খুলনা | বৃহস্পতিবার | ০২ জানুয়ারী ২০২৫ | ১৯ পৌষ ১৪৩১

সাত দিনে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা

দক্ষিণ কোরিয়ায় বিমান দুর্ঘটনা : পাখির কারণে ল্যান্ডিং গিয়ারের ত্রুটি, গেল ১৭৯ জনের প্রাণ

খবর প্রতিবেদন |
০১:০১ এ.এম | ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪


দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু এয়ারের একটি উড়োজাহাজ ১৭৫ যাত্রী, ৬ ক্রুসহ মোট ১৮১ আরোহী নিয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত দু’জনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বাকিরা সবাই নিহত হয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দেশটির ইতিহাসে এত বড় উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা এটাই প্রথম।  স্থানীয় সময় রোববার সকালে এ দুর্ঘটনা ঘটে। 
ধারণা করা হচ্ছে, বিমানটিতে পাখির কারণে ল্যান্ডিং গিয়ারে ত্র“টির কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এ সময় বিমানটিতে মোট ১৭৫ জন যাত্রী ও ছয় জন ক্রু ছিলেন। 
জেজু এয়ারের উড়োজাহাজটি বোয়িংয়ের ৭৩৭-৮০০ মডেলের। সুলভ টিকিটের এই পরিবহন সংস্থার উড়োজাহাজটি ব্যাংকক থেকে এসেছিল। গন্তব্য ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দরে রোববার সকাল ৯টার একটু পর অবতরণের প্রথম চেষ্টার সময় নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে উড়োজাহাজটিকে পাখির আঘাতের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল।
আরও কয়েক মিনিট পর উড়োজাহাজটির পাইলট ‘মে-ডে’ (বিপন্ন অবস্থা) সতর্কসংকেত ব্যবহার করেন। এরপর উড়োজাহাজটি আবার অবতরণের চেষ্টা করে। এ ঘটনার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গিয়ার চালু না করে উড়োজাহাজটি ইঞ্জিনের দিক বা শেষের অংশ (বেলি ল্যান্ডিং) দিয়ে অবতরণের চেষ্টা করছে।
নাটকীয় সেই ভিডিওতে আরও দেখা যায়, উড়োজাহাজটি রানওয়েতে এঁকে বেঁকে ছুটছে এবং এর শেষ অংশ থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। রানওয়ে থেকে ছিটকে উড়োজাহাজটি একটি দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হয়ে এতে আগুন ধরে যায়।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ইয়ুনহাপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যে যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে কর্তৃপক্ষের মতে, বিমানটির ল্যান্ডিং গিয়ারে ত্রুটি দেখা দেওয়ার পর হয়তো বিমানটি ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করতে বাধ্য হয়। তবে স্থানীয় অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার প্রধানের অনুমান, সম্ভবত পাখির সংঘর্ষ এবং খারাপ আবহাওয়ার কারণে বিমানটি দুর্ঘটনায় পড়েছিল। স্থানীয় সময় রোববার সকালে একটি যাত্রীবাহী বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে ছিটকে গিয়ে পাশের দেয়ালে আঘাত হানলে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। 
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেজু এয়ারের ফ্লাইট ৭ সি-২২১৬ স্থানীয় সময় রোববার সকাল ৯টা ৭ মিনিটে মুয়ান বিমানবন্দরে অবতরণের সময় এ দুর্ঘটনার শিকার হয়। উদ্ধারকারীরা দু’জনকে জীবিত উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন।
বিমান বন্দরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ার পর বিমানটি দেয়ালে আঘাত করলে সঙ্গে সঙ্গেই আগুন ধরে যায়। 
স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, বিমানটির ল্যান্ডিং গিয়ার কাজ না করায় এটি রানওয়ে বরাবর অনেক দূর পর্যন্ত ছেঁচড়ে যায় এবং দেয়ালে আঘাতের ফলে বিমানটিতে আগুন ধরে যায় এবং এর ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দিকে।
মুয়ান বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিমানের অবতরণ গিয়ার বা ল্যান্ডিং গিয়ারে ত্র“টির কারণে এটি ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করার চেষ্টা করে এবং তখনই দুর্ঘটনাটি ঘটে। তাঁরা আরও জানিয়েছেন, প্রথমবার বিমানটি অবতরণ করতে ব্যর্থ হয় এবং এরপর বিমানটি ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করতে বাধ্য হয়। কর্তৃপক্ষের মতে, বিমানটি সম্ভবত রানওয়েতে নামার পর গতি কমাতে ব্যর্থ হয় এবং শেষ পর্যন্ত বিমানবন্দরের বাইরের প্রান্তের দেওয়ালের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে।
উদ্ধার কাজে সেনাসদস্যসহ কয়েকশ’ অগ্নিনির্বাপণ ও অন্যান্য জরুরি বিভাগের কর্মীরা অংশ নিয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট দুর্ঘটনাস্থলকে বিশেষ দুর্যোগ এলাকা ঘোষণা করেছেন।
কর্তৃপক্ষগুলো জানিয়েছে, ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা মুয়ান বিমান বন্দরের প্রথম তলায় অপেক্ষা করছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার ফলে বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। তারা জানিয়েছেন, বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ারের টায়ারগুলো খাপ থেকে বের হয়ে আসতে দেখা যায়নি। এ কারণেই সম্ভবত পাইলট বিমানটিকে ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করানোর প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, পাখির সংঘর্ষের কারণেই ল্যান্ডিং গিয়ারে ত্র“টি দেখা দিয়েছিল।
স্থানীয় মুয়ান ফায়ার স্টেশনের প্রধান লি জং-হিউন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘দুর্ঘটনার কারণ হিসাবে অনুমান করা হচ্ছে, একটি পাখির আঘাত এবং খারাপ আবহাওয়া। তবে, সঠিক কারণ জানতে যৌথ তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষেই আসল কারণ জানানো হবে।’
উলে­খ্য, দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে এই দুর্ঘটনা ঘটল। শুক্রবার নতুন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করা চোই সুং-মোক এই প্রথম এমন একটি জাতীয় সংকট মোকাবিলা করছেন। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। উদ্ধার কাজ শেষ হলে নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত করে তাঁদের পরিবারের কাছে খবর দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
এদিকে, দুর্ঘটনার পর দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে কম খরচের বিমান পরিবহন সংস্থা জেজু এয়ার ক্ষমা চেয়েছে। তারা জানিয়েছে, তারা এই দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট সবাইকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। এক বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে, ‘জেজু এয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা এ দুর্ঘটনার জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করছি। আমরা এ ঘটনায় সম্ভাব্য সবকিছু করার প্রতিশ্র“তি দিচ্ছি। উদ্বেগের কারণ হওয়ায় আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’
এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট চোই সাং-মোক সর্বাত্মক উদ্ধার প্রচেষ্টার নির্দেশ দিয়েছেন। তার চিফ অব স্টাফও এই ঘটনা নিয়ে জরুরি বৈঠক ডেকেছেন। পাখির সঙ্গে সংঘর্ষের জেরে ল্যান্ডিং গিয়ারে ত্র“টির কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পাখির আঘাত কতটা ভয়ঙ্কর : উড়োজাহাজে পাখির আঘাত বলতে কোনোর পাখির সঙ্গে চলন্ত উড়োজাহাজের সংঘাতকে বোঝায়। পাখির আঘাত উড়োজাহাজের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক হিসেবে দেখা দিতে পারে।
জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইসিএও) মনে করে, ইঞ্জিনে পাখি ঢুকে গেলে উড়োজাহাজ শক্তি হারিয়ে ফেলতে পারে, যা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। পাখির আঘাতের কারণে সারা বিশ্বে অনেক ভয়াবহ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
পাখির আঘাতের কারণে ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারওয়েজ এয়ারবাসের এ৩২০ মডেলের একটি উড়োজাহাজ নিউইয়র্কের হাডসন নদীতে জরুরি ভিত্তিতে অবতরণ করেছিল। তখন উড়োজাহাজটির দুই ইঞ্জিনেই পাখি আঘাত করেছিল। কিন্তু কেউ মারা না যাওয়ায় এই দুর্ঘটনাকে ‘মিরাকল অন দ্য হাডসন’ বলা হয়।
নিরাপত্তা রেকর্ড : দক্ষিণ কোরিয়ার উড়োজাহাজ চলাচলের নিরাপত্তার রেকর্ড বেশ ভালো। জেজু এয়ারের কোনো উড়োজাহাজের বিধ্বস্ত হওয়ার এটাই প্রথম ঘটনা।
এর আগে জেজু এয়ারের বোম্বার্ডিয়ার কিউ৪০০ মডেলের একটি উড়োজাহাজ ৭৪ যাত্রী নিয়ে রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়েছিল। প্রবল বাতাস ছিল এ দুর্ঘটনার কারণ। দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের বুসান-গিমহে বিমানবন্দরে ২০০৭ সালের ১২ আগস্টের এই দুর্ঘটনায় অনেকে আহত হলেও কেউ নিহত হননি।
সরকারের উদ্যোগ : দক্ষিণ কোরিয়া স¤প্রতি গভীর রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এক মাসের মধ্যে দেশটি তিনজন প্রেসিডেন্ট দেখল। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট চোই সাং মক দায়িত্ব গ্রহণের তিন দিনের মাথায় রোববার এই দুর্ঘটনা ঘটল। উদ্ধার অভিযান ও অন্যান্য করণীয় নিয়ে আলোচনা করতে তিনি এরই মধ্যে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেছেন এবং দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘোষণা করা হয়েছে সাত দিনের শোক।

্রিন্ট

আরও সংবদ