খুলনা | শনিবার | ১২ জুলাই ২০২৫ | ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

খাদেম, অধীনস্থ ও শ্রমিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী |
০১:৪৩ এ.এম | ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১

ব্যক্তিগত, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রিয়, আন্তর্জাতিক ইত্যাদি সার্বিক বিষয়েই মহানবী (সা.) আমাদের আদর্শ বা মডেল। তার জীবনের সর্বত্রই রয়েছে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় অনুপম আদর্শ। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং মহান আল­াহপাক প্রবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন, নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রসূলের জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ (সূরা আহযাব : ২১)। খোঁজ নিলে দেখা যাবে বিশ্বের প্রায় প্রত্যেক মানুষই তার জীবনে কোন না কোন মানুষকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। এখানে একটা ছোট্ট প্রশ্ন, মহানবী (সা.) ছাড়া পৃথিবীতে এমন একটি মানুষও কি কেউ দেখাতে পারবেন যিনি জীবন চলার সব বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন করেছেন অথবা দিকনের্দেশনা দিয়েছেন? এর উত্তর কেউই দিতে পারবেন না। কারণ, কোন মানুষই আজ পর্যন্ত নিজেকে সার্বিক বিষয়ে মডেল বা আদর্শ দাবি করতে সক্ষম হননি। অথচ মহান আল­াহ তায়ালাই তাকে মডেল বা আদর্শ হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে পেশ করেছেন। আর তিনি কেয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানুুষের জন্য মডেল বা অনুকরণীয় নমুনা। জীবনের এমন কোন দিক নেই যে বিষয়ে তিনি দিকনির্দেশনা দেননি। হাতের নখ কাটা, মাথার চুল কাটা থেকে রাষ্ট্র চালানো পর্যন্ত সব বিষয়েই তিনি শুধু দিক নির্দেশনা দেননি, বরং তিনি তার জীবদ্দশায় তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিয়েছেন। শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা কি হবে সেটাও আল­াহ’র রসূল (সা.) আমাদেরকে শিখায়ে গেছেন । পবিত্র কোরআন-হাদিসে এ ব্যাপারে পরিস্কার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইসলাম সব ধরনের জায়েজ কাজকেই উৎসাহিত করেছে। ইসলামে কোন কাজই হীন, তুচ্ছ বা ঘৃণার নয়। সর্বযুগের, সর্বকালের, সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হুজুর (সা.) নিজেও ছোট থেকে ছোট কাজ করেছেন। ছোট বেলায় ছাগল চরায়েছেন, যৌবনে ব্যবসা করেছেন। সাহাবায়েকেরাম (রা.) ও ছোট ছোট কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করেন নি। এ কারণে ইসলামে দৃষ্টিতে সব কাজই সম্মানের। ইসলাম সব ধরনের কাজকেই মর্যাদা দিতে আদেশ দিয়েছে। এক হাদিসে বিশ্বনবী (সা.) এরশাদ করেনঃ কিয়ামতের দিন আমি তিন শ্রেণির মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়াবো। তার মধ্যে একশ্রেণি হলো তারা, যারা তাদের শ্রমিকদেরকে কাজ সম্পন্ন করার পরও ন্যায্য পাওনা দেয় না (বুখারি)। আল­াহর রসূল (সা.)-এর স্পষ্ট হুকুম হলো, তোমরা শ্রমিকের মজুরি দিয়ে দাও তার গায়ের ঘাঁম শুকানোর আগেই (ইবনে মাজাহ)। আর আমাদের মালিকরা কি করেন? ন্যায্য মজুরি পেতেও শ্রমিকদের গলদঘর্ম হতে হয়।
সূরা আরাফে মহান আল­াহপাক মাদইয়ান বাসীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন; তোমরা মাপ ও ওজন পূর্ণ করো এবং মানুষকে তাদের দ্রব্যাদি কম দিয়ো না এবং ভ‚-পৃষ্ঠে সংস্কার সাধনের পর তাতে অনর্থ সৃষ্টি করো না। এটা হলো তোমাদের জন্য কল্যাণকর তোমরা বিশ্বাসী হও (সূরা আরাফ : ৮৫)। আর আমাদের উদ্দেশ্যে সারা জাহানের বাদশাহ মহান আল­াহ তায়ালা বলেনঃ যারা মাপে কম করে তাদের জন্য দূর্ভোগ; যারা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদেরকে মেপে দেয় কিংবা ওজন করে দেয়, তখন কম করে দেয়। তারা কি চিন্তা করেনা যে, তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে? সেই মহাদিবসে; যে দিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব পালনকর্তার সামনে (সূরা আত-তাতফীফ : ১-৬)। এই আয়াতগুলো থেকে তাফসিরবিশারদগণ এই ব্যাখা করেছেন যে, যারা কর্মচারী বা শ্রমিকদের কাছ থেকে কাজ বেশি নেয়, কিন্তু মজুরি দেবার সময় কম দেয় তারাও এই আয়াতে উলে­খিত ধমকির আওতায় আসবে। অর্থাৎ ওই সমস্ত মালিদেরকে আল­াহতায়ালা অত্যন্ত অপছন্দ করেন যারা তাদের অধীনস্থ কর্মচারী, শ্রমিক, বা কাজের লোকদেরকে তাদের ন্যায্য মজুরি দেয় না।
শুধু শ্রমিক নয়, আমাদের অধীনস্থ কাজের লোক, কাজের মেয়ে, কর্মচারী, খাদেম তাদের ব্যাপারেও ইসলাম আমাদের উত্তম ব্যবহার শিক্ষা দিয়েছে। মহানবীর (সা.) জীবনের শেষ কথা ছিল এরকম: নামাজ, নামাজ। আর তোমাদের অধীনস্থদের (চাকর-নকর, কর্মচারী, খাদেম, কাজের লোক ইত্যাদি) ব্যাপারে আল­াহকে ভয় করো (আবু দাউদ)। হযরত আনাস (রা.) বলেন, আমি আমার ৮ বছর বয়স থেকে দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ মহানবী (সা.)-এর খেদমত করেছি। এর মধ্যে আমি অনেক অন্যায় করেছি। কিন্তু দয়ার নবী কোন দিন এ কথা বলেননি, এ কাজ তুমি কেন করেছো অথবা একাজ তুমি কেন করোনি? এক ব্যক্তি আল­া’র রসুলের (স.) কাছে এসে অভিযোগ করলো, আমার খাদেম নানা রকম ভুল করে। আমি তাকে কতবার মাফ করবো? দয়ার নবী (সা.) উত্তরে বলেন, দিনে সত্তর বার। হযরত আবু মাসউদ (রা.) বলেন, একদা আমি আমার এক গোলামকে প্রহার করিতেছিলাম, এমন সময় আমার পিছন দিক থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম, হে আবু মাসউদ! নিশ্চয়ই তার ওপর তোমার যতোটুকু ক্ষমতা আছে আল­াহ তোমার ওপর তার চেয়েও অধিক ক্ষমতাবান। আমি ফিরে তাকায়ে দেখি রসূলুল­াহ (সা.) কথা বলছেন। বললাম, ইয়া রসূলুল­াহ (স.), আল­াহ’র ওয়াস্তে আমি তাকে আজাদ বা মুক্ত করে দিলাম। এতে রসূলুল­াহ (সা.) ফরমাইলেন: যদি তুমি এটা না করতে তাহলে দোজখ তোমাকে অবশ্যই স্পর্শ করতো অথবা দোজখ তোমাকে অবশ্যই গ্রাস করতো (বুখারি : আদাবুল মুফরাদ)।
আর এক হাদিসে মানবতার মূর্তপ্রতিক বিশ্বনবী (সা.) আদেশ করেনঃ তোমাদের অধীনস্থরা তোমাদের ভাই। আল­াহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করেছেন। অতএব যার অধীনে তার ভাই থাকবে তাকে তাই খাওয়াবে যা সে নিজে খায়; তাকে তাই পরিধান করাবে যা সে নিজে পরবে। অধীনস্থদের থেকে এমন কাজ নেবে না যা তাদের ওপর বোঝা হয়ে যায়। আর যদি এরুপ কাজ লও তবে তুমি তার কাজে সাহায্য করবে (বুখারি)। হযরত আম্মার ইবনে ইয়াছির (রা.) বর্ণনা করেন যে, রসূলুল­াহ (সা.) এরশাদ করেন: যে মালিক নিজের গোলামকে অন্যায়ভাবে মারপিট করবে, কিয়ামতের দিন তার হতে বদলা নেয়া হবে ( তাবারানী, মাজমায়ে যাওয়ায়েদ)। শ্রমিক বা কর্মচারীকে মারধরও করাও এই ধমকির অন্তর্ভুক্ত হবে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন যে, রসূলুল­াহ (সা.) এরশাদ করেন: যখন তোমাদের মধ্যে কারও খাদেম (কাজের লোক বা কাজের মেয়ে) তার জন্য রান্নার গরম ও ধোঁয়ার কষ্ট সহ্য করে তার জন্য খাবার তৈরি করে নিয়ে আসে, তখন মালিকের উচিত সে যেন এই খাদেমকে তার সাথে খানায় বসায় এবং সেও তার সাথে খায়। যদি সেই খানা কম হয় (যা দু’জনের জন্য যথেষ্ট হয় না), তবে মালিকের উচিত যেন খানা হতে দুই এক লোকমা হলেও খাদেমকে দিয়ে দেয় ( মুসলিম)। তাই আসুন আমরা শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা দিয়ে ইসলামের সুমহান আদর্শে উজ্জীবিত হই।
(লেখক : মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।)

্রিন্ট

আরও সংবদ

অন্যান্য

প্রায় ২০ দিন আগে