খুলনা | মঙ্গলবার | ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলি চালানো ৭৪৭ পুলিশ চিহ্নিত

খবর প্রতিবেদন |
০১:২৫ এ.এম | ০৪ নভেম্বর ২০২৪


বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামে প্রাণঘাতী অস্ত্র থেকে গুলিবর্ষণকারী পুলিশ সদস্যদের তালিকা হচ্ছে। ইতোমধ্যে পুলিশের অন্তত ৭৪৭ সদস্যকে চিহ্নিত করা হয়েছে।  
কনস্টেবল থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদমর্যাদার এসব কর্মকর্তা গত ১৮ থেকে ২১ জুলাই গুলি করেছেন। তালিকাটি যাচাই-বাছাই করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
খবর অনুযায়ী, ওই চার দিনে হতাহতের ঘটনায় পুলিশের করা মামলাগুলোর এজাহার থেকেই গুলিবর্ষণকারী পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা গুলি করার ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম মানেননি। গুলি করার নির্দেশদাতা বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। 
সূত্র বলেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ১৮ জুলাই সারা দেশে ‘কমপি¬ট শাটডাউন’ আহŸান করেছিল। ১৮ থেকে ২১ জুলাই, এ চার দিনে দেশে সবচেয়ে বেশি গুলি চলে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে। পুলিশের ৩৫৭ সদস্য এ সময় প্রায় ৮ হাজার প্রাণঘাতী গুলি করেন। এতে অনেক বিক্ষোভকারী নিহত এবং কয়েকশ’ আহত হয়। 
শনিবার (২ নভেম্বর) পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোঃ ময়নুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, অতি বলপ্রয়োগকারী পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা অনেকের সংশ্লি¬ষ্টতার বিষয়ে তদন্ত করছে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ১৮ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত ১৫০ জনের বেশি নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় অন্তত ১১৫টি মামলা হয়। এগুলোর মধ্যে ১০০টির এজাহার পর্যালোচনা করে ‘লয়ার ফর এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ নামে আইনজীবীদের একটি সংগঠন। সেই পর্যালোচনার একটি প্রতিবেদন সংগঠনটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থাকে দিয়েছে। সেখানেই ওই চার দিনে প্রাণঘাতী গুলিবর্ষণকারী পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে তালিকা করা হয়েছে।
লয়ার ফর এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের অন্যতম সংগঠক আব্দুল¬াহ আবু নোমান বলেন, ১৮-২১ জুলাইয়ের ঘটনায় পুলিশের করা মামলাগুলোর এজাহারে গুলিবর্ষণকারী পুলিশ সদস্যদের নাম ও গুলির পরিমাণ উলে­¬খ করা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছিল অজ্ঞাতনামা সাধারণ শিক্ষার্থীদের। মামলাগুলোতে তখন বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার সেই মামলাগুলো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। 
ওই তালিকা বিশে¬ষণ করে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের ওপর গুলিবর্ষণকারী হিসেবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ৭৫৪ জন সদস্যকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে পুলিশ সদস্য হলেন ৭৪৭ জন। যাদের মধ্যে কনস্টেবল ৪৬৭ জন, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) ১০৬, উপ-পরিদর্শক (এসআই) ১৫৭, পরিদর্শক দু’জন এবং এএসপি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা রয়েছেন। বাকি ১৪ জন পুলিশের নায়েব, সুবেদার ও চালক।
জানা যায়, ১৮-২১ জুলাই ঢাকা মহানগর পুলিশের ১২টি থানা ও চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ১০টি থানা এলাকায় ছাত্র-জনতার ওপর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ ও নির্বিচার গুলিবর্ষণের অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। পুলিশ প্রাণঘাতী গুলি, রাবার বুলেটসহ অন্তত ২৬ হাজার ২৩টি গুলি ছোড়ে। এর মধ্যে শটগানের শিসা কার্তুজ ১২ হাজার ৩৪০টি, চীনের সেভেন পয়েন্ট সিক্সটু এম এম, এসএমজি, টরাস নাইন এম এম ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি ৪ হাজার ৩১৬টি, পিস্তলের গুলি ২৫৬টি, ৮ হাজার ৯৯৪টি রাবার বুলেট, ১৬টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ৯৮৪টি সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার গ্রেনেড, মাল্টি ইম্প্যাক্ট, কাইনেটিভ ও ভারী বল কার্তুজ রয়েছে। এসব ছুড়েছেন ৭৪৭ জন পুলিশ সদস্যসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ৭৫৪ সদস্য। এর মধ্যে প্রাণঘাতী গুলি ছিল ১৬ হাজার ৯১২টি।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সূত্র বলছে, আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করার ক্ষেত্রে শটগান, পিস্তল ও চায়নিজ রাইফেলের ব্যবহার বেশি হয়েছে। কোথাও কোথাও এসএমজি (সাব-মেশিনগান) ও এলএমজির (লাইট মেশিনগান) মতো অস্ত্রও ব্যবহৃত হয়েছে। এসব অস্ত্র বাংলাদেশ পুলিশ ব্যবহার করে। এই চার দিনে নিহত ১২০ জনের মৃত্যুর তথ্য বিশে¬ষণ করে দেখা গেছে, ৯৭ জনের শরীরে প্রাণঘাতী গুলির চিহ্ন ছিল। তাঁদের অনেকে ‘এইম ফায়ার’ বা লক্ষ্যবস্তু করে গুলির শিকার হয়েছেন।
পুলিশের দাবি, আত্মরক্ষার্থে গুলি করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ সদস্য বলেন, তারা চাইলেই গুলি করতে পারেন না। ওপর থেকে নির্দেশনা না দিলে গুলি করা যায় না। আবার নির্দেশ না মানলেও পুলিশের চাকুরি থাকে না। তাহলে মাঠের পুলিশ সদস্যদের করণীয় কী ছিল?
পুলিশ প্রবিধানের ১৫৩ ধারা অনুযায়ী, তিন ক্ষেত্রে পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে। এগুলো হলো ব্যক্তির আত্মরক্ষা ও সম্পদ রক্ষার অধিকার প্রয়োগ, বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করা ও গ্রেফতার কার্যকর করার জন্য। এ ছাড়া দণ্ডবিধির ১০২ ধারা অনুযায়ী, যখনই ক্ষতির আশঙ্কা শেষ হবে, তখন আত্মরক্ষার জন্য শক্তি প্রয়োগের অধিকারও শেষ হবে। অভিযোগ রয়েছে, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর গুলিবর্ষণের ক্ষেত্রে এসব নিয়ম মানেননি পুলিশ সদস্যরা। এ কারণে প্রাণহানিও অনেক বেশি হয়েছে।
সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে গুলি করা পুলিশের কাজ নয়। এই আন্দোলন দমন করতে গিয়ে পুলিশ বেশ কিছু অপেশাদার কাজ করে ফেলেছে।

্রিন্ট

আরও সংবদ