খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

চেক হলেই জেল-জরিমানা!

এড. এম মাফতুন আহমেদ |
১২:১৫ এ.এম | ১০ অগাস্ট ২০২৪


জনাব ওবায়দুল হাসান। মান্যবর প্রধান বিচারপতি। পাশাপাশি দেশের একজন বিদগ্ধ গুণী কলামিষ্ট। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে তাঁর দু’কিস্তি কলামে বিগত ক-বছর আগে আলোচনা-সমালোচনা করছিলাম, অন্য একটি জাতীয় দৈনিকে। তিনি তখন ছিলেন সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম মাননীয় বিচারক। এসব ভিন্ন কথা হলেও, আলোচনার স্বার্থে অবশ্যই প্রাসঙ্গিক।
অপ্রিয় হলেও সত্য কথা বিচার বিভাগ সংস্করনে দেশের একটি অঙ্গের প্রধান হয়ে সংশ্লিষ্টদের নানা উপদেশমূলক কথা তিনি প্রায়শ বলে যাচ্ছেন। ২৮ জুন ২০২৪ তারিখে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাংবাদিকতায় বজলুর রহমান স্মৃতিপদক-২০২৩ প্রদান অনুষ্ঠানে বিচার ব্যবস্থায় যদি কোন অনিয়ম কিংবা দুর্নীতি হয় তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া জরুরী। এতে বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা,জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার জায়গাটি নিশ্চিত হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি  দায়িত্ব গ্রহনের প্রক্কালে আরও বলেছিলেন, ‘দুর্নীতি একটি ক্যানসারের মতো কাজ করছে সর্বত্র। সব জায়গাতেই কিছু না কিছু দুর্নীতি আছে। এমনকি আদালত প্রাঙ্গনেও যে  কোনো দুর্নীতি বা অনিয়ম নেই,তাও বলা যাবে না। সূত্র : (ল-ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ২৯ জুন ২০২৪ সহ সমস্ত জাতীয় দৈনিক সমূহে)।
মান্যবর প্রধান বিচারপতি শুধু বিচারপ্রার্থী নয়, গণমানুষের হৃদয়ের কথা এতদিন পরে বলেছেন। সত্য কথা সাহসের সাথে উচ্চারণ করেছেন। আসলে বিচার বিভাগে অনিয়ম, দুর্নীতি হলে গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া জরুরী। অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কালো হাতের অঙ্গুলী হেলনে কোন বিচার হতে পারে না। সেটা প্রকৃত অর্থে বিচার নয়। বিচারের নামে প্রহসন মাত্র। শুধু বিচার করলে হবে না। বিচারকে দৃশ্যমান হতে হবে। সেটাই প্রকৃত ন্যায় বিচার।
প্রধান বিচারপতির সুরে সুর মিলিয়ে মনে পড়ে গেল কলামটি লিখতে যেয়ে গোপাল ভাঁড়ের একটি কথা। একবার মহারাজ কৃষ্ণ চন্দ্র গোপাল ভাঁড়ের ওপর অসন্তÍষ্ট হয়েছিলেন। তিনি গোপাল ভাঁড়কে শাস্তি দেবার জন্য তাঁর মন্ত্রীকে বললেন-এমন একটি প্রশ্ন তৈরি করো,যার উত্তর গোপাল ভাঁড় দিতে পারবে না। তা হলেই তার গুমর ফাঁস হয়ে যাবে। মন্ত্রী অনেক চিন্তা করে রাজাকে পরামর্শ দিলেন যে গোপাল ভাঁড়কে জিজ্ঞেস করুন, সত্য থেকে মিথ্যা কতদূর। মহারাজ এ প্রশ্ন করাতে গোপাল ভাঁড় জবাব দিলেন, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে ফারাক খুবই কম। রাজা বললেন, কত কম সেটা বলতে হবে। গোপাল ভাড় তার বাম হাতটি দিয়ে তার কান এবং ডান হাতটি দিয়ে চোখ ঢেকে বললেন, কান এবং চোখের দূরত্ব যতটুকু,সত্য এবং মিথ্যার দূরত্ব মাত্র ততটুকু। মহারাজ বললেন, এটা কিভাবে নির্ণয় করেছ? গোপাল ভাঁড় বললেন, যা কানে শোনা যায় তার বেশির ভাগই মিথ্যা, যা চোখে দেখা যায় কেবল সেটাই সত্য।
আসলে ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে, বধির করে। মানুষের যখন পতন আসে, তখন পদে পদে ভুল করতে থাকে।  দৃশ্যমান রকমফের দুর্নীতি চোখের সামনে ভাসছে। সবাই এক বাক্যে বলবেন ধ্রুব সত্য। কোনটি প্রতিরোধ করবেন? মানুষের যখন নৈতিকতা থাকে না,মানবিকতা বলে কিছুই থাকে না। এমন পরিস্থিতি যে, কে কার নির্দেশনা শোনে। সবাই তো নেতা, সবাই হবু রাজা। সবাই হঠাৎ বাবু। রাস্তার এককালের পকেটমার, ছিনতাইকারী, ভূমিদস্যু রাতারাতি শিল্পপতি, পুঁজিপতি; দেশের জগৎশেঠ।
বাতাসে বাতাসে বারুদের গন্ধ। রাস্তায়, রাস্তায় তরতাজা রক্ত আগামীর ভবিষ্যত লুটে পড়ছে। এ যেন স্বাধীন দেশে রক্তের হোলি খেলা চলছে। এসব দেখে নাগরিক হিসেবে হতভম্ব এবং বিষ্মিত হওয়া ছাড়া কিছুই নেই। কারণ কে কার কাছে বিচার চাইবে। বিচারের বাণী যেন নিভৃতে কাঁধে।
কপটতার বাসা বেঁধেছে ঘরে ঘরে। রাজনৈতিক তোষামুদিরা অনৈতিকতায় বিভোর। ক্ষমতা মানুষকে নিঃসঙ্গ করে,ক্ষমতাকে ঘিরে থাকে চাটুকারেরা। তারা নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। ঊর্ধ্বতন মহল নির্দেশ জারি করেন। অধস্তন মহল দেখেও না দেখার ভান করেন। সেই ব্রিটিশ ভারতে আইসিএস, সিএসপি, ইপিসিএসদের আদলে ফরমান জারি করার কেউ কী এখন এখন আর নেই? যিনি জারি করবেন,তাঁরও গোড়ায় গলদ। অকুণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। দেশকে নিয়ে নেই কোন তাঁর ভাবনা। দিল্লী-আমেরিকা-ইংল্যান্ড নিয়ে দিবা-নিশি চিন্তা। হায়রে দেশের ল অ্যান্ড অর্ডার। দেশে-বিদেশে প্রাসাদোপম নীলঘর গড়ায় তাঁরা ব্যস্ত। ফলে হুকুম তামিলে নেই কেউ তটস্থ। খাতা-কলমে থেকে যায় নামমাত্র বড় হুজুরের নির্দেশনামা।
সমাজ, প্রশাসনে অযোগ্যদের পাশাখেলা চলছে। কেউ টাকার জোরে, মামুর জোরে, খালুর জোরে, রাজনৈতিক প্রভাবে, মেধাশূন্য নাশক এককালের কোটার জোরে হয়েছে বড় সাহেব। কখনো কখনো ব বলতে যেয়ে লিখে ফেলেন ক। এদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এরা ঔপনিবেশিক আমলের প্রসাদোপম অফিসে বসে কলম ঘুরাচ্ছেন। আর হুইসেল বাজিয়ে ব্রান্ডের গাড়ীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যা মনে আসছে দিল­ীর এককালের শাসক বিন তুগলকের মতো হুকুম দিচ্ছে। ফলে অযোগ্য,অপদার্থদের অনৈতিকতার কাছে নীলবেদনায় তছনছ হয়ে যাচ্ছে এদেশের নাঙ্গা, ভূখা সাধারণ মানুষের জীবন।
অজ্ঞতা, মোসাহেবী এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছে যে বেআইনী আদেশ দিলেও আমরা বলছি জ্বী স্যার.....জ্বী স্যার। মারহাবা, মারহাবা। তবে সবাই না। কেউ না কেউ যে প্রতিবাদ করছেন না তা কিন্তু নয়। এসব করতে যেয়ে ব্রিটিশ ভারতের বিখ্যাত মামলা রাজা নন্দ কুমারের মতো ভাগ্যের পরিণতি ঢেকে নিয়ে আসছে কিছু প্রতিবাদীর ললাটে।
সংবিধান একটি রাষ্ট্রের দলিল। সংবিধান বুকে ধারণ করে পাশ্চত্য সভ্যতা আমেরিকানরা শপথ গ্রহণ করেন। আর আমরা! সংবিধান ক’জনের বাড়িতে আছে জানি না। থাকলেও বুকসেলফে সাজিয়ে রেখেছে বলে মনে হয়। যারা জ্ঞানী, গুণী, বিজ্ঞ বলে দাবিদার রাষ্ট্রীয় সংবিধান বছরে একদিন চোখ মিলিয়ে দেখেন কিনা বলে হয় না। তারা নিজেকে ভাবে কত হনুরে। এবার ভেবে দেখুন কিভাবে দেশত্ববোধ গড়ে উঠবে দেশে,জনমনে।
যেতে হবে আইনের গভীরে : ব্যাংক চেক হলেই জেল-জরিমানা!। এই শিরোনাম দিয়ে শুরু করেছিলাম কলামটি। শিরোনামের প্রতিপাদ্য বিষয়ের সাথে অনেকে একমত হতে পারেন, নাও পারেন। তবে সেখানে আলোচনা, সেখানে সমালোচনা। সব মিলিয়ে বলা যায় আত্মসমালোচনা।
আইনের মুখবন্ধে বলা হয়েছে-শত অপরাধী মুক্তি পায় পাক, তবে কোন নিরীহ মানুষ যেন হয়রানীর শিকার না হয়। সারা বাংলাদেশের প্রায় আদালত আঙ্গিনায় কম-বেশী যাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। অনেকের সাথে কমবেশী সখ্যতা রয়েছে। আদালত আঙ্গিনায় ভুক্তভোগীদের মুখরোচক কথা একটাই ১৮৮২ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮ ধারা। যা সাধারণ জনগনের কাছে ১৩৮ ধারা মামলা হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত।
এই মামলার ধারা দেখলে অধিকাংশ বিজ্ঞ আইনজীবীরা ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েন। তাঁদের কাছে সংশয় নিশ্চিত জেল জরিমানা। প্রশ্ন হলো কেন? আর অধিকাংশের মনে বিরূপ ধারণা এ কারনে যে,অধঃস্তন বিজ্ঞ বিচারকরা সংবিধান-আইন-নজিরের কোন কিছু মূল্যায়ন করেন না। মামলার গভীরে যেয়ে সময় নষ্ট করতে চান না। চেক হলেই অধিকাংশ মামলায় সাজা এ কথাটি বর্তমানে প্রাকটিসে পরিণত হয়ে গেছে।  বিষয়টি একবারে অমূলক মিথ্যা নয়।
মহামান্য হ্ইাকোর্টের সিদ্ধান্তের আলোকে বলা হয়েছে- In the light of the decision of the High Court, it has been said- The defendant may in all cases plead the cause of action for issuing the check by the issuer of such check so as to obtain a partial defense at trial. In the light of Sections 4, 6, 8, 943, 58 and 118 of the Act, there is no restriction on taking defense measures by the accused. And the trial court shall give the accused sufficient opportunity to take such circumstances in the conduct of the trial. সূত্র (Apex Law Reports–Volume-7(H D),para-42-p-3)
অর্থাৎ-(হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের আলোকে বলা হয়েছে-আসামি যাতে সব অবস্থায় বিচারে একটি অর্ধবহ প্রতিরক্ষা পেতে পারে সে জন্য ঐ জাতীয় চেকটি ইস্যুকারী কর্তৃক চেকটি ইস্যু করার কারণ বা হেতু সংক্রান্ত খুটিনাটি নালিশী আবেদন করতে পারেন। আইনের ৪,৬,৮,৯৪৩,৫৮ ও ১১৮ ধারার আলোকে আসামী কর্তৃক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে তেমন কোন বাধা নিষেধ নেই। এবং  বিচারিক আদালত  বিচার কাজ পরিচালনাকালে ঐ জাতীয় “উবভবহংব’ গ্রহণের জন্য আসামিকে পর্যাপ্ত সুযোগ দিবেন)। 
তবে সব অধস্তন বিচারকের ক্ষেত্রে নয়। দেখেছি খুলনা মহানগর যুগ্ম জজ-১ ও জেলা যুগ্ম জজ-৪ বিচারক উচ্চ আদালতের নজীর বা আইনকে যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করেন। আদালতকে প্রাণবন্ত করে রাখার চেষ্টা করেন। জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিচার প্রার্থীদের মাঝে দৃশ্যমান বিচার করার প্রয়োজনীতা অনুভব করেন।
মনে রাখতে হবে একটি পাখির দু’টি ডানা। একটি ডানা বিচারক,অপরটি আইনজীবী। আগেই বলে রাখি শুধু এ বিষয় নয়, সব বিষয়ে ধারণা বা অভিজ্ঞতা আমার খুবই কম। তবুও দৃঢ়তার সাথে বলবো অধিকাংশ পেশায় অনেকে পড়াশুনার চাইতে নগদ নারায়নে বিশ^াসী। একজন বিচারকের বিশ^স্ত শিক্ষক হলেন আইনজীবী। সেই আইনজীবীকে গহীন সমুদ্র থেকে সর্ব ধরনের মনিমুক্ত কুড়িয়ে আনতে হবে। আদালতে উপস্থাপন করতে হবে। তবে না বলা যাবে বিজ্ঞ।
সুদখোরদের কবলে জরাক্লিষ্ট : নতুন নয়, যুগ থেকে যুগান্তরে। সুদখোর, মহাজন, দালাল, ফড়িয়াদের হাতে জিম্মি গরীব, অসহায় জনগণ। শুধু ইসলাম নয়, প্রতিটি ধর্মে সুদখোররা সমাজের কাছে নিকৃষ্ট, ঘৃণিত হিসেবে পরিচিত। মানুষ মানুষের জন্য। তাই প্রয়োজনে অপরজনকে খোঁজে। সে প্রয়োজন বিবিধ। টাকার প্রয়োজনটা অনেকাংশে বেশী। জামানত হিসেবে প্রয়োজনে ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়ে টাকা নেয় ৫০ হাজার। সুদে আসলে ইতোপূর্বে সব পরিশোধ। তবুও সুদ ব্যবসায়ী চেকটি অপব্যবহার করে অর্থাৎ নিজে বা কাউকে দিয়ে ব্যবহার করে চেকটি ভরাট করে লেখে ১৫ লক্ষ টাকা।
স্বাক্ষর এবং টাকার অংক ভিন্ন হাতের লেখা। ঠুকে দেয় ১৮৮২ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮ ধারায় মামলা। অতঃপর সর্বশান্ত হয়ে গরু-ছাগল সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে একদিন সে পরিণত হয় ভিস্তিওয়ালায়। অথচ আইনের দৃষ্টিতে এ ধরনের চেক চরম বেআইনী। আরও বেআইনী কথিত পাওনাদারের টাকা দেবার আর্থিক সামর্থ আছে কিনা? এসব বেআইনী হয়েও কথিত জেল-জরিমানা মওকুফ নেই। শুধু জেল-জরিমানা নয়, মূল টাকার অর্ধেক ব্যাংকে জমা দিয়ে আদালত থেকে নিতে হয় জামিন।
অতঃপর আপীল। অন্যথায় জেলের ঘানি টানতে হয় বছর ধরে। আইন বলছে এসব চেক বেআইনী। প্রয়োগ হচ্ছে যথেচ্ছাচার হরহামেশায় বেআইনী ও ইচ্ছাধীনভাবে? এই বেআইনী আদেশের বিরুদ্ধে লড়তে পারবে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ পর্যন্ত। তাহলে মাঝ পথে অর্থেক টাকা জমা কেন? আর টাকা জমা দিলেও তা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত উত্তোলনে বাধা থাকতে হবে।
ব্ল্যাঙ্ক চেক বেআইনী হলেও : আগেই বলেছি প্রায়শ অধিকাংশ অধঃস্তন আদালত উচ্চ আদালতের নজিরকে অনুসরণ করেন না। এক কথায় অধস্তন আদালতে অধিকাংশের ভাষায় এসব নজীরের আইনগত কোন মূল্য নেই বলে বিদ্রুপভাবে অনেক কথাও শোনা যায় কালেভদ্রে।
চেক ডিসঅনার হলেই এখন আর সাজা নয়। প্রতিদানবিহীন হস্তান্তরযোগ্য দলিল বিষয়ে যখন পক্ষগণের মধ্যে যেখানে কোন প্রতিদান (কনসিডারেশন) থাকে না, সেখানে হস্তান্তরযোগ্য দলিল অকার্যকর হিসেবে গণ্য হবে। প্রতিদান ছাড়া যেমন চুক্তি হয় না, তেমনি প্রতিদান ছাড়া কোন হস্তান্তর যোগ্য দলিল কার্যকর করা যাবে না। কাজেই স্বাক্ষরসহ চেক কারও কাছে হস্তগত হলেই কিংবা ব্যাংক ডিসঅনার করলেই চেকের প্রতিদান বা দেনা পাওনা বা লেনদেন প্রমাণ করতে না পারলে মামলায় আসামি খালাস পাবে-এমনটিই বলেছেন উচ্চ আদালত। সূত্রঃ (লোকমান বনাম আয়ুব আলী এবং রাষ্ট্র মামলা- যা ৩৮, বিএলডি, পৃষ্টা ৬১৬,৬১৭- ৬২০)।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত Appellate Division  একটি নজীরে বলা হয়েছে- Whenever a cheque is drawn by a person in order to make payment,the amount must be given in by the drawer of the cheque. Since the amount was not given by the drawer of the cheque having no intention for making any payment,such a cheque cannot be considered as a cheque to serve the purpose of section 138 of the act. (Dr. shyamal Baidza vs Islami Bank Bangladesh Ltd.and another„.. Respondents. 66 D.L.R-(2014) P.547).
অর্থাৎ-টাকা প্রদানের জন্য চেক লিখলে তাতে অবশ্যই চেক সইকারী কর্তৃক চেকে টাকার সংখ্যা বসানো হয়নি, এই চেককে নেগোসিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট এ্যাক্টের ১৩৮ ধারার উদ্দেশ্যে পূরনের জন্য চেক হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না।
অনুরূপভাবে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের আরও একটি বেঞ্চ ঘোষণা করে যে,- If the blank check has only the signature of the accused and its other columns are filled by the plaintiff or his representative and the check is later dishonored and the plaintiff files a case against the accused under section 138, then the High Court Division will not proceed.(Monammad Ali Fatik V. The State another (22 BLT (HCD) 2014,p.24
অর্থাৎ- (-ব্ল্যাংক চেকে যদি শুধুমাত্র আসামির স্বাক্ষর থাকে এবং উহার অন্যান্য কলামগুলো বাদী বা তার প্রতিনিধি পূরণ করে এবং পরবর্তীতে চেকটি ডিজঅনার হয় এবং বাদী আসামীর বিরুদ্ধে ১৩৮ দারায় মামলা করে তাহলে ঐ মামলা চলবে না মর্মে হাইকোর্ট বিভাগ মত প্রকাশ করেন)। এই নজীরটির সূত্র ধরে আমাদের দেশের হাইকোর্টের মতো দিল­ীর অন্ধ প্রদেশ হাইকোর্টও একমত পোষণ করেন। (Taher N.Khambet v.Vinayak EnterPrise and others (com.cas.(A.P) Vol. 86 (1996).pp. 471-477.
Appellate Division  আর একটি নজীরে উলে­খ করা হয়েছে--It is illegal to make any changes to a check without the consent of the check drawer. However, cashing a bank check and fraudulently depositing a larger amount than the actual amount owed is related to the incident. Placing a larger amount on a bank check than the actual amount owed is an element of fraud and strikes at the root of the transaction. This cannot be accepted. (Alauddin v Rashtra, 24 BLC(AD) (2019) 139)
অর্থাৎ (চেক প্রদানকারীর সম্মতি ছাড়া চেকে কোনও পরিবর্তন আনা বেআইনী। যদিও ব্ল্যাংক চেক নেওয়া এবং প্রতারণামূলকভাবে প্রকৃত পাওনার চেয়ে বড় অংক বসিয়ে নেওয়া ঘটনা সম্পর্কিত বিষয়। প্রকৃত পাওনা টাকার চেয়ে বড় অংক ব্ল্যাংক চেকে বসিয়ে দেওয়া প্রতারণার একটি উপাদান এবং লেনদেনের গোড়ায় আঘাত করে। এটি মেনে নেওয়া যায় না।) সূত্র : (আলাউদ্দিন বনাম রাষ্ট্র, ২৪ বিএলসি (এডি) (২০১৯) ১৩৯)
ব্ল্যাংক চেক সংক্রান্ত ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর নির্দেশাবলী জারী করেছেন : Bank authorities accept multiple bank checks on the eve of taking loan from commercial banks. which is illegal. In this regard, according to the circular issued by the Financial Integrity and Customer Services Department of Bangladesh Bank Head Office, Dhaka on February 2, 2017, the concerned commercial banks have been instructed not to accept blank checks as collateral.
But in spite of that, commercial banks accept blank checks in most cases while providing loans to customers in order to create a liability against the loan given by the customer. The highest appellate court of the country made extensive comments on this matter. Source: সূত্র: (Mohammad Alauddin v The state(xvi Adc(2019) 238,249 ) 
অর্থাৎ (বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রাক্কালে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একাধিক ব্ল্যাংক চেক গ্রহণ করে। যা বেআইনী। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধান কার্যালয়, ঢাকা এর ফাইন্যান্সন্সিয়াল ইন্টিগিটি অ্যাÐ কাস্টমার সার্ভিসেস  ডিপার্টমেন্ট  কর্তৃক গত ২ ফেব্রæয়ারী ২০১৭ সালে প্রচারিত সার্কুলার অনুসারে ব্যাংক কর্তৃক ফাঁকা চেক জামানত হিসেবে গ্রহণ না করার জন্য সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে নির্দেশ প্রদান করে।
কিন্তু তা সত্তে¡ও বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ গ্রাহক ঋণ প্রদানের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্রাহকের নিকট থেকে প্রদত্ত ঋনের বিপরীত দায় সৃষ্টির লক্ষ্যে ফাঁকা চেক গ্রহণ করে থাকে। দেশের সর্বোচ্চ আপীল আদালত এ বিষয়ে ব্যাপক  মন্তব্য করেন)। সূত্রঃ (Mohammad Alauddin v The state( xvi Adc(2019) 238,249)
তাহলে আমরা উচ্চ আদালতের এসব সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ব্ল্যাংক চেককে অকার্যকরি চেক হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। দুর্ভাগ্য অধিকাংশ অধস্তন আদালতের কাছে এসব আইন বা নজীরের কোন মূল্য নেই। চেক হলেই আসামির নির্ঘাত সাজা। আইন, সংবিধান বা উচ্চ আদালতের নজীরের গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
সংবিধান কী বলে? : সাংবিধানিক নির্দেশাবলী মান্য করা প্রত্যেকের বাধ্যতামূলক। সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদে কী বলা হয়েছে-The law declared by the Appellate Division shall court Division and the law devlared by either division of the Supreme court shall be binding on all courts subordinate to all. (অর্থাৎ-আপীল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রীম কোটের্র যে কোন বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধঃস্তন সকল আদালতের জন্য অবশ্যই পালনীয় হইবে)।
প্রিয় পাঠক, এ বিষয়ে আপনাদের নিয়ে যাবো ইংল্যন্ডের বিচার ব্যবস্থার দিকে। সে দেশের আইন-আদালত এ বিষয়ে কী বলে?-“সাধারণ আইন-সাময়িকীতে প্রকাশিত আদালতের কোন রায় বা সিদ্ধান্ত যা পরবর্তী কোন মামলায় অনুরূপ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য বাধ্যতামূলক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ইংল্যান্ডের লর্ড-সভার সিদ্ধান্ত আপিল আদালতগুলোর উপর বাধ্যতাকর এবং লর্ড সভা ও সাধারণত অনুসরণ করে থাকে। আপীল আদালতের সিদ্ধান্ত অধস্তন আদালতগুলোর উপর বাধ্যতামূলক এবং কতিপয় ব্যতিক্রম সাপেক্ষে আপীল আদালতের উপরও তা বাধ্যতামলূক হয়। হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত অধস্তন আদালতগুলোর উপর বাধ্যতামূলক, কিন্তু অধস্তন আদালতগুলোর সিদ্ধান্ত কোন বাধ্যতামূলক নজির সৃষ্টি করে না। পূর্ববর্তী কোন রায় বা সিদ্ধান্তের সকল বিষয়ই বাধ্যতামূলক নয়, কেবল রায়ের যে অংশ সিদ্ধান্তে নিয়ম বিবৃত হয়,তা বাধ্যকর, অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য নয়। তাই আমাদের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুসারে, আপীল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন (নজির) হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রীম কোটের্র যে কোন বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন (নজির) অধস্তন সকল আদালতের জন্য অবশ্য পালনীয় হতে হবে। দেশের সর্বশেষ বা চূড়ান্ত আদালত নিজের রায় বা নজির অনুসরণ করতে বাধ্য নয়। সূত্র : (আরিফ খান, বাংলাদেশের সংবিধান সর্বশেষ সংশোধনী সহ পৃ.-৩৫২)
উচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য অতঃপর : সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে ৬৩ উখজ (অউ) ৫৭ পৃষ্ঠায় উলে­খিত রাষ্ট্র বনাম মুক্তা খাতুন এবং অন্যান্য মামলায় বলেছেন,- Any decision passed by the Appellate Division is binding upon all courts in Bangladesh and no judge can ignore it. If he does, it may not only be contemptuous but also tantamount to violation of the constitution. Binding Effect of the Decision and Orders of the Supreme Court এর সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বিষয়টি ভায়োলেট করা হয়। 
বিচার হোক আইনের আঙ্গিকে : স্বাধীনতার বয়স নেহাত কম হলো না। মেঘে মেঘে অনেক দিন। গত এক দশকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনেতিক সুচকসমূহ বাংলাদেশে অভূতপূর্ব উন্নয়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছে। এই ভূমিকা পালন করতে হলে বার,বেঞ্চ ও আইনশিক্ষাকে প্রশ্নাতীত দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিতে হবে।
সুপ্রীম কোর্টর মহামান্য APPELLATE DIVISION  এর একটি নজীরে বলা হয়েছে-Judge should avoid expressing their Fuling, emotion and sentiment in the  Judgment but to follow the law, evidence and material on record.
আবেগ এবং চোখ-মুখ দেখে নয়,শ্রম সাধনা,কঠিন অধ্যবসায় এবং নির্ভীকতার সাথে দৃশ্যমান বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অধঃস্তন বিচারকদের Code off conduct মেনে চলতে হবে। তেমনি Canons of professional conduct and Etiquette অর্থাৎ আইনজীবীদের জন্য আচরণবিধি মেনে চলা একান্ত আবশ্যক । শুধু তাই নয়, আরও কঠিন অধ্যবসয়ে নিয়োজিত থেকে পেশার ঐতিহ্যকে সমুজ¦ল করতে হবে। তাহলে বিচারপ্রার্থীরা কাক্সিক্ষত ন্যায় বিচার পাবে। দৃশ্যমান আইনের শাসন যখন নিশ্চিত হবে, বুঝে নিতে হবে আইন-আদালতের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা তখন দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। 
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, কলামিষ্ট, সম্পাদক আজাদবার্তা ।

্রিন্ট

আরও সংবদ