খুলনা | সোমবার | ১১ নভেম্বর ২০২৪ | ২৬ কার্তিক ১৪৩১

খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিতে চারজন নিহত, ১৪৪ ধারা জারি

খবর ডেস্ক |
০২:৩৫ এ.এম | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪


খাগড়াছড়ি শহরে চুরির অভিযোগে গণপিটুনিতে বুধবার এক যুবক মারা যান। এর প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার রাতভর দীঘিনালায় পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। শুক্রবার সকালে এই সহিংসতা রাঙামাটিতেও ছড়িয়ে পড়ে। দুই জেলায় চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন উভয়পক্ষের অন্তত ৭০ জন। সংঘর্ষের সময় দোকানপাট ও বাড়িঘরে ভাঙচুরের পর অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দুপুরে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
খাগড়াছড়িতে রাতভর গোলাগুলি, নিহত ৩ : জেলার দীঘিনালায় পাহাড়ি ও বাঙালির সংঘর্ষের জের ধরে বৃহস্পতিবার রাতভর জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে সদরসহ পুরো জেলায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাতের গোলাগুলি ও বিকেলের সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০)।
বৃহস্পতিবার রাতে (আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টা) জেলা শহরের নারানখখাইয়া, স্বনির্ভর এলাকায় ব্যাপক গুলির শব্দ শোনা যায়। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গভীর রাত পর্যন্ত গুলির শব্দ পাওয়া যায়।
এর মধ্যে ধনঞ্জয় চাকমা দীঘিনালায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংঘর্ষে মারা যান। অপর দু’জনকে আহত অবস্থায় রাতে খাগড়াছড়ি সদর থেকে হাসপাতালে আনা হয়।
খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) রিপল বাপ্পি চাকমা বলেন, রাতে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ১৬ জনকে আনা হয়। তাঁরা বেশির ভাগই সদর উপজেলা থেকে রাতে এসেছেন। এর মধ্যে তিনজন মারা যান। নিহত ব্যক্তিদের মৃত্যুর কারণ ময়নাতদন্ত শেষে বলা যাবে। বর্তমানে হাসপাতালে আরও ৯ জন চিকিৎসাধীন।
রিপল বাপ্পি চাকমা আরও জানান, রাতেই চারজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে একজন বাঙালি রয়েছেন। আহত বাকি ৯ পাহাড়িকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব বলে তিনি জানান।
তিনজনের মরদেহ সদর হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন সোহেল চাকমা, মানব ত্রিপুরা, বিজয় চাকমা ও নলেজ চাকমা।
প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রশাসন সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে দীঘিনালা লারমা স্কয়ার এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ বাধে। বুধবার মোহাম্মদ মামুন (৩০) নামের এক ব্যক্তিকে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগ মারধরের ঘটনার জের ধরে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় বলে জানা গেছে। আহত মামুন বুধবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার বাসিন্দা।
এ ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিকেলে দীঘিনালায় বাঙালিরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এ সময় পাহাড়িরা মিছিলে বাধা দেন বলে অভিযোগ। তখন সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। একপর্যায়ে পাহাড়িদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পাহাড়িরা ঘরবাড়ি ছেড়ে গহীন পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যান।
বোয়ালখালী বাজার এলাকার বাসিন্দা মোঃ লোকমান হোসেন বলেন, মামুন হত্যার বিচারের দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে তাঁরা মিছিল বের করেছিলেন। পরে পাহাড়িরা এসে বাধা দিয়েছেন। এ জন্য ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছে। লোকমান বলেন, ‘এভাবে ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হবে, এটা ভাবিনি।’
লারমা স্কয়ার এলাকার বাসিন্দা রিপন চাকমা বলেন, মিছিলে পাহাড়িরা কেউ বাধা দেননি। মিছিল থেকেই অতর্কিতভাবে হামলা চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে।
এ ঘটনার পর বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ি শহরে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। এর জের ধরে বৃহস্পতিবার রাতে শহরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। রাতভর সেখানে আতঙ্ক বিরাজ করে। মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেটও পাওয়া যাচ্ছিল না। সদরের বাসিন্দারা অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান।
ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সহিদুজ্জামান শুক্রবার সকালে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘রাতে গোলাগুলি হয়েছে। এ পর্যন্ত তিনজনের লাশ পাওয়া গেছে। মরদেহ হাসপাতালে রয়েছে। আহত হয়েছেন ১০ থেকে ১২ জন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা পুলিশ সুপারসহ ঘটনাস্থল দীঘিনালায় যাচ্ছি। সেখানে গিয়ে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করব। একটা থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।’
মোহাম্মদ সহিদুজ্জামান আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ বলেন, আগুনে দীঘিনালা বাসস্টেশন ও লারমা স্কয়ার এলাকায় ১০২টি দোকান আগুনে পুড়ে গেছে। এর মধ্যে চাকমা স¤প্রদায়ের ৭৮টি ও বাঙালির স¤প্রদায়ের ২৪টি দোকান রয়েছে। ভাঙচুর হয় চারটি দোকান। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মিলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে কাজ করছেন। প্রশাসন নিরাপত্তা জোরদার করেছে।
রাঙামাটিতে একজনের মৃত্যু, ১৪৪ ধারা জারি : খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের জেরে রাঙামাটিতেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। শুক্রবার সকাল থেকে দুইপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এতে একজন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। তবে নিহতের নাম-পরিচয় জানা যায়নি।
এদিকে বেলা দেড়টা থেকে রাঙামাটি পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোশাররফ হোসেন।
জানা গেছে, খাগড়াছড়িতে সংঘর্ষ ও মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে সকালে শহরের জিমনেসিয়াম চত্বর থেকে কয়েক হাজার পাহাড়ির একটি মিছিল বের হয়। তারা শহরের বনরূপা এলাকায় গেলে সেখানে মিছিলে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করার অভিযোগ ওঠে। এর জেরে বাঙালিদের বেশ কিছু দোকানপাট ও বনরূপা মসজিদে ভাঙচুর করা হয়। সড়কে চলাচলকারী বেশকিছু বাস-ট্রাক-অটোরিকশাও ভাঙচুর করে মিছিলকারীরা। এ ঘটনার পর বাঙালিরা পাহাড়িদের ধাওয়া করে। শুরু হয় ধাওয়া-পালটা ধাওয়া, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ। কাঁঠালতলীতে অবস্থিত মৈত্রী বিহার ভাঙচুর ও বনরূপায় পাহাড়িদের দু’টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়া হয়।
রাঙামাটি পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোঃ জামালউদ্দিন গণমাধ্যমকে জানান, পাহাড়িদের একটি মিছিল বনরূপায় এসে ফিরে যাওয়ার সময় বাঙালিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মসজিদে হামলা ও ভাঙচুর করে। তারা বেশ কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুর করে। এরপরই বাঙালিদের সঙ্গে পাহাড়িদের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া হয়।
রাঙামাটি সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, অন্তত ৫০ জনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। এদের মধ্যে একজন মারা গেছেন। কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানান চিকিৎসকরা।

্রিন্ট

আরও সংবদ