খুলনা | রবিবার | ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

খুলনায় এজাহারে অনেক নিরীহ ব্যক্তি রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী : মামলার নেপথ্যে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, ভীতি ছড়ানো চাঁদাবাজি পারিবারিক ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব

নিজ অর্থে নির্মিত ওয়ার্ড অফিস ভাঙচুরে বিএনপি নেতা মিঠু আসামি!

নিজস্ব প্রতিবেদক |
০১:২৭ এ.এম | ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪


নিজ অর্থে নির্মিত দলীয় কার্যালয় ভাঙচুরে অভিযুক্ত করা হয়েছে খালিশপুর থানা বিএনপি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান মিঠুকে। অন্যদিকে দিঘলিয়া উপজেলার আয়তুননেছা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মারুফাতুল মতিন। ভালো শিক্ষিকা হিসেবে এলাকার সবার সম্মানের পাত্র তিনি। গত ২৯ আগস্ট দিঘলিয়া থানায় এক বিএনপি নেতার ওপর হামলার ঘটনায় হওয়া মামলায় ৬১ নম্বর আসামি করা হয়েছে তাঁকে। আবার হ্যামকো গ্র“পের পরিচালক আবদুল­¬াহ আল মাহমুদকে আসামি করা হয়েছে গত ২৯ আগস্ট খালিশপুর থানা বিএনপি’র কার্যালয় ভাঙচুরের মামলায়। অথচ আল মাহমুদসহ তাঁর পরিবারটির কেউই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নন। একই মামলায় আসামি করা হয়েছে খুলনা চেম্বারের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শরীফ আতিয়ার রহমান ও পরিচালক শাহ আলম তুহিনকে। 
শুধু এ দু’টিই নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে খুলনায় বিএনপি নেতাদের করা মামলাগুলোতে অনেক নিরীহ ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীকে আসামি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। 
স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রতিটি মামলার বাদী বিএনপি’র স্থানীয় নেতারা। এর মধ্যে অধিকাংশ বাদীই অনেক আসামিকে চেনেন না বা নামও জানেন না। তাদের মামলার এজাহার তৈরি করে দিচ্ছেন বিএনপি’র মহানগর ও থানা কমিটির দু-একজন নেতা। এসব মামলার পেছনে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, অন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভীতি ছড়ানো, চাঁদাবাজি এবং পারিবারিক ও ব্যক্তিগত দ্ব›দ্ব ভূমিকা রাখছে। ফলে এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ছে সব মহলে।
গত ২৯ জুলাই দিঘলিয়া থানায় হওয়া মামলার বাদী জেলা বিএনপি’র যুগ্ম-আহŸায়ক মোল­¬া খায়রুল ইসলাম। ২০২২ সালের ২৫ আগস্ট দিঘলিয়ায় তাঁকে কুপিয়ে জখম করা হয়। মামলায় আসামিদের মধ্যে ৬১ নম্বরে রয়েছেন আয়তুন্নেসা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মারুফাতুল মতিন। তিনি বলেন, চাকুরিজীবনে তো নয়ই, ছাত্র জীবনেও আমি কখনও রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম না। কেন আসামি করা হলো, বুঝতে পারছি না। 
এ প্রসঙ্গে বাদী মোল্লা খায়রুল ইসলামকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি মামলার বিষয়ে দিঘলিয়া উপজেলা বিএনপি’র আহŸায়ক সাইফুর রহমান মিন্টুর সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ জানান।
খালিশপুর থানায় দায়ের করা মামলার বাদী মহানগর বিএনপি’র সদস্য শাহিনুল ইসলাম পাখি। এজাহারে গত ৪ আগস্ট খালিশপুর থানা বিএনপি কার্যালয় ভাঙচুর, লুটপাটের অভিযোগের মামলায় আসামি হয়েছেন একজন শিল্পপতি ও দুই বড় ব্যবসায়ী। এই মামলার বিষয়েও বাদী কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
তবে অনুসন্ধান বলছে, হ্যামকো গ্র“পের প্যাকেজিং কারখানার উচ্ছিষ্টাংশের ব্যবসা ছিল ১৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি মোরশেদ আহমেদ মনির নিয়ন্ত্রণে। ৫ আগস্টের পর এই উচ্ছিষ্টাশের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে তৎপর বিএনপি’র কয়েকটি গ্র“প। হ্যামকো গ্র“পের কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবিরও ঘটনা ঘটেছে।
কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, খুলনাসহ সারাদেশের মানুষ হ্যামকো গ্র“পের পরিচালকদের সম্পর্কে জানেন। তারা কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। গত ২০-২৫ দিনে অনেক ঘটনা ঘটছে। এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না।
মামলার ১২৪ নম্বর আসামি শরীফ আতিয়ার রহমান খুলনা চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র সহ-সভাপতি। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তিনি আওয়ামী লীগ নেতা কাজী আমিনুল হকের নেতৃত্বাধীন চেম্বার অব কমার্সে যোগ দেন। কাজী আমিন বিদেশে থাকায় বর্তমানে তিনি ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। স¤প্রতি চেম্বারের দখল নিতে নানা তৎপরতা শুরু করেছেন বিএনপি নেতারা।
১৩৭ নম্বর আসামি নৌপরিবহন ব্যবসায় পরিচিত মুখ শাহ আলম তুহিন। চেম্বার অব কমার্স ছাড়াও তিনি অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মালিক গ্র“পের পরিচালক। সম্প্রতি গ্রুপের নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি যাতে নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে না পারেন এবং অন্য ব্যবসায়ীরা যাতে ভয় পান, এ জন্য তাঁকে আসামি করা হয়েছে বলে ব্যবসায়ীদের একাংশের ধারণা।
এ মামলার ১৪৬ নম্বর আসামি আরিফুর রহমান মিঠু খুলনা মহানগর বিএনপি’র সাবেক কোষাধ্যক্ষ ও দলের খালিশপুর থানার সাধারণ সম্পাদক। নগর বিএনপি’র বর্তমান আহবায়ক কমিটিতে ত্যাগী নেতাদের বাদ দেওয়ার প্রতিবাদ এবং নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে অব্যাহতি দেওয়ায় পদত্যাগ করেছিলেন তিনি। তবে নানা কর্মসূচিতে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় ছিলেন। মিঠু বলেন, আমার টাকায় খালিশপুর বিএনপি অফিস নতুন ভাবে তৈরি করেছি। সেই অফিস ভাঙার আসামি করা হলো আমাকে! তিনি আরও বলেন, আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখলের জন্য দলের অভ্যন্তরে ঘাপতি মেরে থাকা একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। যাতে আমি দলীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করতে না পারি।  
এ বিষয়ে খুলনা মহানগর বিএনপি’র সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন বলেন, যারা আওয়ামী লীগ করে এবং তাদের দোসরদের বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে। কাউকে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে মামলার আসামি করা হয়নি।
খুলনা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি কুদরত ই খুদা বলেন, এত রক্ত, এত মৃত্যুর পরও রাজনৈতিক দলগুলোর চরিত্রের পরিবর্তন হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত, নিরীহ মানুষ যাতে হয়রানি না হয়, তার পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
মামলার বিষয়ে খালিশপুর থানার ওসি (তদন্ত) আশীষ কুমার মৈত্র বলেন, নিরীহ কেউ থাকলে তদন্তে অবশ্যই তার নাম বাদ যাবে। কাউকে অযথা হয়রানি করা হবে না। প্রকৃত আসামিদের আইনের আওতায় আনা হবে।

্রিন্ট

আরও সংবদ