খুলনা | রবিবার | ০৬ জুলাই ২০২৫ | ২১ আষাঢ় ১৪৩২

অহঙ্কার

ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন |
০১:১০ এ.এম | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১

একবারের ঘটনা, সাহাবী হযরত আবূ যর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে এক ব্যক্তির সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়ে গেল। ক্রোধের আতিশয্যে আমি তাকে বলে বসলাম, হে কৃষ্ণকায় নারীর সন্তান! আমার একথা শুনে, রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, হে আবূ যর! ‘উভয় পাল­া সমান। কৃষ্ণকায় নারীর সন্তানের উপর শ্বেতকায় নারীর সন্তানের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ আবূ যর রাযিয়াল­াহু আনহু বলেন, একথা শুনে আমি মাটিতে শুয়ে পড়লাম এবং লোকটিকে বললাম, তুমি আমার গন্ডদেশকে পদতলে পিষ্ট কর। অন্যের চাইতে নিজেকে বড় মনে করাই অহঙ্কার।
শরী’আতের পরিভাষায় অহঙ্কার হচ্ছে, হককে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা এবং কোনো বিষয়ে নিজেকে বড় মনে করে অন্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করা।
হককে প্রত্যাখ্যান করা অর্থ হককে অস্বীকার করা, হককে কবুল না করে তার প্রতি অবজ্ঞা করা এবং হক কবুল করা হতে বিরত থাকা।
মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা অর্থ মানুষকে নিকৃষ্ট মনে করা, অবজ্ঞা করা, তুচ্ছ মনে করা ও মানুষকে ঘৃণা করা। মানুষের গুণের থেকে নিজের গুণকে বড় মনে করা। কারো কোনো কর্মকে স্বীকৃতি না দেওয়া, কোনো ভালো গুণকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা না থাকা। অন্যদের সালাম না দেওয়া, কারো উপদেশ গ্রহণ না করা। নিজেকে অন্যের অপেক্ষা জ্ঞানী মনে করা। গরীব, মিসকিন, অসহায় ও দুর্বল লোকদের সাথে উঠা বসা করাকে ঘৃণার চোখে দেখা এবং তাদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ, উপহাস এবং তিরস্কার করা। অন্যদের দোষ প্রকাশ ও তাদের দুর্বলতা বর্ণনা করা তথা চোগলখোরি ও গীবত করা। নিজেকে নির্দোষ, নিরপরাধ ও কামেল ব্যক্তি মনেকরে নিকৃষ্ট ও দোষণীয় কাজের ওপর অটুট থাকা এবং কারো উপদেশ গ্রহণ না করা। হাঁটার সময় তার সামনে কেউ হাঁটুক তা পছন্দ না করা, নিজেই আগে আগে হাঁটতে পছন্দ করা। অপরের দাঁড়িয়ে সম্মান করাকে পছন্দ করা।
ড. মুশফিক আহমেদ রহমাতুল­াহি আলাইহি বলতেন, অহঙ্কারের মেজাজ হল, নিজেকে উপরে উঠানো এবং অন্যকে নীচে নামানো, অন্যকে নিজের থাবার মধ্যে আনা। যেমন বিড়াল যদি ইদুরকে পায় থাবা দিয়ে আহত করে এবং ছেড়ে দেয়। ইদুর আহত অবস্থায় আস্তে আস্তে গর্তের দিকে চলে। ঠিক গর্তে পৌঁছার পূর্ব মুহূর্তে বিড়াল আবার ইদুরকে ধরে এবং আছাড় দেয়। আগে ধরে না। সে মজা দেখে। ঠিক গর্তে ঢোকার পূর্ব মুহূর্তে ধরে। এটার মধ্যে সে আনন্দ পায়। অহঙ্কারের মেজাজ ঠিক এ ধরনের। অন্যকে আঘাত করবে, অন্যকে অধিনস্থ রাখবে, নিজেকে উপরে উঠাবে, আর এটা দেখে সে আনন্দ পাবে।(মোজাকারা হতে)
অভিশপ্ত ইবলিসের কুফরী করা ও আল­াহর আদেশের অবাধ্য হওয়ার একমাত্র কারণই ছিল তার অহঙ্কার। সৃষ্টিজগতের প্রথম মানব আমাদের পিতা আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করার পর আল­াহ তা’য়ালা ফেরেশতাদের আদেশ করেছিলেন-তোমরা আদমকে সিজদা কর। সকল ফেরেশতা সিজদায় লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু ফেরেশতাদের মাঝে বেড়ে ওঠা শয়তান মাটি আর আগুনের যুক্তি হাজির করল। সে আগুনের তৈরি বলে মাটির তৈরি মানুষকে সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানাল। কুরআনের ভাষায়: সে অস্বীকৃতি জানাল এবং অহঙ্কার করল। আর সে ছিল কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত।(সূরা বাকারা : ৩৪)
মহান আল­াহ তা’য়ালা যদি ইবলিসকে বলতেন, আমাকে ১শ’ সিজদা কর, তাহলে ইবলিস ১শ’ কেন ১ লক্ষ সিজদা করত। কিন্তু ইবলিস নিজেকে বড় মনে করল। সে অহঙ্কার করল যে, সে আদমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
যখন কোনো মানুষের অন্তরে অহঙ্কার ও বড়াই এর অনুপ্রবেশ ঘটে, তখন তা তার জ্ঞান, বুদ্ধির ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে এবং তাকে নানাবিধ প্রলোভন ও প্ররোচনার মাধ্যমে বাধ্য করে সত্যকে অস্বীকার ও বাস্তবতাকে প্রত্যাখ্যান করতে। অহঙ্কারী ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন হতে বঞ্চিত হয়। অহঙ্কারী ব্যক্তি কখনো কারো উপদেশ গ্রহণ করে না। সে মনে করে আমিতো কামিল ব্যক্তি আমার থেকে বড় আর কে হতে পারে? যে আমাকে উপদেশ দিবে। এছাড়াও সে কিভাবে মানুষের উপদেশ গ্রহণ করবে? সে নিজেই মানুষকে উপদেশ দিয়ে বেড়ায়। যে ব্যক্তি অহঙ্কার করতে চায় ও বড়ত্ব দেখাতে চায় আল­াহ তাকে নীচে ছুঁড়ে ফেলে দেন ও বেইজ্জত করেন। অহঙ্কারীর নাম জাব্বারিনদের খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়। সর্বপরি অহঙ্কারীর আবাসস্থল হবে জাহান্নাম। রসূলে কারীম সল­াল­াহু আ’লাইহি ওয়া সাল­াম বলেছেন, ‘যার অন্তরে সরিষার দানা (অর্থাৎ সামান্য তম) পরিমাণও অহঙ্কার আছে, সে (প্রথম পর্যায়েই) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না এবং যার অন্তরে সরিষার দানা (সামান্যতম) পরিমাণ ঈমান আছে সে জাহান্নামে (স্থায়ীভাবে) প্রবেশ করবে না।’(মুসলিম)
অহঙ্কার ও বড়াই মানবাত্মার জন্য খুবই ক্ষতিকর ও মারাত্মক ব্যাধী, যা একজন মানুষকে হেদায়াত ও সত্যের পথ থেকে দূরে সরিয়ে ভ্রষ্টতা ও গোমরাহির পথের দিকে নিয়ে যায়। ইসলামে অহঙ্কারকে হারাম করা হয়েছে। এজন্য আমাদের সকলেরই উচিৎ এই ব্যাধীর চিকিৎসায় সচেষ্ট হওয়া।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ। মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের অহঙ্কার হতে বেঁচে বিনয়ী হওয়ার তৌফিক দান করুন।(আমিন)
লেখক : বয়োকেমিস্ট, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রনালয়, খুলনা।

্রিন্ট

আরও সংবদ

অন্যান্য

প্রায় ১৩ দিন আগে