খুলনা | বুধবার | ২২ জানুয়ারী ২০২৫ | ৯ মাঘ ১৪৩১

পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম উষ্ণ সাল ২০২৪-কে মনে হবে সবচেয়ে ‘শীতলতম’ বছরও: গবেষণা

খবর প্রতিবেদন |
০৪:৪৪ পি.এম | ২১ ডিসেম্বর ২০২৪


পৃথিবীর ইতিহাসে অতীতের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে আরও একটি বছর। ২০২৪ সাল প্রায় শেষের দিকে। আর এ সময়ে এসে বিজ্ঞানীরা আবারও একটি ভয়াবহ জলবায়ু সতর্কবার্তা নিয়ে হাজির হয়েছেন। ২০২৪ সাল প্রায় নিশ্চিতভাবে রেকর্ড করা সবচেয়ে উষ্ণ বছর হতে চলেছে। বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় কর্তৃপক্ষের মতে, ২০২৪ সাল হবে সেই বছর যখন পৃথিবী প্রথমবারের মতো প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে নির্ধারিত ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সীমা অতিক্রম করবে।

তবে বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভবিষ্যতে আপনি হয়তো ২০২৪ সালকে বিশেষভাবে উষ্ণ বছর হিসেবে মনে রাখবেন না। কারণ, এটিই সম্ভবত হবে আপনার জীবনের বাকি সময়ের তুলনায় সবচেয়ে শীতল বছরগুলোর একটি। অর্থাৎ, আগামী দিনে পৃথিবীর তাপমাত্রা এমন একপর্যায়ে পৌঁছে যাবে, যার তুলনায় ২০২৪ সালকে মনে হবে শীতলতম বছর।

মানবজাতি জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে পৃথিবীকে ক্রমেই উষ্ণ করে তুলছে। আর এরই ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতের আপনি বর্তমান সময়কে তুলনামূলকভাবে শান্ত আবহাওয়া, তুষারপূর্ণ শীত এবং কোমল তাপমাত্রার সময় হিসেবে স্মরণ করবেন। আজ জন্ম নেওয়া শিশুদের কাছে ভবিষ্যতের উষ্ণতর, ঝোড়ো জলবায়ুর অবস্থা স্বাভাবিক বলে মনে হবে।

এমনটা ঘটবে মূলত একটি মনস্তাত্ত্বিক কৌশলের কারণে। যাকে বিজ্ঞানীরা ‘শিফটিং বেসলাইন সিনড্রোম’ বলে ডাকেন। এটি মানুষকে বর্তমানে তারা যে পরিবেশগত পরিস্থিতি অনুভব করছে তার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে বাধ্য করে। এই বিষয়টি মানব সমাজের বিদ্যমান পরিবেশগত মানগুলো ধীরে ধীরে কমতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শিফটিং বেসলাইন সিনড্রোম ক্রমবর্ধমান উষ্ণ তাপমাত্রা এবং অন্যান্য পরিবেশগত প্রভাবগুলোকে মানুষের কাছে স্বাভাবিক মনে করাতে পারে।

কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন এটি একটি গুরুতর সমস্যা। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায়োগিক পরিবেশবিদ মাসাশি সোগা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যার সমাধান করতে হলে ব্যক্তিগত এবং সম্মিলিত আচরণে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। শিফটিং বেসলাইন সিনড্রোম একটি শক্তিশালী বাধা হিসেবে কাজ করতে পারে, কারণ এটি সমস্যার প্রতি সামাজিক স্বীকৃতি কমিয়ে দেয়।’

এক বছর আগে, ২০২৩ সালে জলবায়ু বিজ্ঞানীরা এক নতুন তাপমাত্রা রেকর্ড নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। ২০২৩ ছিল কেবল গত ১৭৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ বছরই নয় বরং এটি ছিল ২০১৬ সালের তুলনায় প্রায় দশমিক ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ। আমাদের গ্রহের প্রেক্ষাপটে, এটি একটি বড় বৃদ্ধি হিসেবে বিবেচিত। ২০২৪ সাল আরও উষ্ণ হওয়া প্রায় নিশ্চিত।

নাসার গডার্ড ইনস্টিটিউট ফর স্পেস স্টাডিজের পরিচালক গ্যাভিন স্মিড বলেন, ‘শেষ দুই বছর ছিল কিছুটা সুপারচার্জড বা মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির বছর।’ গডার্ড ইনস্টিটিউট ফর স্পেস স্টাডিজ হাজারো আবহাওয়া স্টেশন, সামুদ্রিক বয়া এবং জাহাজ ব্যবহার করে বিশ্বের তাপমাত্রার রেকর্ড হিসাব করে। স্মিড বলেন, ‘১৯৭০—এর দশক থেকে তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ছে এবং গত দশক থেকে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু ২০২৩ এবং ২৪ সত্যিই আলাদা।’

স্মিডের মতে, এর আংশিক কারণ হলো—এল নিনো। যার কারণে প্রশান্ত মহাসাগরের ক্রান্তীয় অঞ্চলের উষ্ণতা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি হয় এবং আবহাওয়ার ওপর প্রভাব ফেলে। তবে স্মিড বলেন, এটি মানুষের সৃষ্টি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ত্বরান্বিত হওয়ার ইঙ্গিতও দেয়। কারণ, আমরা ক্রমাগত গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধি করেই যাচ্ছি।

যাই হোক, যত দিন মানুষ বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড যোগ করতে থাকবে, তত দিন তাপমাত্রা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। স্মিড বলেন, ‘পরবর্তী দশকের মধ্যে পৃথিবী সম্ভবত ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতার সীমা স্থায়ীভাবে অতিক্রম করবে। যার অর্থ হলো, পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় পুরো বছর ধরেই স্বাভাবিকের তুলনায় ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকবে। এরপর থেকে ভবিষ্যতের পৃথিবী আরও উষ্ণতর হয়ে উঠবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি, বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন—আমরা আরও চরম বৃষ্টিপাত, অতিরিক্ত উষ্ণ দিন এবং দাবানল-খরার মতো জলবায়ু-সম্পর্কিত দুর্যোগগুলো বৃদ্ধি পেতে দেখব। প্রতিটি দশমিক ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব ঘটনাবলি আরও তীব্র ও শক্তিশালী হবে।’

পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থার পরিবর্তন গভীর হলেও জরিপে দেখা গেছে, বেশির ভাগ আমেরিকান এই গ্রহগত সংকট নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নন। কেউ কেউ এখনো জলবায়ু পরিবর্তনের মৌলিক তথ্যকেই অস্বীকার করেন। তবে বেশির ভাগ আমেরিকান—যারা মানবসৃষ্ট উষ্ণায়নকে স্বীকার করেন—তাদের মধ্যে সামাজিক ও মানসিক বিভিন্ন কারণ, যেমন: শিফটিং বেসলাইন সিনড্রোম তাদের উদ্বেগ কমিয়ে দিতে পারে।

শিফটিং বেসলাইন সিনড্রোম ধারণাটি প্রথম ১৯৯০—এর দশকে মৎস্যসম্পদ সংক্রান্ত প্রসঙ্গে বিকশিত হয়েছিল। গবেষকেরা দেখতে পান যে, তরুণ মৎস্যজীবীরা বর্তমান মাছের মজুতকে স্বাভাবিক মনে করেন, যদিও প্রবীণ প্রজন্ম তা তীব্র হ্রাস হিসেবে বিবেচনা করতেন। এরপর থেকে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে—জীববৈচিত্র্য থেকে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য পর্যন্ত—দেখেছেন, তরুণ প্রজন্ম সাধারণত তাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের তুলনায় পরিবেশ নিয়ে কম প্রত্যাশা রাখে।

টোকি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাসাশি সোগা বলেন, ‘সিদ্ধান্তগতভাবে, শিফটিং বেসলাইন সিনড্রোম সব পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের জন্য প্রাসঙ্গিক। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনও আছে।’ প্রজন্মান্তরে পরিবেশগত বিষয়ে শিফটিং বেসলাইন কীভাবে পরিবর্তিত হয় তা নিয়ে সাম্প্রতিক একটি পর্যালোচনাপত্রে সোগা ও তার সহকর্মীরা দেখেছেন যে, ‘অনেক গবেষণায়’ এটি উঠে এসেছে যে—মানুষ ধীরে ধীরে জলবায়ুর পরিবর্তন লক্ষ্য করতে সংগ্রাম করে।

সোগা বলেন, ‘তরুণেরা প্রবীণদের তুলনায়, সাধারণত বৃষ্টিপাত বা তাপমাত্রা বৃদ্ধির মতো আবহাওয়ার পরিবর্তন কম অনুভব করে।’ এই গবেষণাগুলোর বেশির ভাগই নিম্নআয়ের দেশগুলোতে পরিচালিত হয়েছে এবং অনেকটাই কৃষকদের ওপর ভিত্তি করে। সোগার ধারণা, ধনী দেশগুলোর মানুষ সম্ভবত শিফটিং বেসলাইনস সিনড্রোম দিয়ে আরও বেশি প্রভাবিত। কারণ, তারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর সরাসরি মুখোমুখি হন কম।

যদিও প্রজন্মান্তরে জলবায়ুর বেসলাইন পরিবর্তনের ব্যাপক প্রমাণ রয়েছে, মানুষের জীবনকাল ধরে পরিবর্তনগুলো কতটা স্বাভাবিক হচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, আবহাওয়াসংক্রান্ত টুইটগুলোতে ব্যবহারকারীরা কয়েক বছর ধরে চরম গরম বা ঠান্ডা অনুভব করলেও তা উল্লেখযোগ্য বলে মনে করেনি। তবে সাম্প্রতিক আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকানরা চরম গরমের বিষয়ে আরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছেন—এবং তারা যে গরম, শুষ্ক আবহাওয়ার সম্মুখীন হচ্ছেন তা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সংযুক্ত করছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাইমেট চেঞ্জ কমিউনিকেশন সেন্টারের পরিচালক এড মাইব্যাচ বলেন, ‘আমাদের গবেষণার ভিত্তিতে, মানুষ বুঝতে পারে যে—তারা যেখানে বাস করে সেখানকার আবহাওয়া সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে।’

সোগার মতো বিজ্ঞানীরা চিন্তিত যে, শিফটিং বেসলাইন সিনড্রোম জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় মানুষের যে অগ্রগতি সেটিকে থামিয়ে দিতে পারে। তাঁর মতে, যদি একটি অক্ষত পরিবেশের ধারণা সময়ের সঙ্গে আমাদের যৌথ উপলব্ধি থেকে বিলীন হয়ে যায়, তাহলে তা উচ্চাকাঙ্ক্ষী সংরক্ষণ নীতির প্রতি সমর্থন কমাতে পারে এবং আইনপ্রণেতাদের দুর্বল লক্ষ্য নির্ধারণে প্ররোচিত করতে পারে। এটি মানুষের নিজেদের পদক্ষেপ নেওয়ার ইচ্ছাকেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তিনি বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে, যারা পরিবেশগত অবক্ষয়কে তীব্রভাবে অনুভব করেন তারা সংরক্ষণমূলক কাজ করতে আরও বেশি প্রভাবিত হন।’

তবে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সান ডিয়েগোর ক্লাইমেট সাইকোলজি অ্যান্ড অ্যাকশন ল্যাবের পরিচালক অ্যাডাম অ্যারন সন্দেহ করেন যে, পরিবেশের পরিবর্তনের বিষয়ে বিস্মৃতিই মূলত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য গণপ্রচেষ্টার অভাবের প্রধান কারণ। এমন জায়গাগুলোতেও যেখানে অনেকে জানেন যে, একটি সংকট চলছে, সেখানেও মানুষ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছেন না বা নির্বাচিত কর্মকর্তাদের করতে বলছেন না।

মানুষের শুধু জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো নয়, আচরণ পরিবর্তনের জন্য ‘অ্যানালিটিক নয়’ এমন একটি পদ্ধতির প্রয়োজন বলে মনে করেন অ্যারন। তিনি বলেন, ‘অ্যানালিটিক নয় এমন উপায় হলো—সামাজিক রীতিনীতির প্রভাব।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমার আশপাশের মানুষ—আমার স্ত্রী, আমার স্বামী, আমার প্রতিবেশী—এগুলো করছে। আমার প্রতিবেশীরা সবাই সোলার প্যানেল লাগিয়েছে এবং তাদের ঘর বিদ্যুতায়িত করেছে। আমিও এটা করব।’
তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফি

্রিন্ট

আরও সংবদ