাকা থেকে দিলি­ পর্যন্ত যাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে তাঁর নিকটবর্তী অবতরণ স্থান হতে পারে কলকাতা বিমানবন্দর। সেখান থেকে তাঁকে বিশেষ বিমানে করে দিলি­তে নিয়ে যাওয়া হতে পারে। অন্যান্য সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, ত্রিপুরার আগরতলা বিমানবন্দরে এবং শিলিগুড়ির কাছে বাগডোগরা বিমানবন্দরেও নামতে পারেন হাসিনা।
এদিকে বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা গণভবন থেকে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। শেখ হাসিনা যাওয়ার আগে একটি ভাষণ রেকর্ড করে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি সে সুযোগও পাননি। সোমবার বেলা আড়াইটায় বঙ্গভবন থেকে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে শেখ হাসিনা উড্ডয়ন করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা ছিলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তাঁরা হেলিকপ্টারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন।
এর আগে গত কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশে সরকার বিরোধী আন্দোলন চলছে। আন্দোলনকারীদের একটাই দাবি ছিল হাসিনা সরকারের পদত্যাগ। রবিবার বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। পরিস্থিতি ক্রমে জটিল হচ্ছিল। সোমবার হাসিনা পদত্যাগ করলেন।
রোববার সন্ধ্যায় বাংলাদেশে অশান্তি ঠেকাতে কার্ফু জারি করা হয়েছিল। সোমবার থেকে তিন দিন ছুটিও ঘোষণা করে সরকার। তবে সোমবার সকাল থেকেই ঢাকার রাস্তায় কার্ফু উপেক্ষা করে ভিড় বাড়তে থাকে মানুষের। আন্দোলনকারীদের জমায়েতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। কাঁদানে গ্যাসও ছোড়া হয়। কিন্তু আন্দোলন দমানো যায়নি। পরে শোনা যায়, জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সেনাপ্রধান। তার পরেই হাসিনার পদত্যাগের খবর প্রকাশ্যে আসে। বাংলাদেশ গণমাধ্যম সূত্রে খবর, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের মাঝেই বাংলাদেশের রাস্তায় নেমে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। লাখ লাখ মানুষ হাসিনার বাসভবন ‘গণভবন’-এ ঢুকে পড়েছেন।
গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসেন। মাত্র সাত মাসেই ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন ঐকতানে অভাবনীয় পতন হয়েছে সেই সরকারের।
এক মাসের বেশি সময় ধরে উত্তাল গোটা দেশ। কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিকে শুরুর দিকে গ্রাহ্যই করেনি আওয়ামী লীগ সরকার। উল্টো প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নানাভাবে অসম্মানজনক বক্তব্য দিয়ে হেয় করেন।
একপর্যায়ে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের দমনের নামে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের লেলিয়ে দেওয়া হয়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন রূপ নেয় সংঘাত-সহিংসতায়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও দুর্বৃত্তদের গুলিতে মরেছে শিশু থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী-সাধারণ জনতা।
এমন প্রাণহানি এর আগে দেখেনি দেশের মানুষ। গোটা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভের আগুন। যে কারণে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তা আদালতে সুরাহা হলেও, প্রাণহানিতে জড়িতদের বিচারসহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি ওঠে আন্দোলন থেকে।
এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের ৯ দফা গত ২ আগস্ট সরকারের পদত্যাগের এক দফায় পরিণত হয়। আন্দোলনের মূল প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একের পর এক কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। তাদেরকে দমন করতে করতে গিয়ে সবশেষ গত রোববারই (৪ আগস্ট) প্রাণ ঝরেছে দেড় শতাধিক।
সোমবার সকাল থেকে রাজধানী ঢাকা ছিল থমথমে। চলছিল কারফিউ, নির্বাহী আদেশে সাধারণ ছুটিও। বন্ধ অফিস-আদালত। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই  বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত লং মার্চ টু ঢাকা পালনে কারফিউ ভেঙে রাজধানীর পথে পথে লাখো ছাত্র-জনতার ঢল নামে।

্রিন্ট

আরও সংবদ