খুলনা | বুধবার | ১৫ জানুয়ারী ২০২৫ | ২ মাঘ ১৪৩১

শেষ ৩ মাসে ৮ খুন : আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, আতঙ্কে নগরবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক |
০২:৩৪ এ.এম | ০১ জানুয়ারী ২০২৫


বছর শেষ দিকে আইন-শৃঙ্খলা অবনতিতে আতঙ্কে ভুগেছে খুলনার মানুষ। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নিষ্ক্রীয় হয়ে পড়ে পুলিশ। এই সুযোগে সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে সন্ত্রাসীরা। প্রায় প্রতি রাতে কোথাও না কোথাও চলছে সন্ত্রাসীদের মহড়া। গুলি করে কিংবা কুপিয়ে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। খোঁদ পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, বছরের শেষ ৩ মাসে মহানগরীসহ খুলনা জেলায় ৮টি হত্যাকান্ড হয়েছে।
গত ৯ ডিসেম্বর জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক নেতা নগরীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে, মাদক বিক্রি বেড়েছে। কিন্তু পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজেও ক্ষোভ প্রকাশ করে পুলিশ কর্মকর্তাদের আরও সক্রিয় হওয়ার নির্দেশনা দেন।
নগরীর টুটপাড়া এলাকায় গত ২৯ নভেম্বর রাতে সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এর পর তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ৩০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি’র সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক আমিন মোল­া বোয়িংকে গুরুতর আহত করে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আশিক বাহিনীর প্রধান আশিক, তার ভাই সজীবসহ ৯ জনের নাম উলে­খ করে খুলনা সদর থানায় মামলা করেন নিহতের ছোট ভাই মো. আবদুল­াহ। কিন্তু তাদের কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
নিহতের ভাতিজা ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি’র সভাপতি সালাউদ্দিন মোল­া বুলবুল বলেন, শত শত মানুষের সামনে সন্ত্রাসীরা গুলি করে ত্রাস সৃষ্টি করে কুপিয়ে চলে গেল, মামলা হলো, অথচ পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারল না!
গত ২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ডুমুরিয়া উপজেলার শরাফপুর বাজারে সন্ত্রাসীদের গুলিতে সবজি বিক্রেতা নাঈম সানা গুলিবিদ্ধ হন। ৩ ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে নগরীর নিরালা এলাকায় ১০-১৫টি মোটরসাইকেলে এসে একদল সন্ত্রাসী এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এতে পথচারী ইউনুস শেখ গুলিবিদ্ধ হন। এর পর সন্ত্রাসীরা চাঁনমারি এলাকায় গিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এ ছাড়া ওই এলাকার আব্দুল আহাদ হাওলাদার নামে এক যুবককে কুপিয়ে আহত করে।
৬ ডিসেম্বর বিকেলে রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ইমরান হোসেন মানিক নামে এক যুবক আহত হন। এর আগে ২ নভেম্বর রাতে নগরীর আলকাতরা মিল এলাকায় সন্ত্রাসীরা গুলি করে ও কুপিয়ে পঙ্গু রাসেল নামে এক সন্ত্রাসীকে হত্যা করে। এ সময় সজীব ও ইয়াসিন নামে দুই যুবককে কুপিয়ে আহত করে সন্ত্রাসীরা। একই রাতে নগরীর বাবু খান রোডে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে জেলা যুবদলের সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক হাবিবুর রহমান বেলালকে আহত করে।
নগরীর বসুপাড়া এলাকায় গত ৫ নভেম্বর রাতে অস্ত্রধারীরা রফিকুল ইসলাম মুক্তা নামে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে। গত ২৮ অক্টোবর দুপুরে সন্ত্রাসীরা গুলি করে ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নগরীর দৌলতপুর থানার কালীবাড়ি বাজারের দত্ত জুয়েলার্সে ডাকাতি করে। তারা জুয়েলার্স থেকে স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ ২ লাখ টাকা লুট করে পালিয়ে যায়।
গত ২১ অক্টোবর রাতে কয়রা উপজেলার কাটাখালী গ্রামে পুলিশের ওপর হামলা করে দুর্বৃত্তরা অপহরণ মামলার আসামি হারুন গাজীকে ছিনিয়ে নেয়। তাদের হামলায় পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন।
গত তিন মাসে জেলা ও নগরীতে আটটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। মোটরসাইকেলে সন্ত্রাসীদের মহড়ার ঘটনা ঘটেছে ১০-১১টি। নগরবাসীর অভিযোগ, নগরীতে আগের মতো পুলিশের টহল ও অভিযান দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া কারাগারে থাকা বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী জামিনে বেরিয়ে এসেছে। পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা এলাকায় ফিরেছে। সক্রিয় হয়ে উঠেছে তিন-চারটি কিশোর গ্যাং।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নগরীর জিন্নাহপাড়া, মোল­াপাড়া, লবণচরা ও শিপইয়ার্ড এলাকায় কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা দাবি করেছে সন্ত্রাসীরা। মাদক বেচাকেনাও বেড়েছে। এ ছাড়া আগে বড় কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশের যে তৎপরতা বা অভিযান থাকত, তাও ঝিমিয়ে পড়েছে।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব মোঃ বাবুল হাওলাদার বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর তৎপরতা ঝিমিয়ে পড়েছে। সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। তাদের মধ্যে এখন আগের মতো ভয় নেই। এর ফলে অস্ত্রের মহড়া ও হত্যাকাণ্ড বেড়েছে। মানুষ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে।
মহানগর বিএনপি গত ২৬ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে নগরীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পুলিশ কাজে ফিরলেও তাদের আচরণ ও ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে নগরীতে চুরি-ডাকাতি বেড়েছে।
মহানগর বিএনপি’র সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন বলেন, নগরীতে পুলিশ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। বিএনপি’র একজন নেতাকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য পুলিশের আরও সক্রিয় হওয়া দরকার।
তবে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) শেখ মনিরুজ্জামান মিঠু বলেন, মূলত মাদক বেচাকেনা-সংক্রান্ত বিরোধ এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এসব ঘটনা ঘটছে। সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়েছে এটা ঠিক, কিন্তু পুলিশের তৎপরতা মোটেও ঝিমিয়ে পড়েনি। আমরা নিয়মিত চেকপোস্ট বসিয়ে তল­াশি চালাচ্ছি। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অস্ত্রধারীদের ধরতে অভিযান পরিচালনা করছি। টহল কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে।

্রিন্ট

আরও সংবদ