খুলনা | শুক্রবার | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১২ আশ্বিন ১৪৩১

২০১০-২০২৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সীমান্তে ৭৭ শতাংশ হত্যায় জড়িত বিএসএফ; বাকি ২৩ শতাংশ ভারতীয় গ্রামবাসীরা

সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যায় শুধু বিএসএফ নয়, ভারতীয় গ্রামবাসীরাও জড়িত

খবর প্রতিবেদন |
০১:০৩ এ.এম | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪


সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে (বিএসএফ) দায়ী করা হলেও ভারতীয় নাগরিকেরাও (গ্রামবাসী) কম মারে না। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভারতীয় গ্রামবাসীর হাতে হত্যার ঘটনা আড়ালে থেকে যায়। 
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তথ্যমতে, ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে যত বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার শিকার হয়েছে, তাদের ৭৭ শতাংশ হত্যা করেছে বিএসএফ; বাকি ২৩ শতাংশ হত্যায় জড়িত ভারতীয় গ্রামবাসীরা। 
২০২২ সালের ২৩ আগস্ট রাতে অবৈধভাবে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার রাজগঞ্জ ব¬কের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার চাউলহাটি-সংলগ্ন বড়ুয়া পাড়া গ্রামে যান আব্দুস সালাম (৩৫) নামের এক বাংলাদেশি যুবক। এ সময় ওই গ্রামের বাসিন্দারা তাঁকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করে। ঘটনার প্রায় ৯ মাস পর বাংলাদেশি যুবক আব্দুস সালামের মরদেহ ফেরত পায় পরিবার। আব্দুস সালাম বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার সাতমেরা ইউনিয়নের কাহারপাড়া গ্রামের মৃত শহিদুল ইসলামের ছেলে।
২০২৩ সালের ৭ জুলাই ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটা থানাধীন জারীধরলা এলাকার নগরটারী গ্রামে যান লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার পূর্বদীঘলটারী গ্রামের যুবক রফিকুল ইসলাম। সেখানে তখন পঞ্চায়েত ভোট চলছিল। স্থানীয় সন্ত্রাসীরা রফিকুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করে।
আব্দুস সালাম কিংবা রফিকুল ইসলামই শুধু নন, প্রতিবছর সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যায় বিএসএফ’র সঙ্গে ভারতীয় নাগরিকেরাও জড়িত রয়েছে। বিজিবির তথ্যমতে, ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যার শিকার হয় ৪৬৬ জন বাংলাদেশি নাগরিক। তাদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিকদের হাতে নিহত হয়েছে ১০৭ জন। আর বিএসএফ দ্বারা নিহত হয়েছে ৩৫৯ জন। গত ১৪ বছরে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে বছরে গড়ে ৩১ জন বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার শিকার হয়। 
বিজিবির তথ্য বিশে¬ষণে দেখা গেছে, ২০২০ সালে নিহত সীমান্তে হয় ৪৯ জন বাংলাদেশি নাগরিক। তাদের মধ্যে ৩৮ জন বিএসএফ ও ১১ জন ভারতীয় নাগরিকদের হাতে নিহত হয়। পরের বছর ২০২১ সালে বিএসএফ’র গুলিতে ৭ জন এবং ভারতীয় নাগরিকদের হাতে ৫ জন বাংলাদেশি মারা যায়। ২০২২ সালে বিএসএফ ১৫ জন, ভারতীয় নাগরিকেরা ৭ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করে। ২০২৩ সালে বিএসএফ’র ২৫ জন এবং ভারতীয় নাগরিকদের হাতে ৪ জন, ২০২৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএসএফের হাতে ১৭ জন এবং ভারতীয় নাগরিকদের দ্বারা ২ জন বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার শিকার হয়।
সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ আবদুল মান্নান বলেন, ভারতীয় দালাল বা চোরাকারবারি চক্রের কবলে পড়ে বাংলাদেশি নাগরিকেরা হত্যার শিকার হয়। এখানে বিএসএফ উৎসাহ দেয় কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। আর দরকার সীমান্তে ব্যবস্থাপনা ঠিক করা। এটা দুই দেশের পক্ষ থেকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
বিজিবির তথ্যমতে, ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক আহত হয়েছে ৯৪৫ জন। তাদের মধ্যে বিএসএফ’র নির্যাতনের শিকার প্রায় ৭৫০ জন। বাকিরা ভারতীয় নাগরিকদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়।
জানতে চাইলে বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মোঃ শরীফুল ইসলাম বলেন, সীমান্তে অনেকের আর্থিক অসচ্ছলতার সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা তাদের কাজে লাগিয়ে মাদক, চোরাচালান, গরু পারাপারসহ অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করে। পাশাপাশি সীমান্তে আত্মীয়স্বজন থাকায় দুই দেশের জনগণের ঐতিহ্যগতভাবে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সীমান্ত অতিক্রম করে। প্রভাবশালীদের অবৈধ ব্যবসার উদ্দেশ্য হাসিল করা এবং দুই দেশের স্বজনদের সঙ্গে দেখা করাসহ নানা কারণে সীমান্তে হত্যা ও আহতের ঘটনা ঘটে। শীতকালে ঘন কুয়াশা ও শুষ্ক থাকায় এই সময়ে সীমান্তে হত্যা ও আহতের ঘটনা বেশি ঘটে।
ভারতের ত্রিপুরায় থাকেন মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের কালনীগড় গ্রামের পরেন্দ্র দাসের বড় ছেলে। তাঁকে দেখতে মেয়ে স্বর্ণা দাস (১৬) ও তার মা ১ সেপ্টেম্বর স্থানীয় দুই দালালের সহযোগিতায় লালারচক সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করেন। রাত ৯টার দিকে কুলাউড়া উপজেলা সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার কাছে পৌঁছালে বিএসএফ তাঁদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় কিশোরী স্বর্ণা দাস।
এ ঘটনার সপ্তাহ পেরোতেই ৯ সেপ্টেম্বর ভোরে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ধনতলা ইউনিয়নের ঠুমনিয়া গ্রামের বাসিন্দা জয়ন্ত কুমার (১৫) বিএসএফ’র গুলিতে নিহত হয়। আহত হন জয়ন্তের বাবা মহাদেব ও প্রতিবেশী দরবার হোসেন।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গত কয়েক বছরে বেড়েছে সীমান্তে হত্যা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সীমান্তে নিহত ও আহতের ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে সংস্থাটি। তাদের সংগৃহীত তথ্য বলছে, ২০২১ সালে ১৭ জন, ২০২২ সালে ২৩ জন, ২০২৩ সালে ২৮ জন, ২০২৪ সালে জুন পর্যন্ত ১৩ জন বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে। 
মানবাধিকারকর্মী মোঃ নূর খান  বলেন, ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী সুলভ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যদি বহাল রাখতে হয়, সে ক্ষেত্রে এমন কোনো কার্যক্রম মেনে নেওয়া উচিত নয়, যেটা মানবাধিকারের দৃষ্টিতে অচল।
সীমান্তে হত্যার কারণ ও বন্ধের বিষয়ে এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, দুই দেশের সীমান্ত যেভাবে ভাগ করা হয়েছে, সেখানে ভিটেমাটি, আত্মীয় স্বজন দুই দেশে। ফলে সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময়ও দুই দেশের মানুষ আসা-যাওয়া করে। হাট-বাজার, হাসপাতালসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তারা নির্ভরশীল। এমন একটা পরিস্থিতিতে সহিষ্ণু আচরণ না করলে হত্যা বন্ধ হবে না।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সীমান্ত এলাকা রয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে চীনের। কিন্তু দেশ দু’টির সীমান্ত এলাকায় হত্যাকাণ্ডের নজির খুব কম। অথচ ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটারের বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত প্রায়ই আলোচনায় থাকে সীমান্ত হত্যা নিয়ে। এটি শূন্যে নামাতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী যৌথ বিবৃতি দেন। তারপরও এটি থামেনি বরং বেড়েছে। বিজিবির তথ্য বলছে, ২০২২ সালে সীমান্তে ২২ জন নিহত হয়। ২০২৩ সালে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯ জনে।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশে¬ষক এয়ার কমোডর (অবঃ) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, সীমান্তে যারা দুই দেশে যাতায়াত করে, তাদেরকে উচিত বিশেষ পাস দেওয়া, যেটা অনেক দেশে আছে। আমাদের এখানেও যদি পাস দেওয়া হয় এবং নজরদারি বাড়ানো হয়, তাহলেই সীমান্তে হত্যা অনেকটা কমে আসবে। 
সূত্র : আজকের পত্রিকা অনলাইন।

্রিন্ট

আরও সংবদ