খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

খুলনা-যশোর-সাতক্ষীরার ৮ উপজেলার ১৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি-২

হুমকির মুখে জীব বৈচিত্র, মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা

সোহরাব হোসেন, জলাবদ্ধ স্থান থেকে ফিরে |
০১:২৮ এ.এম | ০৯ অক্টোবর ২০২৪


আশি^নের অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের কারণে খুলনা-যশোর-সাতক্ষীরা ৮ উপজেলার ১৫ লাখ মানুষ আজ উদ্বাস্তু হতে চলেছে। স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে জীবন-জীবীকায়নে বড় ধরনের আঘাত সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় মাসাধিককাল ধরে জলাবদ্ধতায় আটকে আছে এলাকার সব পেশার মানুষ। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা পুঁজি ভেঙে দিন পার করছে। আর দিনমজুর ও বর্গাচাষিদের মানবেতর দিন কাটছে।
খুলনার জেলার অন্যতম বাজার বা মোকাম হলো চুকনগর। যেখানে তিনটি জেলার মিলন স্থান বলা হয়। চুকনগর থেকে যশোরের কেশবপুর সেমি হাইওয়ের পথ ধরে কিছু দূর গেলে দেখা মিলবে কাটাখাল। কাটাখালের পূর্বপাড়ের ইটের সোলিং রাস্তা দিয়ে দেড় কিলোমিটার গেলে পাওয়া যাবে একটি কালভার্ট কাম ব্রিজ। যা ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নের নরনিয়া গ্রামে অবস্থিত।
ওই গ্রামে দেখা হলো স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী মোঃ হাফিজুল, আসাদসহ গ্রামবাসীদের সঙ্গে। তারা সকলেই বললেন, প্রায় মাসব্যাপী পানিবন্দি থেকে কিভাবে জীবন পার করছেন। তারা বলেন, আমাদের এই গ্রামের ব্রিজটা এখন উঁচু স্থান। ভিতরের বাড়িগুলো পানিতে তলিয়ে রয়েছে। পানি নামছে না। অনেক কাঁচাঘর-বাড়ি ভেঙে গেছে। আবার প্রতিদিন কম-বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। তখন পানি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের এলাকার পানি সরানোর একমাত্র পথ আপার ভদ্রা নদী। কিন্তু নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি সরানো সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থা কতো দিন চলবে তা কারও জানা নেই। 
ওই গ্রামে দেখা যায়, ইটের সোলিং রাস্তার পাশে অস্থায়ী টোং ঘর বেঁধে দিনের বেলায় মানুষ ঘুমাচ্ছে। কেননা, রাতে বাড়িতে ঘুমানোও ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষ করে নারী-শিশুদের জীবন এখন ওষ্ঠাগত। এলাকার ছোট-বড় সব মৎস্য ঘের ভেসে গেছে। আবার সবজির রাজধানী হিসেবে খ্যাত ডুমুরিয়া, কেশবপুর ও তালার কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে পানিতে তলিয়ে রয়েছে।
ডুমরিয়াসহ দক্ষিণাঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রায় ৪০ বছর ধরে কাজ করা সাবেক অধ্যক্ষ এ বি এম শফিকুল ইসলাম বলেন, খুলনার ডুমুরিয়া, যশোরের কেশবপুর, মণিরামপুর ও সাতক্ষীরার তালা হলো শস্য ভান্ডার। তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে সবজি ও মাছের চাহিদার যোগান হয় এখান থেকে। ডুমুরিয়ার টিপনা, চুকনগর ও আঠারো মাইল এলাকায় অসংখ্য পাইকারী সবজির মার্কেট রয়েছে। শত শত ট্রাক ভরে সবজি যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। যা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে অতিবৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে। তিনি বলেন, এ এলাকার ৮০ শতাংশ কৃষক অন্যের জমি হারি (বাৎসরিক টাকা) চুক্তিতে চাষাবাদ করেন। যারা নিজে কায়িক পরিশ্রম করেন এবং পুঁজি বিনিয়োগ করেন। এবারও তারা আগাম শীতের সবজি চাষ করেছিলেন। কিন্তু সে সবজি ক্ষেত এখন সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এ সব প্রান্তিক কৃষক এখন সর্বশান্ত হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, এসব কৃষকদের প্রধান দাবি, ত্রাণ নয়, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
অধ্যক্ষ এ বি এম শফিকুল ইসলাম বলেন, আমি দীর্ঘদিন পরিবেশ ও প্রতিবেশ নিয়ে কাজ করছি। এলাকার প্রতিটি গ্রাম ও পাড়ায় যাই। কিন্তু এবারের অবস্থা ভয়াবহ। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে, এলাকার জীব-বৈচিত্র হুমকির মুখে পড়বে। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে এখানকার মানুষ টিকে থাকতে পারবে না। তখন তারা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র উদ্বাস্তু হবে। যা সমাজে বিরুপ প্রভাব পড়তে পারে। তিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সংশিষ্ট কয়েকজন উপদেষ্টার অতীত কর্মকান্ড তুলে ধরে বলেন, তারা পরিবেশ সচেতন। বর্তমান পরিবেশ বান্ধব সরকারই নিতে পারে তড়িৎ ব্যবস্থা।
একই দিন সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের সুভাষিনী গ্রামে যেয়ে দেখা যায় এক অমানবিক দৃশ্য। খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক দিয়ে ডুমুরিয়ার আঠারোমাইল হয়ে কাঞ্চনপুর গ্রামের পাশ দিয়ে গেলে দেখা যাবে সড়কের দু’পাশে গ্রামগুলো পানিতে নিমজ্জিত। দূরের বাড়িগুলোর পাশে তাল কাঠের ডোঙ্গা আর ভেলার দৃশ্য। এ সব মানুষ ঘর থেকে বাইরে বের হয় ডোঙ্গা আর ভেলায় চড়ে। আরও কিছু দূর গেলে পাওয়া যাবে সাতক্ষীরার তালার সুভাষিনী বাজার। সুভাষিনী বাজরের পশ্চিম পাশ দিয়ে চলে গেছে একটি পিচ ঢালা সড়ক। সড়কটি গ্রামের প্রধান রাস্তা। যেটি মিশেছে কেশবপুর কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের পিতৃভূমি সাগরদাঁড়িতে। ওই সড়ক দিয়ে পশ্চিম দিকে দেড় কিলোমটিার গেলে চোখে পড়বে বিলের পর বিল থৈ থৈ করছে পানি। সুভাষিনী গ্রামের উত্তর পাশের বিল পেরিয়ে শিরাশুনী গ্রাম। সুভাষিনী গ্রামের জামতলা থেকে একটি সড়ক বিলের বুক চিরে মিশেছে শিরাশুনী গ্রামে। তবে সে রাস্তাটি এখনও পানির নিচে। শিরাশুনী গ্রামের ১৩শ’ বাসিন্দা রয়েছে পানিবন্দি অবস্থায়। কেন না পুরো গ্রামটির এক ইঞ্চি জায়গা ঠাঁই নেই। পুরো গ্রাম জুড়ে এখনও পানি রয়েছে। 
সুভাষিনী গ্রামের রেজাউল করিম, ভ্যান চালক ইসহাক মোড়ল ও গৃহবধূ শিউলি জানান, তারা প্রায় এক মাস ধরে এই চরম ভোগান্তির মধ্যে রয়েছে। সুভাষিনী থেকে সাগরদাঁড়ি রাস্তাটি পিচ ঢালা হলেও কোথাও কোথাও হাটু পানিতে তলিয়ে গেছে। গ্রামের মসজিদটির চার পাশে পানি থৈ থৈ করছে। তারা জানান, আমাদের গ্রামের ছোট ছোট রাস্তা ও বাড়ির পথগুলো পেড়ি মাটির কাঁদায় ভরে গেছে। ঘর থেকে নেমে একটু শুকনো জায়গা নেই। মরে যাচ্ছে বাড়ির আঙ্গিনায় লাগানো নতুন-পুরাতন আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুসহ মৌসুমী ফলের গাছ। যা আগামী দিনে দেশী ফলের সঙ্কট দেখা দিবে। রেজাউল করিম বলেন, গত ৫০ বছরে এমন পানি তিনি দেখেননি।
সুভাষিনী বাজারে কথা হয় স্থানীয় তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম এম আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, তার ইউনিয়নের ১৭টি গ্রাম জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা শিরাশুনী গ্রাম। 
তিনি বলেন, এলাকার খাদ্য সঙ্কট থেকে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত মানুষ। স্যানিটেশন, হাইজিনিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পানি আরও বেশি দিন থাকলে গাছের লতা-পাতা পচন ধরবে। তখন এই এলাকার মানুষদের অন্যত্র চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে তালা উপজেলা পরিষদে সভা হয়েছে এবং তা জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে। প্রশাসনও কাজ করছে, তবে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে। তিনি বলেন, এখানকার মানুষের সবচেয়ে বড় ফসল বোরো ধানের চাষ। আগামী শীতের আগে পানি না কমলে মানুষ দারুণ খাদ্য সঙ্কটে পড়বে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার প্রধান প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা বলেন, আমরা চেষ্টা করছি আগামী বোরো মৌসুমের আগেই পানি নিষ্কাশন করার। তিনি বলেন, ওই সব এলাকার যে ক্ষতি হয়েছে, তার পরিমাপ এখনই করা সম্ভব নয়। আমরা সরকারের উর্ধ্বতন মহলকে অবহিত করেছি। ইতোমধ্যে আমরা কিছু এলাকার বাঁধ কেটে পানি নামানোর পরিকল্পনা নিয়েছি।

্রিন্ট

আরও সংবদ