খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

মহানবীর (সাঃ) সর্বোত্তম আদর্শের বাস্তবায়নই হোক সীরাতুন্নবীর শিক্ষা

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী |
০১:৫৯ এ.এম | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪


ঈদ অর্থ আনন্দ; আর মিলাদুন্নবী অর্থ নবীর জন্ম। নবীর জন্ম উপলক্ষে যে আনন্দ কর্মসূচি তাকেই বলা হয় ঈদে-মিলাদুন্নবী। পৃৃথিবীতে সুমহান আদর্শ ও উন্নত আখলাক প্রতিষ্ঠা করার জন্যই আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ইংরেজী ৫৭০ সনে এবং আরবী ক্যালেন্ডারের তৃতীয় মাস রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার মহানবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহিস সালাম জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন আদর্শের বিশ্বকোষ, সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। স্বয়ং আল্লাহতায়ালা তার প্রশংসায় বলেছেন, নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী (সূরা কলম: ৪)। নিশ্চয়ই আল্লাহর রসুলের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ (সুরা আহজাব: ২১)। আমাদের দেশে ১২ রবিউল আওয়াল ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা হয়। মহানবী (সাঃ)-এর সুন্নত ও মহব্বত সাহাবায়ে কেরামের অস্থি-মজ্জা ও অন্তরে বদ্ধমূল ছিলো। যার কারণে রসুলের জন্ম দিনকে কেন্দ্র করে একটি বিশেষ দিবসে কোন কর্মসূচির আয়োজন করার প্রয়োজন ছিল না। তারা সারা বছরই নবীর প্রশংসা করতেন এবং তার ও তার পরিবারের ওপর দরুদ ও সম্মান জানানোকে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ও বরকতের ওসিলা হিসেবে মনে করতেন। কিন্তু আজ আমরা তার মহান জীবনীর আলোচনা থেকে অনেক গাফেল। এই কারণে মহানবীর সীরাত বা জীবনী নিয়ে আলোচনা সময়ের দাবি। তাছাড়া নবীর সীরাতের জ্ঞান ছাড়া পবিত্র কুরআন শরীফের প্রকৃত মর্মও আমরা বুঝতে পারব না। কারণ তিনিই হলেন জীবন্ত কুরআন। মহানবীর চরিত্র ও আদর্শের কথা লিখে কখনও শেষ করা যাবে না। তিনি যেন এক ‘জীবন্ত আদর্শকোষ’। শুধুমাত্র মিষ্টি খাওয়া, র‌্যালী-করা, আর একটি নির্দিষ্ট দিনে আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে সারাবছরই মহান নবীর মহান আদর্শের আলোচনা অব্যাহত রাখা দরকার। আল্লাহর রসুল মুহাম্মদ (সাঃ) একই সঙ্গে আদর্শ শিক্ষক, আদর্শ পিতা, আদর্শ স্বামী, আদর্শ সমাজ সংস্কারক, আদর্শ রাষ্ট্র নায়ক। এক কথায়, সর্ব দিক দিয়েই আদর্শ। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকল মানুষের শান্তি, নিরাপত্তা ও সুন্দরভাবে বাঁচার নিশ্চয়তা বিধান করেছেন। কোন আদর্শ নেই তার মধ্যে? 
সবার জন্য কল্যাণকামী: তিনি কোন মানুষের কখনই অকল্যাণ চাইতেন না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্যই তিনি কল্যাণ কামনা করতেন। পৃথিবীর সকলেই মহান আল্লাহর বান্দা। তিনি চাইতেন সবাই আল্লাহকে চিনুক, তার কথা মেনে চলুক এবং পরকালের চিরস্থায়ী সফলতা হাসিল করুক। এই জন্যই তিনি সবসময় পেরেশান থাকতেন।  
গরীবের বন্ধু: কিভাবে গরীব মানুষের মুখে হাসি ফোটানো যায় এই জন্য সর্বদা ব্যতিব্যস্ত থাকতেন। তিনি তাদেরকে খুব ভালোবাসতেন এবং সাহাবাদেরকেও ভালোবাসা ও দয়ার হাত প্রসারিত করার জন্য উৎসাহ প্রদান করে বলতেন, যদি কোন ব্যক্তি কোন বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান করে আল­াহ তায়ালা তাকে জান্নাতের সবুজ বস্ত্র পরিধান করাবেন। যদি কেউ কোন ক্ষুধার্তকে খানা খাওয়ায় আল­াহপাক তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। আর যদি কেউ কোন  পিপাসিতকে পানি পান করায় মহান আল­াহপাক তাকে জান্নাতের মোহরযুক্ত পানীয় পান করাবেন (আবু দাউদ, তিরমিজী)। আর এক হাদিসে নবীজি (সাঃ) এরশাদ করেন আমি ও এতিমের তত্ত¡াবধানকারী জান্নাতে এভাবে (পাশাপাশি) থাকবো। এ কথা বলার সময় তিনি তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল মিলিয়ে ইশারা করে দেখান (বুখারী : ৫৫৭৯)। 
ক্ষমা ও মহানুভবতা: প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা ও সুযোগ থাকা সত্তে¡ও তিনি চরম শত্র“কেও ক্ষমা করে দিতেন। মক্কার কাফির, মুশরিকরা হুজুরকে (সাঃ) প্রাণে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছে, অত্যাচারের স্টীম-রোলার চালিয়ে তার উপর। তার পরও তিনি মক্কা বিজয়ের দিনে ঘোষণা করলেন, ‘আজ তোমরা মুক্ত!’ বিনা রক্তপাতের এমন বিজয়, আর বিজয়ের পরে সাধারণ ক্ষমার এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবী কি কখনও দেখেছে? 
বিনয় ও নম্রতা: আল্লাহর নবী (সাঃ) ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্র। তিনি সাহাবায়ে কেরামকেও (রাঃ) মানুষের প্রতি নম্র আচরণের উপদেশ দিয়ে বলতেন, তোমরা নম্র ব্যবহার করো এবং কঠোর ব্যবহার করো না। মানুষকে শান্তি দাও এবং মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করো না (বুখারি: ৫৬৯৪)। 
নিরহঙ্কার ও অনাড়ম্বতা: সুলের ভিতরে (সাঃ) অহঙ্কারের লেশ মাত্র ছিল না। তিনি সবার আগে মানুষকে সালাম দিতেন এবং বলতেন, যে আগে সালাম দেয় সে অহঙ্কার মুক্ত। সৃষ্টির সেরা মানুষ হয়েও তিনি বিলাসিতামুক্ত, অত্যন্ত সাটা-মাটা ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। খেজুরের ছালভর্তি ছাটায়ের উপর শোয়ার কারণে তার পিঠে দাগ পড়ে যেতো। সাহাবারা (রাঃ) ভালো কোনো বিছানার ব্যবস্থা করার আবদার জানালে তার প্রতিউত্তরে তিনি বলতেন, আমি দুনিয়াতে একজন পথচারী ছাড়া আর কিছুই নই। যে পথচারী একটা গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে একটু পরে সেটা ছেড়ে চলে যায় (তিরমিজি: ২৩৭৭)। 
মিশুক : সকল রসুলের সেরা হয়েও মহানবী (সাঃ) ছোট-বড়, শিশু-বৃদ্ধ সবার সাথে মন খুলে মিশতেন। তিনি সাহাবাদের সাথে এমন ভাবে মিশে বসতেন যে, কোন আগন্তুক এসে চিনতে পারতো না কে আল্লাহর রসুল। এ কারণে অধিকাংশ সময়ে তারা জিজ্ঞাসা করতো, তোমাদের মধ্যে মুহাম্মদ কে?  ক্ষানাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, আমাদের সাথে নবীজি (সাঃ) মেলামেশা করতেন, এমনকি একদিন তিনি আমার এক ছোট ভাইকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ ওহে আবু উমায়র, তোমার নুগায়র পাখিটি কেমন আছে (বুখারি: ৫৬৯৯)? 
দানশীলতা : আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নাবীজী (সাঃ) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর, সবার চাইতে অধিক দানশীল এবং লোকদের মধ্যে সর্বাধিক সাহসী ছিলেন (বুখারি: ৫৬০৭)। কেউ কিছু চাইলে তিনি তাদেরকে খালি হাতে ফেরাতেন না।  
মহানবীর চরিত্র ও আদর্শের কথা লিখে কখনও শেষ করা যাবে না। তিনি মানবতার জীবন্ত মডেল। তাই আসুন, আমরা মহানবীর মহান আদর্শকে অনুসরণ করি এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে তার আদর্শকে ছড়িয়ে দিই। মহানবীর (সাঃ) সর্বোত্তম আদর্শের বাস্তবায়নই হোক সীরাতুন্নবীর শিক্ষা।
(লেখক: মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)

্রিন্ট

আরও সংবদ