খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

আসুন আমরা মানুষ হই

ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন |
০২:৪০ এ.এম | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪


ছোট বেলায় কোন একটি বই-এ যেন পড়েছিলাম, একটি ছোট্ট গ্রাম, আর এই গ্রামের ভিতরে রয়েছে একটি পাঠশালা। পাঠশালার মেধাবী ছাত্র আব্দুল্লাহ। আব্দুল্লাহ পাঁচ ক্লাসে জলপানি পেয়ে পাশ করেছে। এরপর উচ্চক্লাসে লেখাপড়ার ব্যবস্থা আর গ্রামে নেই, তাই এখন তাকে লেখাপড়ার জন্য যেতে হবে শহরে। মাথায় বিছানা আর কাপড়ের গাট্টি, হাতে খাবারের একটি ছোট্ট পুটুলি। যাত্রার শুরুতেই আব্দুল্লাহ দোয়া নেওয়ার জন্য গেল ওস্তাদজীর বাড়ীতে। মাথার গাট্টি আর হাতের পুটুলি মাটিতে নামিয়ে আব্দুল্লাহ বিনয়ের সাথে ওস্তাদজীর সামনে মাথা হেঁট করে দাঁড়াল। কান্নাবিজড়িত কাঁপাকাঁপা কন্ঠের উচ্চারণ, ‘ওস্তাদজী শহরে পড়তে যাইতে আছি আমারে দোওয়া কইরেন’। ওস্তাদজী আদরের সাথে আব্দুল্লাহকে কাছে ডাকলেন, স্নেহভরা হাতটি রাখলেন তার মাথার উপর, বললেন, ‘লেখাপড়া শিখে তুমি অনেক বড় হবে এ দোওয়া আমি করি না, আমি এ দোওয়াই করি লেখাপড়া শিখে যেন তুমি মানুষ হও’।
মানুষ আবার মানুষ হবে কিভাবে? ড.মুশফিক আহমদ রহমাতুল্লাহি আলাইহির বলতেন, প্রধানত তিনটা মাত্রা নিয়ে একজন মানুষ।
এক, তার দেহ; হাত-পা কাজকর্ম করে, চোখ দিয়ে দেখে, কান দিয়ে শোনে, পা দিয়ে চলে, হাত দিয়ে ধরে ইত্যাদি।
দুই, তার মস্তিষ্ক; যেটা দিয়ে সে চিন্তা করে। এবং তিন, তার অন্তর; যেটা দিয়ে সে অনুভব করে।
দেহের মাত্রায় মানুষ বড় দুর্বল। চিনি ও লবন পাশাপশি ঘ্রাণ নিয়ে মানুষ বলতে পারবে না কোনটা চিনি আর কোনটা লবণ। কিন্তু পিঁপড়া ঠিকই বলেদিতে পারবে। শকুন কত দূর থেকে দেখে। গরু শুয়ে আছে; জীবিত না মৃত, সে ঐ আকাশের উপর থেকে দেখে বুঝতে পারে। আর মানুষ কাছে থেকে দেখেও অনেক সময় বোঝেনা। শক্তির কথায় যদি ধরি একটি বাঘের থাবায়, হাতীর পাড়ায় যে পরিমাণ শক্তি আছে মানুষ সে তুলনায় কিছুই না।
এরপর হল মানুষের চিন্তা শক্তি। এটাও মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট্য নয়। কারণ একটি কম্পিউটার মুহূর্তে যে চিন্তা করতে পারে মানুষ তার ধারে কাছেও নেই। দাবা খেলার কথায় ধরুন। একটি চাল দিতে মানুষের প্রায় ঘণ্টা খানেক লেগে যায়। এক ঘণ্টা চিন্তা করে যে এই চাল দিলে কী হতে পারে, এটার কী হতে পারে, ওটার কী হতে পারে। আর ওর উত্তরে কম্পিটার চিন্তা করলো মাত্র এক সেকেন্ড; আর ওর চেয়ে অনেক বেশি চিন্তা করলো। মানুষ কম্পিউটারের সাথে চিন্তা করে কুলাতে পারবে না। তাহলে কি কম্পিউটার মানুষের চেয়ে উত্তম?
পার্থক্যটা কোথায়? : আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে এমন একটা জিনিস দিয়েছেন, যেটা গরু, ছাগলের মধ্যেও নেই, কম্পিউটারের মধ্যেও নেই; আর তারা সেটা গড়তেও পারবে না। ঐটা হচ্ছে অনুভূতি।
মনেকরুন কার হাত-পা খুব শক্তিশালী, শক্তিশালী দেহ; কিন্তু পাগল বা বোকা। মানুষ হিসেবে সে বড়ই দুর্বল, নিম্নমানের। দৈহিক শক্তিতে খুব প্রসিদ্ধ, চোখে খুব ভালো দেখে, কানে খুব ভালো শোনে কিন্তু বুদ্ধি কাজ করেনা। ভালো মন্দ বুঝেনা, অনুভূতিহীন। তো সে মানুষ হিসেবে ব্যর্থ মানুষ।
একইভাবে খুব চিন্তা করতে পারে, অত্যন্ত মেধাবী, কিন্তু তার কোন অনুভূতি বা ইংরেজীতে ঋববষরহম এগুলো নেই। তো বড় বৈজ্ঞানিক, বড় দার্শনিক; তার বুদ্ধির কোন সীমা নেই, কিন্তু বউ ওকে ছেড়ে চলে গেছে।
কেন? -বলে যে ওর কোন ঋববষরহম-ই নেই।
ছেলে তার বাপকে পাত্তাই দেয় না।
এত বড় বৈজ্ঞানিক; পাত্তা দাও না কেন?
-ধেত! মানুষই নয়।
-তোমার বাপের ব্যাপারে তোমার অভিযোগটা কী? তোমাকে মারে, গালি দেয়, না কী করে?
-সে বলে যে, না কিচ্ছু না।
-তাহলে কী?
-বলে যে, আমার এক্সিডেন্ট হয়েছিল, মুমূর্ষু অবস্থা। আব্বাকে খবর দেওয়া হল। আব্বা তার থিওরি, তার বিজ্ঞানের অংক করছিল। ওখান থেকে উঠলও না, খবরও নিল না। পরে আবার তাকে বলা হল, তোমার ছেলে যে হাসপাতালে? উনি বললেন, ‘ও হ্যাঁ। তাইতো তাইতো।’ আবার অংক করতে লেগে গেল। ওতো একটা অংক, ওতো বাপ নয়। আমি একটা বাপ চাই।
আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে এমন একটা জিনিস দিয়েছেন, যেটা গরু, ছাগলের মধ্যেও নেই, কম্পিউটারের মধ্যেও নেই; গড়তেও পারবে না- ঐটা হচ্ছে অনুভূতি। (ড. মুশফিক আহমদ রহমাতুল্লাহি আলাইহির মোজাকারা হতে)
অর্থাৎ, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ, ভুল-সঠিক, কপটতা, পাপ ও অপরাধ, সংশোধন ও বিনাশ সম্পর্কে অনুভূতি থাকা এবং এগুলোর মধ্যে সহজেই পার্থক্য করতে পারা। সচেতন হওয়া, বোধ ও বিবেক জাগ্রত থাকা, যাতে কোন অবস্থায় এবং কোন ক্ষেত্রেই কোন ভুলবিচ্যুতি, ভ্রষ্টতা ও নষ্টাচার বরদাশতযোগ্য না হয়। এটাই মানুষের আসল পরিচয়। 

সংকলক: বায়োকেমিস্ট, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়, খুলনা।

্রিন্ট

আরও সংবদ