খুলনা | শনিবার | ২১ জুন ২০২৫ | ৭ আষাঢ় ১৪৩২

‘সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার মাধ্যমে গোলমাল লাগানোর ইন্ধন যোগাচ্ছে’

আবু সাঈদ মহাকাব্যের নায়ক, তাকে নিয়ে গল্প-কবিতা লেখা হবে : ড. ইউনূস

খবর প্রতিবেদন |
০১:০৯ এ.এম | ১১ অগাস্ট ২০২৪


‘আবু সাঈদের স্বপ্ন ছিল বড়, এজন্যই সে বুক পেতে দিয়েছে’ বলে উলে­¬খ করেছেন অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছাত্র-জনতাকে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহŸান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা । সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার মাধ্যমে কিছু লোক একটা গোলমাল লাগানোর জন্য ইন্ধন যোগাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
শনিবার দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সিন্ডিকেট রুমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী মতবিনিময়কালে তিনি এ কথা বলেন।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে ড. ইউনূস বলেন, তোমরাও আবু সাঈদের মতো বড় স্বপ্ন দেখো। তোমাদের যে ক্ষমতা সেটা অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বকে তোমরা পাল্টে দিতে পারো। তাই পিছু হটবে না। আমরা যেটা পারিনি তোমরা সেটা পেরেছো।
তিনি আরও বলেন, আমরা মহাকাব্য পড়ে থাকি। আবু সাঈদ হলো সেই মহাকাব্যের নায়ক। ভবিষ্যতে তাকে নিয়ে অনেক কবিতা, গল্প ও সাহিত্য লেখা হবে।
আবু সাঈদ বিশ্বকে চমকে দিয়েছেন উলে­খ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, তার গুলি খাওয়ার যে ছবি মানুষ দেখলো, এরপর মানুষকে আর থামানো যায়নি। তোমরা দ্বিতীয় বিজয় এনে দিয়েছ। দেশের মানুষ এ বিজয়ের সুফল ভোগ করবে। এটা যেন ব্যর্থ না হয়।
ড. ইউনূস শহীদ আবু সাঈদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি আবু সাঈদকে স্মরণ করছি, যার ছবি প্রত্যেক বাংলাদেশির হৃদয়ে খোদাই করা আছে। কেউ এটি ভুলতে পারে না, কী অবিশ্বাস্য সাহসী যুবক ছিলেন তিনি! তিনি বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে যান এবং তারপর থেকে আন্দোলনরত তরুণ-তরুণীরা হার মানেননি। সামনে এগিয়ে গেছেন এবং বলেছেন, “যত গুলি মারতে পারো মারো, আমরা এখানে আছি”।’
আবু সাঈদের কবরের বাঁশের বেড়া ছুঁয়ে বক্তব্য দেওয়ার সময় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আবু সাঈদ এই কবরে শুয়ে আছেন। আজকে আমরা তার জন্য নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। এদেশ সাধারণ মানুষের বাংলাদেশ। এখন আবু সাঈদ এক পরিবারের সন্তান না, সারা বাংলাদেশের সন্তান। এখন বাংলাদেশের যত সন্তান সবাই আবু সাঈদের বীরত্বগাঁথা, বুক পেতে দেওয়ার দৃশ্য দেখেছে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা যখন স্কুলের পাঠ্য বইয়ে সাঈদের বীরত্বগাঁথা গল্প পড়বে তখন তারাও বলবে, “আমিও ন্যায়ের জন্য লড়বো। আমিও বুক পেতে দেবো।” সেই হলো আবু সাঈদ যে দেশের নতুন স্বাধীনতার জন্য নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন। সবার প্রতি অনুরোধ, আবু সাঈদ যে স্বপ্ন দেখেছিলেন আমরা যেন তা বাস্তবায়ন করতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘এখন আবু সাঈদ শুধু একটি পরিবারের নয়, সারা বাংলাদেশের সন্তান। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার সন্তান-হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সবার। কাজেই আপনারা খেয়াল রাখবেন কোথাও যেন কোনও গোলমাল না হয়। কেউ যেন ধর্ম নিয়ে কথা না বলে। আমরা সবাই এ মাটিরই সন্তান। সবার দায়িত্ব সমাজে বিশৃঙ্খলা দূর করা। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে আবু সাঈদ যেমন দাঁড়িয়েছেন, আমাদেরও তেমনিভাবে দাঁড়াতে হবে।’
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পত্র-পত্রিকায় আসতেছে, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হইতেছে। কী জন্য তাদের নিয়ে টানাটানি করতেছে, তারা কি এ দেশের মানুষ না? তোমরা (শিক্ষার্থী) দেশ রক্ষা করতে পেরেছ, কয়েকটা (সংখ্যালঘু) পরিবার রক্ষা করতে পারবা না!’
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনার সমালোচনা করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, কষ্ট লাগে সেও তোমাদের সঙ্গে ছিল, তার ছেলে তোমাদের সঙ্গে ছিল। কিন্তু বাড়ি গিয়ে দেখে তার বাড়ি লুটপাট হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, লুটপাট কারা করতেছে? কিছু ইচ্ছে করে, আর হলো অন্যের মদদে; যারা ইন্ধন যোগাইতেছে একটা গোলমাল লাগায়ে দেওয়া। গোলমাল লাগাতে পারলে তাদের খুব মজা। সব সময় লেগে আছে তোমাদের আটকানোর জন্য। বলবা কেউ ছুঁতে (সংখ্যালঘুদের স্পর্শ) পারবা না, আমরা আছি।
বাংলাদেশের সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির কথা উলে¬খ করে ড. ইউনূস বলেন, হিন্দু পরিবার, খ্রিস্টান পরিবার, বৌদ্ধ পরিবার যত আছে বলবা, কেউ তাদের ক্ষতি করতে পারবা না। তারা আমার ভাই, আমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি, একসঙ্গে থাকব। পুরো বাংলাদেশ একটা পরিবারের মতো। এর চেয়ে সুন্দর পরিবার আর নাই কিন্তু। পৃথিবীতে বহু দেশ আছে, এত সুন্দর পরিবার আর নাই।
এরপর তিনি শিক্ষার্থীদের উত্থাপিত বিভিন্ন দাবি শোনেন এবং সেগুলো পূরণের আশ্বাস দেন। পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত রোগীদের দেখতে যান তিনি।
এর আগে সকাল ১০টা ৪২ মিনিটে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস রংপুরের পীরগঞ্জের মেরিন একাডেমিতে পৌঁছান। এরপর তিনি শহিদ আবু সাঈদের বাড়ি উপজেলার জাফরপাড়া গ্রামে অভিমুখে সড়কপথে রওয়ানা হন। সেখানে পৌঁছে ১১টা ৫ মিনিটে ড. মুহাম্মদ ইউনূস আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করেন। ছাত্র শহিদ আবু সাঈদের বাড়িতে গিয়ে তার বাবা-মাকে সান্ত্বনা দেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা মোঃ নাহিদ ইসলাম এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। এছাড়াও রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার জাকির হোসেন, ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, জেলা প্রশাসক মোবাশ্বের হাসান  বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আখতার হোসেন, সমন্বয়ক সারজিস আলমসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। 
পরে ড. ইউনূস শহিদ আবু সাঈদের বাসায় গেলে তার বাবা মকবুল হোসেন ও মা মনোয়ারা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন। মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলেকে পুলিশ পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে।’ তিনি ছেলে হত্যার বিচার দাবি করেন।
এ সময় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অশ্র“সিক্ত আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন হু হু করে কাঁদতে থাকেন। আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম এবং পরিবারের অন্য সদস্যরাও এ সময় অশ্র“সজল ছিলেন। এমন হৃদয়বিদারক পরিবেশে চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি অন্যরাও।  প্রধান উপদেষ্টা শোকসন্তপ্ত আবু সাঈদের পরিবারকে সান্ত্বনা দেন। একই সঙ্গে আবু সাঈদের পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন।
সেখানে আবু সাঈদের বাবা-মা এবং পরিবারের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টাকে আবু সাঈদকে নিয়ে তাদের স্মৃতি ও আকাঙ্ক্ষার জানান। আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম তার ছেলেকে হারানোর কথা তুলে ধরেন। পরে আবু সাঈদের বাবা-মা, পরিবারের সদস্য এবং অন্তর্বতী সরকারের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে নিয়ে জাতীয় পতাকা মেলে ধরেন ড. ইউনূস।
প্রসঙ্গত, বেরোবির ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ আন্দোলনের সময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। তিনি বেরোবিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন। গত ১৬ জুলাই আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি। পরদিন পীরগঞ্জ উপজেলায় তাকে দাফন করা হয়। ওই গুলির ভিডিও দেশ-বিদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়।

্রিন্ট

আরও সংবদ