খুলনা | রবিবার | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৩১ ভাদ্র ১৪৩১

গণঅভ্যুত্থানের এক মাস অতিবাহিত

গণহত্যার বিচারের দাবি খুলনার শিক্ষার্থীদের

এন আই রকি |
০১:২৫ এ.এম | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪


৪ জুলাই থেকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) শিক্ষার্থীরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সারাদেশের সাথে সংহতি প্রকাশ করে মাঠে নেমে পড়ে। এরপর ধীরে ধীরে কুয়েট, খুকৃবি, বিএল কলেজসসহ অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যোগ দেয়। গেল ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর স্বৈরাচারী সরকারের পতনের মাধ্যমে নতুন করে স্বাধীনতা পায় শিক্ষার্থীরা। তবে দীর্ঘ এই সময়টা ছিল বেশ কঠিন। 
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন সময়ে নগরীর শিববাড়ি মোড়, নতুন রাস্তা মোড়, জিরোপয়েন্ট, সাচিয়াবুনিয়াসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অংশ নেয় শিক্ষার্থীরা। এ সময় রাজনৈতিক দল এবং পুলিশের নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। তবুও তারা দমেনি। পুলিশের লাঠি চার্জ, টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট, গুলির সরারা কোন কিছুই দমাতে পারিনি শিক্ষার্থীদের। রাতের পর রাত পালিয়ে এবং কারফিউ ভঙ্গ করেও তারা আন্দোলন করেছে।
তবে ২ আগস্ট খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীদের ওপর যে বর্বর হামলা পুলিশ চালিয়েছে সেটা কখনও ভোলার নয় শিক্ষার্থীদের। ঐই দিনে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালাতে চালাতে তাদের রিজার্ভ শেষ করে ফেলে। শত শত শিক্ষার্থী সেদিন আহত হয়। মারা যায় এক পুলিশ সদস্য। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনেই শিক্ষার্থীদের বুকে গুলি করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি কালো দিন ছিল এটা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে  শিক্ষার্থীদের  দাবি, দেশটাকে সংস্কার করে একটি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। এছাড়া পুলিশ যেন কোন রাজনৈতিক দল বা কোন সরকারের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত না হয় সেই ব্যবস্থা এবং আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে গণহত্যা হয়েছে তার বিচার দ্রুত সময়ে করা হোক।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিনের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাজ্জাদুল ইসলাম আজাদ জানান, ৪ জুলাই থেকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সক্রিয়ভাবে মাঠে নামে। তখন শুধুমাত্র আমরাই ছিলাম। পরবর্তীতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়। শিববাড়ি মোড়, সাচিবুনিয়া, জিরোপয়েন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থান নিয়েছিলাম। আন্দোলন তীব্র হওয়ার পর প্রশাসনিক, রাজনৈতিকভাবে আমাদের সকলের কাছে হুমকি আসতে থাকে। ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলন সহিংসুতার রূপ নেয়। ছাত্রলীগের ক্যাডাররা ও পুলিশের অতি উৎসাহী এবং দলীয় করণের ওপর হামলা করে। আবু সাইদ ভাইকে কিভাবে গুলি করে দেখেছেন। 
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি গেটে পুলিশ ও বিজিবির অবস্থান ছিল। কাউকে প্রবেশ বা বের করতে দিতো না। প্রশাসনের ওপর তীব্র চাপের ফলে আমাদের হল ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়। হল রোডের প্রতিটি বাসায় পুলিশ চিরুনি অভিযান চালায়। প্রচন্ড হয়রানি করে পুলিশ। এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ জনকে তুলে নেওয়া হয় সার্কিট হাউজে। সেখানে জোরপূর্বক আ’লীগের ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হুমকি দেয়। পরিবারের ওপরও হুমকি দেওয়া হয়। গোয়েন্দা সংস্থার লোকও আমাদের মনিটরিং করছিল। এতকিছুর পরও আন্দোলন আরও গতি পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও আমাদের পাশে ছিলেন। ২ আগস্ট খুলনায় পুলিশের প্রাণহানি সরকার ও পুলিশের ব্যর্থতার কারণে হয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার সেল গুলি করতে করতে শেষ হয়ে যায়। এরপর শিক্ষার্থীরা তাদের ধাওয়া দেয়। অবস্থা এমন হয়েছিল মসজিদে মাইকিং করে আমরা এলাকাবাসীর কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি কালো দিন ২ আগস্ট। এটা প্রশাসনের সাথে কথা বলে দিনটিকে আলাদা মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করবো। সরকারের কাছে প্রত্যাশা জনগণের সরকার এবং বিপ্লবের সরকার একটি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেব। 
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের ১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল আলম বাবু বলেন, চাকুরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আমার প্রথম থেকেই সমর্থন ছিল। এরপর ১৫ জুলাই  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সরকারের ছাত্র সংগঠনের ঘটনা আমাকে নাড়া দিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ঘটনাও ছাড়িয়েছিল। এরপর খুলনার শিববাড়ি জিরোপয়েন্ট সাচিবুনিয়া সবক্ষেত্রে ছিলাম। ১৮ জুলাই পর্যন্ত সহিংসতা ছাড়াই আন্দোলন করেছি। সরকারি দলের সংগঠনের লোকজনও উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করেছি। সাইদ হত্যা এবং কারফিউ জারি করার পর সমস্যার সৃষ্টি হয়। পুলিশের আতঙ্কে ছিলাম। খুবির প্রশাসন তখন সাপোর্ট দেয়নি। তারা আমাদের বাড়ি চলে যেতে বলেছিল। এমন হয়েছে কক্ষের ভিতর আলো জ্বালাতে পারিনি। অন্ধকারে ভাত খেয়েছি। বাড়িওয়ালা বাইরে থেকে তালা মেরে দিয়েছিল। ২ আগস্ট খুলনায় মিছিলে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কথা বলার জন্য কাছে ডেকেই টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট মারে। শত শত শিক্ষার্থী আহত হয়। আহত কয়েক জনকে নিয়ে রাইসা ক্লিনিকে চিকিৎসার জন্য গেলে সেখানেও টিয়ার গ্যাস মারে পুলিশ। পুলিশ লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। পুলিশের সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে। পুলিশ যেন কোন রাজনৈতিক দল বা কোন সরকারের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত না হয় সেই প্রত্যাশা নতুন সরকারের কাছে। পুলিশের সংস্কার চাই। এই গণহত্যার বিচার দ্রুত সময়ে করা হোক এই দাবি এই সরকারের কাছে। 
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী ডিসিপ্লিনের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আইমান আহাদ জানান, ৩০ জুলাই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল রোডের একটি বাসায় খুলনার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ডাকি। এরপরই আমরা পুলিশের বাধার সম্মুখীন হই। এরপর ৩১ জুলাই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বদ্ধভূমিতে আবারও মিটিং ডাকি। ঐ সময় পুলিশ আমাদের ধাওয়া দেয়। এসময় নারী শিক্ষার্থীও আহত হয়। পুলিশ ও ডিবিসহ খুলনার রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ আমাদের ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে আমাদের জীবন নাশের হুমকিও দেওয়া হয়। তিনি পুলিশের এই লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতিকে পা চাটা রাজনীতির সাথে তুলনা করেন। আমি মাঝ রাতেও বাসা পরিবর্তন করেছি। আমাদের আন্দোলনের সকলের সমর্থন ছিল। এই বিজয় সকলের। এই বিজয় অক্ষুণœ রাখার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। সরকারের কাছে দাবি দেশটাকে একটি জায়গা নিয়ে এসে নির্বাচন দিবে। তার আগে দেশটাকে সংস্কার করা দরকার। আমি ৫২, ৭১ দেখিনি। তবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের হামলা নির্যাতন দেখেছি। আমি এখনও মেন্টাল ট্রমায় আছি। সেই অধ্যায়টি আমাকে এখনও পীড়া দেয়। আমি প্রায় মিছিলের আওয়াজ শুনতে পাই। শুনতে পাই টিয়ার সেল ও ধমকানির চিত্র।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ডিসিপ্লিনের ২১ ব্যাচের শিক্ষার্থী নুরুজ্জামান নাবিল বলেন, আমাদের ভাইদের যেভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। শিক্ষার্থী হিসাবে ঘরে বসে থাকার মত ছিল না সেই দিনগুলো। ২ আগস্ট খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গুন্ডা পুলিশ বাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ চালায়। টিয়ার গ্যাস ও মর্টার গ্যাসের পাশাপাশি রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় চারদিকে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আমি সামনে দিকে এগিয়ে যেতে দেখি সামনে ৩০ জন পুলিশ ও বিজিবি ছিল। পুলিশ একটানা রাবার বুলেট ও সরারা নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় গেটে বুকের বাঁ পাশে রাবার বুলেট লাগে। এটা লাগার পর আমি ভীত না হয়ে আরও সাহসী হয়ে উঠলাম। হাতে কিছু ইট এবং স্লোগান দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। এরপর আমার বুক, গলা, কপাল এবং ব্র“তে অসংখ্য ছররা লাগে। এক পর্যায়ে আমার সাথে এক ভাইয়ের চোখে আঘাত লাগে। তাকে নিয়ে পিছনে সরে আসতে থাকি। সেখানে হঠাৎ করে এক লোক টিনের দড়ি খুলে আমাদের ভিতরে নিয়ে যায়। এরপর সেই ভাইকে নিয়ে খুলনা মেডিকেলে যায়। এরপর রাতে আমি সররা চেপে চেপে বের করি। পুলিশের টহল থাকায় বাসায় থাকতে পারিনি। বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে ছিলাম। বর্তমান সরকারের কাছে দাবি, আমাদের একটা ন্যায়ের রাষ্ট্র ফিরিয়ে দিক। এমন একটা বাংলাদেশ দেখতে চাই যে দেশের প্রতিটি মানুষের মুখে হাসি থাকবে। প্রতিটি মানুষ ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবে।  

্রিন্ট

আরও সংবদ