খুলনা | শনিবার | ২১ জুন ২০২৫ | ৭ আষাঢ় ১৪৩২

সাবেক প্রতিমন্ত্রী মন্নুজানের ‘পুত্র’ হিসেবে পরিচিত

খুলনার শ্রম দপ্তরের সাবেক পরিচালক মিজানের ঘুষ গ্রহণ ও দুর্নীতির তদন্ত শুরু

এন আই রকি |
০১:৩৬ এ.এম | ৩১ অক্টোবর ২০২৪


খুলনা বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের সাবেক পরিচালক মিজানুর রহমানের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়েছে। তিনি খুলনা-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের আস্থাভাজন হিসেবে খুলনায় ১৭ বছর রাজত্ব করেছেন। গত বছর জেষ্ঠ্যতা লঙ্ঘন করে আধিপত্যের মাধ্যমে তিনি পরিচালক হয়েছিলেন। পাশাপাশি খুলনায় চাকুরির সুবাদে তিনি মিল দখলে সহযোগিতা, মুজগুন্নি আবাসিক এলাকায় বহুতল বাড়ি, ঘুষের বিনিময়ে ট্রেড ইউনিয়নগুলো নিয়ন্ত্রণসহ অফিসের কর্মচারিদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের মত অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। 
গত ৫ আগস্টের পর মিজানুর রহমানের এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বিভাগীয় শ্রম দপ্তরে অবস্থান কর্মসূচি এবং জেলা প্রশাসকের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করেন খুলনার শ্রমিকরা। পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও মিজানের স্বেচ্ছাচারিতার বিচারের দাবি জানায়। যার প্রেক্ষিতে গত ৯ অক্টোবর মিজানুর রহমানকে খুলনা থেকে গাজীপুরের টঙ্গী শিল্প সম্পর্ক শিক্ষায়তনে বদলি করা হয়। 
এর আগে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহকারি সচিব কামরুন নাহার শ্রম অধিদপ্তর খুলনার সাবেক পরিচালক মিজানের বিরুদ্ধে আনীত নানান অভিযোগ তদন্তের জন্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ মুনির হোসেন খানকে তদন্তের নির্দেশ দেন। আগামী ৮ নভেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।  
জানা যায়, খুলনার এ্যাজাক্স জুট মিলের চেয়ারম্যান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা মিজানের বিরুদ্ধে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিবের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন। 
অভিযোগে উলে­খ করা হয়েছে, খুলনা-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের আস্থাভাজন হিসেবে মিজানুর রহমান খুলনায় ১৭ বছর রাজত্ব করেছেন। নগরীর খানজাহান আলী থানা এলাকায় এ্যাজাক্স জুট মিলটি দখল করতে সহযোগিতা করেন মিজান। মিলটি আ’লীগের আমলে বছরের পর বছর দখল করে সরকারি সার রাখার গোডাউন হিসেবে ভাড়া দেওয়া হতো। এই ঘটনার নেপথ্যে ছিল সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের ভাই শাহাবুদ্দিন এবং খানজাহান আলী থানা যুবলীগ নেতা সাল সাজ্জাদুর রহমান লিংকন। মিজান তৎকালীন জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মিলটি লিংকন গংদের দখল করতে সহযোগিতা করতেন। যার কারণে প্রতি মাসে মিজানকে লাখ লাখ টাকা বকশিশ দেওয়া হতো।  
এছাড়া মিজানুর রহমান তিনি ক্ষমতার প্রভাবে মুজগুন্নি এলাকায় একটি প্লট নিয়ে সেখানে বহুতল ভবন করেছেন। মিজানের মা এবং স্ত্রীর নামে এফডিআরসহ শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়ের নামে ঢাকায় বেনামে ফ্লাট কিনেছেন। সাবেক প্রতিমন্ত্রীর প্রভাবে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘণ করে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ১৫ জনকে টপকে উপ-পরিচালক থেকে পরিচালক পদে পদোন্নতি নিয়েছেন। 
আরও জানা যায়, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং কল-কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন এবং বার্ষিক রিটার্ন দাখিলের সময় মোটা অংকের ঘুষ নিতেন মিজানুর রহমান। সিএন্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশনের ট্রেড ইউনিয়নগুলো থেকেও তিনি বাণিজ্য করতেন। সাবেক প্রতিমন্ত্রীর পুত্র সেজে তিনটি গাড়ি ব্যবহার করতেন মিজান। এছাড়া ভুয়া বিলের মাধ্যমে জ্বালানীর ব্যয় মিটিয়ে অবশিষ্ট টাকা আত্মসাৎ করতেন। গাড়িগুলোর চালকদের বিনিময়ে ভুয়া টিএ বিল দিতেন তিনি। অভিযোগে আরও উলে­খ করা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি বানানোর জন্য তিনি ঘুষ বাণিজ্য করেছেন। এসব কাজে মিজানের সহযোগী করতেন শ্রম দপ্তরের গণেশ, সোবহান, নাজমুল এবং রাজ্জাক। এছাড়া অফিসের দুই জন কর্মচারীকে তিনি অফিসের কাজের বাইরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজে ব্যবহার করতেন। 
খালিশপুর জুট মিলের শ্রমিক নেতা মোঃ মনিরুজ্জামান বলেন বলেন, মিজানুর রহমান প্রভাব খাটিয়ে পরিচালক পদ জুটিয়েছেন। তিনি খুলনার বেশির ভাগ ট্রেড ইউনিয়নগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন। নেতা নির্বাচিত করার আশ্বাসে মোটা অংকের অর্থ লেনদেন করতেন। তিনি তার ভাইয়ের নামে খালিশপুর এলাকায় একটি বাড়ি কিনেছেন। কারণ তার ভাই যে চাকুরি করে সেই বেতন ভরণপোষণের পর বাড়ি কেনা সম্ভব না। মিজানের  ক্ষমতার কারণে আগে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। তবে ৫ আগস্টের পর অনেক ট্রেড ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে। 
এ্যাজাক্স জুট মিলের চেয়ারম্যান কাওসার জামান বাবলা জানান, মিজান তার প্রভাব খাটিয়ে তৎকালীন খুলনা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে আমার মিল দখলে সহযোগিতা করে। মিলে সরকারি সার রেখে গোডাইন হিসেবে  ভাড়া দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করেছে একটি চক্র। সাবেক প্রতিমন্ত্রী মন্নুজানের সহযোগিতায় তার আপন ভাই শাহাবুদ্দিন এবং যুবলীগ নেতা লিংকন মিলটি গোডাউন হিসেবে ভাড়া দিতো। মিজান তাদের সহযোগিতা করার জন্য প্রতি মাসে মিজানকে লাখ লাখ টাকা মাসোয়ারা দেওয়া হতো। তাছাড়া মুজগুন্নি এলাকায় তার জমি ও বাড়ি আছে। যা তার আয়ের সাথে সামঞ্জস্য নয়।
খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম বেবী অভিযোগ করেন, ইউনিয়নের নির্বাচন জিম্মি করে রেখেছিলেন মিজান। আ’লীগের পছন্দের ব্যক্তিদের পাতানো নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে তাদের নির্বাচিত করতেন। এর জন্য মিজান আর্থিকভাবে লাভবানও হয়েছেন।
এই বিষয়ে মিজানুর রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধে আজগুবি অভিযোগ করা হয়েছে। মিলে ২ লাখ টাকা প্রতি মাসে ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি কখনই সম্ভব নয়। বাড়িটি তার এবং স্ত্রী’র সরকারি চাকুরির লোনের টাকায় করা। পদোন্নতির বিষয়ে কোন প্রভাব দেখানো হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী সব হয়েছে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের বাড়ি খুলনায় এবং তিনি এখানে দায়িত্ব থাকায় সখ্যতা ছিল। এর বাইরে আর কোন সম্পর্ক নেই। আপাতত এইসব বিষয়ে আর কথা বলতে চাচ্ছি না। তদন্ত হলেই সব জানা যাবে। আমি আমার ব্যাখ্যা তদন্তকারী কর্মকর্তাকে জানাবো।

্রিন্ট

আরও সংবদ