খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

স্মৃতির সোনার পাতে লেখা একটি নাম হেডমাস্টার মোহাম্মদ আমজাদ আলী

কাজী রোজী সিদ্দীকি |
১২:২৪ এ.এম | ২০ অক্টোবর ২০২৪


জ্ঞান সাধক, নির্লোভ, নির্মোহ ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ আমজাদ আলী। তিনি ছিলেন পাইকগাছা গভঃ হাইস্কুলের প্রথিতযশা একজন সফল প্রবীন প্রধান শিক্ষক। এই তল­াটের হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের প্রিয় শিক্ষক, প্রিয় অভিভাবক। তাঁর সম্পর্কে এই কলামটি লিখতে যেয়ে মনে পড়ে কতো কথা। তাকে নিয়ে কতো আলোচনা। সংবাদপত্রের পাতায় কতো জ্ঞানী, গুণী, সুধী মানুষের জ্ঞানগর্ব পর্যালোচনা।
তাঁর সম্পর্কে কোনটা রেখে কোনটা লিখবো ভেবে কূল পাই না। তবুও লিখতে হবে, কাঁচা হাতে কিছু না কিছু। কারণ এই জগৎ-সংসারে এমন কিছু মানুষের আবির্ভাব ঘটে, যাঁরা প্রত্যাশা-প্রাপ্তির তোয়াক্কা না করে  দেশ এবং জাতির উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করেন এবং স্বীয় কর্মসাধনার দ্বারা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হন; মোহাম্মদ আমজাদ আলী হলেন তাঁর মধ্যে একটি জীবন্ত উদাহরণ। তাঁর সম্পর্কে কিছু লিখতে না পারাটাই নিজেকে ছোট মনে হয়। কারণ আমরা এমন একটি সমাজ ব্যবস্থায় বসবাস করি সেখানে গুণীর কোন কদর নেই। জ্ঞানীর কোন মর্যাদা নেই। মানবিকতা বলে কিছুই নেই। পরস্পর দ্বন্দ সংঘাতে লিপ্ত। এ যেন নিষ্ঠুর এক ভাগ্যের নিয়তি।
এ অগ্রগতির চক্রাবর্তে কত মানুষের শৌর্যবীর্যের ইতিহাস একদিকে যেমন উজ্জীবিত, অপরদিকে বহু জাতি-মানুষের বুকফাটা ক্রন্দনও তেমনি পাথর চাপায় অবরুদ্ধ। মনে হয় মানুষে মানুষে দ্বন্দ-সংঘর্ষই যেন পৃথিবীর বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস। কিন্তু কেন এ দ্বন্দ? কিসের এ দ্বন্দ কিংবা এর উৎস ও ক্রমবিকাশের কার্যকারণ না জেনেই মানুষ এই দ্বন্দে লিপ্ত। মূলত বিশ্বের ইতিহাস এই দ্বন্দের ইতিহাস। এক মানুষ কর্তৃক আর এক মানুষের অমর্যাদা-অপমানের ইতিহাস। এক অর্থে তা বিবেক ও মনুষ্যত্ব হীনতারই ইতিহাস। এ ইতিহাসের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যে এক মানুষ অপর মানুষের বুকের উপর পা রেখে উল­াস করছে বলে প্রতীয়মান হয়। অথচ মানুষ ভাবছে না সে নিজেই নিজের অমর্যাদা করতে ব্যগ্র। তাই সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও মরহুমের জীবন আলেখ্য কিছু কথা এই জাতি রাষ্ট্রের কাছে তুলে ধরা নাগরিক হিসেবে একান্তভাবে দায়িত্ব বলে মনে করি।
মোহাম্মদ আমজাদ আলী আপন মহিমায় জ্ঞানসাধনায় যশস্বী হয়েছেন, বিদ্যোৎসাহী সমাজে লাভ করেছেন মর্যাদাপূর্ণ স্থান। তাঁর প্রতিটি আদর্শ জীবনের পাথেয়। তাঁর মৃত্যুবাষির্কীর এ দিনে অনেক স্মৃতি, অজানা নানা কথা বিভিন্ন লিখনীর মাধ্যমে এ দিনে হৃদয়ের মুকুলে ভেসে উঠে।
ব্রিটিশ ভারতে তাঁর লেখাপড়ায় হাতে খড়ি। বর্ণযুগে মুসলমান ঘরের সন্তান হয়েও তিনি খুলনা জেলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। অজপাড়াগায়ের বিশেষ করে বর্ণ যুগের মধ্যে বসবাস করে জেলা স্কুলে তৎকালীন সময়ে স্থান করে নেয়া সত্যিই কঠিন ব্যাপার। অতঃপর হিন্দু একাডেমি (আজকেল বি.এল কলেজ) থেকে তিনি সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন। কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন। সেদিন তিনি মনে করলে সুপিরিয়র কোন সার্ভিসে যোগদান করতে পারতেন। সেদিকে না তাকিয়ে তিনি শহর ছেড়ে ফিরে যান সূদুর মফস্বলে। বেছে নেন মহান শিক্ষকতা পেশা।
কারণ কী? মনীষী রাসেল বলেছেন, Teachers are the Architect of Nation and Harbinger of civilization  শিক্ষকতা কেবল চাকুরি নয়; বরং শিক্ষকতা এক মহান পেশা ও ব্রত। যুগে যুগে, কালে কালে, তাই শিক্ষক জ্ঞানের দীপশিখা জ্বেলেছেন, উজাড় করে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জ্ঞানের ভান্ডার। অথচ কখনো প্রশ্ন করে দেখেননি প্রতিদানে তিনি কী পেয়েছেন। তিনি মনে করেছিলেন মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা গড়ে না উঠলে একটি জাতি, একটি সমাজ কখনও উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে না। তাই মানুষ গড়ার কারিগর মহান শিক্ষকতা পেশাকে শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছিলেন তিনি।
মানব সেবায় নিজের জীবনকে বিকিয়ে দিয়েছিলেন। কর্মগুণে তিনি জীবনের পরতে পরতে সফলতার পরিচয় নিয়েছিলেন। প্রতিটি মুহূর্তে জঙ্গল পরিস্কার করে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে মনুষ্যত্ব বিকাশে এগিয়ে গেছেন। আসলে যে কোন সাধনা কখনও বৃথা যায় না। সততা, নির্মোহতা কখনও মূল্যহীন হয় না। খুলনার উপক‚লীয় জনপদের মানুষ তাঁকে আজও সম্মানের আসনে আসীন করে রেখেছেন।
হেডমাস্টার মোহাম্মদ আমজাদ আলী পাইকগাছা গভঃ হাইস্কুলের একজন আদর্শবান প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ইংরেজি ২০১২ সালের ২০ অক্টোবর সকাল সকাল ৭-৩০ মি.৭৮ বছর বয়সে তিনি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যান এক গহীন অন্ধকার না ফেরার দেশে। মরহুম প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আমজাদ আলী আজও বেঁচে আছেন। কবির ভাষায় আবারও বলতে হয় :
“মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের তরে বাঁচিবার চাই”
কবির এই বাক্যটির মধ্যে দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন প্রধান শিক্ষক  মোহাম্মদ আমজাদ আলী। নিজ গুণে, নিজ কর্মদক্ষতায় নিজ আদর্শ অনুপ্রেরণা দিয়ে যে মানুষটি হাজারো শিক্ষার্থীর জীবন গড়ে তুলেছেন। তিনি আর কেউ নয়। তিনি হলেন খুলনার উপকূলীয় জনপদের সবার প্রিয় মানুষ পাইকগাছা গভঃ হাইস্কুলের প্রবীনতম প্রধান শিক্ষক জনাব মোহাম্মদ আমজাদ আলী।
সততা, নির্লোভ, নির্মোহ এবং আদর্শ তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তিনি মরেও অমর। এ অঞ্চলের মানুষের হৃদয়জুড়ে তিনি বেঁচে থাকবেন আমৃত্যুকাল। দু’দিনের দুনিয়া। দম ফুরালে ফুটুস। হায়রে মানুষ। এই মানুষ কী সংক্ষিপ্ত দুনিয়ার কথা একটু কী চিন্তা করে দেখেন? মৃত্যু আমার অনিবার্য। একবারও কেউ ভেবে দেখে না। তাইতো বিত্ত-বৈভব অবৈধ আখের গোছাতে কি না তটস্থ’। শুধু অর্থের মোহে আমরা ধাবিত। কী বিচিত্র দুনিয়া!
এই জ্ঞান তাপস ১৯৩৫ খ্রিঃ ২ জুলাই অবিভক্ত পাইকগাছা থানার আজকে কয়রা উপজেলার বাগালী গ্রামে এক বুনিয়াদি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫১ খ্রিঃ খুলনা জিলা স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক. ১৯৫৪ খ্রিঃ খুলনা বি.এল. কলেজ থেকে আই.এ. ১৯৫৮ খ্রিঃ একই কলেজ থেকে বি.এ. ১৯৭৪ খ্রিঃ বি.এড. এবং ১৯৯১ খ্রিঃ এম.এড পাস করেন।
মরহুম জনাব মোহাম্মদ আমজাদ আলী ১৯৬০ খ্রিঃ পাইকগাছা উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করে সুদীর্ঘ ৩১ বছর শিক্ষাকতা জীবন সমাপ্ত করেন। অত্র বিদ্যালয়ে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে তার যোগ্য নেতৃত্বের জন্য বিদ্যালয়টি  ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি লাভে সমর্থ্য হয়। যার ফলশ্র“তি স্বরূপ বিদ্যালয়টি ১৯৬৬ খ্রিঃ উন্নয়ন প্রকল্পভুক্ত হয়।
শিবসা-কপোতাক্ষ নদীর পাদদেশে গড়ে ওঠা পাইকগাছা উচ্চ বিদ্যালয়ের চারিপাশে বৃক্ষরাজি শোভাবর্ধন করে আছে। ১৯৭১ খ্রিঃ শুরু হয় রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ। সুর্দীঘ ৯ মাস সংগ্রামের পর জাতি ফিরে পায় প্রকৃত স্বাধীনতা। যুদ্ধকালীন সময়ে বিদ্যালয়টি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ফলে বিদ্যালয়টির যাবতীয় নথিপত্র, আসবাবপত্র সহ অফিস কক্ষটি বিধ্বস্ত হয়। যার প্রত্যক্ষ নীরব দর্শক ছিলেন এই সাহসী মানুষটি; মরহুম হেডমাস্টার  মোহাম্মদ আমজাদ আলী।
স্বাধীনতা যুদ্ধে নজিরবিহীন ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয় পাইকগাছা উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বিদ্যালয়টির। নিতান্ত রিক্ত হস্তে এর পরিচালনা খুবই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। অত্যন্ত ধৈর্য্যসহকারে তিনি শিক্ষার্থী শিক্ষক ও অভিভাবকের সমন্বয়ে জরুরি সভার আহŸান করেন। জনগণ তাঁর গঠনমূলক পরামর্শের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জানান। এর ফলে বিদ্যালয়টি পুনঃজাগরণে সহৃদয় ব্যক্তিবর্গের সাহায্য ও সহযোগিতার হাত প্রশস্ত হয়। বিদ্যালয়টি ধীরে ধীরে পরিচালনা করা সহজতর হয়ে পড়ে।
স্বাধীনতাত্তোরকালে প্রাথমিক পর্যায়ে বিধ্বস্ত বিদ্যালয়টি আশু পরিচালনার জন্য এই দূরদর্শী পরিচালক মরহুম শিক্ষক ৩৫ বছর আগে স্কুলের একটি স্বরণীকায় লিখেছেন-“প্রাক্তণ ছাত্র বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জনাব শেখ বেলাল উদ্দীন বিলু এর দানকৃত যৎ সামান্য অর্থ দিয়ে বিদ্যালয়ের ঘড়ি, ঘন্টা, খাতাপত্র ডাস্টার সহ কিছু উপকরণ ক্রয়পূর্বক পুনঃপরিচালনা করা সম্ভব হয়। বিদ্যালয়টির গুণগত বৈশিষ্ট্য বিচারপূর্বক দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়”। এসব উদ্যোগ সফল হয়েছিল সদাশয় হেডমাস্টার মোহাম্মদ আমজাদ আলীর একান্ত প্রচেষ্টায়।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মরহুম হেডমাস্টার মোহাম্মদ আমজাদ আলীকে নিয়ে সাধ্যপর লেখার সক্ষমতা আমার নেই। তবুও তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দৃঢ়চিত্তে বলতে পারি, আপনি মানুষ গড়ার সফল কারিগর, আদর্শ শিক্ষক, আপনি পরপারে ভাল থাকুন। “মহান রাব্বুল আলামিন সবার প্রিয় এই মানুষটিকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন”। আমিন।  
লেখক : এনজিও শিক্ষক, কবি ও সমাজসেবী।

্রিন্ট

আরও সংবদ