খুলনা | রবিবার | ০৫ জানুয়ারী ২০২৫ | ২১ পৌষ ১৪৩১

বাংলাদেশি বলে উচ্ছেদ, ক্ষোভে ৪ বোন ও মাকে হত্যা ভারতীয় যুবকের

খবর প্রতিবেদন |
০১:৩৩ এ.এম | ০২ জানুয়ারী ২০২৫


ভারতের উত্তর প্রদেশের ল²ৌ শহরের নাকা এলাকার একটি হোটেলে এক হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটেছে। পারিবারিক বিরোধের জেরে এক যুবক তাঁর মা ও চার বোনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন। অভিযুক্ত ২৪ বছর বয়সী আরশাদ আগ্রার বাসিন্দা। ভয়াবহ এই হত্যার পর নিজেই একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন তিনি। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, তিনি মানসিক চাপ এবং পারিবারিক বিরোধের কারণে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। এ ঘটনা পুরো শহরের মানুষকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে।
তবে আরশাদ দাবি করেছেন, তাদেরকে নিজ বাড়ি থেকে বাংলাদেশি বলে উচ্ছেদ করেছে তাদের প্রতিবেশী ও মাফিয়ারা। তার শঙ্কা ছিল, তাকে ও তার বাবাকে মিথ্যা মামলায় ফাসিয়ে জেলে নিয়ে তার বোনদের বিক্রি করে দিতে পারে মাফিয়ারা। এমন শঙ্কা ও ক্ষোভ থেকে তিনি মা ও বোনদের হত্যা করেছেন।
ভিডিওতে আরশাদ বলেন, “প্রতিবেশীদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে আমাদের পরিবার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি আমার মা ও বোনদের হত্যা করেছি। যখন পুলিশ এ ভিডিও পাবে। তারা যেন জানে, এ ঘটনার জন্য প্রতিবেশীরা দায়ী। তারা বাড়ি দখলের জন্য আমাদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। আমরা এ নিয়ে আওয়াজ তুলেছি, কিন্তু কেউ শোনেনি। গত ১৫ দিন ধরে আমরা ফুটপাতে ঘুমাচ্ছি, ঠান্ডায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমরা চাইনি ছোট বোনেরা ঠান্ডায় কষ্ট পাক। তারা আমাদের বাড়ি দখল করেছে। কিন্তু বাড়ির দলিল আমাদের কাছে আছে।”
তিনি আরও বলেন, “রনু, আফতাব, আলিম খান, সেলিম, আরিফ, আহমেদ ও আজহার তারা সবাই ভূমিদস্যু, তারা মেয়েদের বিক্রিও করে দেয়। তারা আমার এবং বাবার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে আমার বোনদের বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। আমরা এটি চাইনি। তাই আমি তাদের শ্বাসরোধ ও কব্জি কেটে হত্যা করতে বাধ্য হয়েছি।”
আরশাদ ভিডিওতে তার মা ও বোনদের মরদেহ দেখিয়ে আরও বলেন, “আমি হয়তো সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকবো না। আমরা বুদাউনের বাসিন্দা। আমরা আন্টির কাছে প্রমাণ আছে। আমরা এখানে ১৯৪৭ সাল থেকে আছি। কিন্তু তারা আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ছড়ায়, আমরা নাকি বাংলাদেশি।”
এরপর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কাছে বিচার চান আরশাদ। তিনি বলেন, “আমরা অনেকের কাছে গেছি, কিন্তু কেউ সাহায্য করেনি। আমার বোনরা এখন মরে যাচ্ছে। আমিও একটু পর মরে যাব। কিন্তু ভারতের কোনো পরিবার যেন এমনটি করতে বাধ্য না হয়। আমি হাতজোড় করে বলছি, আমরা বেঁচে থাকতে বিচার পাইনি। কিন্তু মৃত্যুর পর বিচার নিশ্চিত করুন। তারা যেন সর্বোচ্চ শাস্তি পায়। তারা অনেক শক্তিশালী। তাদের সঙ্গে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের সম্পর্ক আছে।”
আরশাদ বলেন, তাদের বাড়িটিতে যেন এখন একটি মন্দির তৈরি করা হয় এবং বাড়ির জিনিসপত্রগুলো কোনো এতিমখানায় দিয়ে দেওয়া হয়। এই হত্যাকাণ্ডে তার সঙ্গে তার বাবাও ছিল বলে দাবি করেছে আরশাদ। 
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, ঘটনাটি ঘটেছে ল²ৌয়ের নাকা এলাকার হোটেল শরনজিতে। স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, হোটেলের একটি কামরায় আরশাদ তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন। রাতের অন্ধকারে সবাই যখন ঘুমাচ্ছিল তখন তিনি এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটান।
পুলিশ জানিয়েছে, এই ঘটনায় নিহতরা হলেন আরশাদের মা আসমা এবং তাঁর চার বোন আলিয়া (৯), আলশিয়া (১৯), আকসা (১৬) এবং রহমিন (১৮)।
লক্ষেèৗ পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (ডিসিপি) রাভিনা ত্যাগী বলেছেন, ‘অভিযুক্ত আরশাদ নিজের পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হত্যা করেছে। ঘটনার পরপরই পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় এবং অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে।’ স্থানীয় পুলিশ ও ফরেনসিক দল ঘটনাস্থলটি ঘিরে রেখে তদন্ত শুরু করেছে বলেও জানান তিনি। এদিকে মা-বোনদের হত্যার পর আরশাদ আত্মহত্যার ইঙ্গিত দিলেও তাকে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। 
জানা গেছে, আরশাদ আগ্রার এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। পরিবারে আর্থিক অসচ্ছলতা ও সম্পর্কের টানাপোড়েন দীর্ঘদিন ধরেই চলছিল। আরশাদ স¤প্রতি চাকরির জন্য লক্ষেèৗ এসেছিলেন এবং তাঁর পরিবারও এখানে এসেছিল। তবে পারিবারিক বিরোধ ও মানসিক অশান্তি এতটাই বৃদ্ধি পায় যে, আরশাদ এই নির্মম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
ঘটনার বিবরণ দিয়ে ডিসিপি ত্যাগী বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত ভয়াবহ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরশাদ জানিয়েছেন যে, তাঁর মধ্যে পারিবারিক চাপ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, তিনি অন্য কোনো পথ খুঁজে পাননি। তবে আমরা বিষয়টি আরও বিস্তারিত ভাবে তদন্ত করছি।’
ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে কিছু ধারালো অস্ত্র। পুলিশের আশঙ্কা এগুলো সম্ভবত হত্যার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা আলামত সংগ্রহ করছেন এবং হত্যাকাণ্ডের সময়কাল ও ঘটনাস্থলে আরশাদের গতিবিধি পুনর্গঠন করার চেষ্টা করছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্তের মানসিক অবস্থা যাচাই করার জন্য তাঁকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো হবে। একই সঙ্গে, নিহতদের পরিবার ও পরিচিতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনাটির কারণ আরও স্পষ্ট করার চেষ্টা চলছে। ডিসিপি ত্যাগী বলেন, ‘আমরা পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গে কথা বলছি এবং তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে এই ঘটনা ভবিষ্যতে প্রতিরোধ করার জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, তা নিয়েও ভাবা হচ্ছে।’
ঘটনার পর স্থানীয় বাসিন্দারা এবং হোটেলের কর্মচারীরা হতবাক হয়ে পড়েন। হোটেলের ম্যানেজার বলেন, ‘আমরা কখনোই ভাবতে পারিনি যে, এমন কিছু ঘটতে পারে। পরিবারটিকে বেশ শান্ত মনে হচ্ছিল, কিন্তু রাতে কী হলো আমরা জানি না।’
নিহতদের স্বজনেরা ঘটনাস্থলে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের একজন বলেন, ‘আসমা এবং তাঁর মেয়েরা খুবই শান্ত প্রকৃতির ছিলেন। আমরা কখনোই কল্পনা করতে পারিনি যে, তাদের জীবন এভাবে শেষ হবে।’
এই ঘটনা সমাজে পারিবারিক সম্পর্ক ও মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বের ওপর বড় একটি প্রশ্ন তুলেছে। অনেকেই বলছেন, আরশাদ যদি তাঁর মানসিক সমস্যার বিষয়টি কাউকে খুলে বলতে পারতেন, তবে হয়তো এই ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো। এই মর্মান্তিক ঘটনা কেবল লক্ষেèৗ নয়, পুরো দেশকে নাড়া দিয়েছে। সমাজ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক সমস্যা ও মানসিক চাপকে গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করার সময় এসেছে। অন্যথায়, এ ধরনের ঘটনা আরও বাড়তে পারে। 
সূত্র : এনডিটিভি।

্রিন্ট

আরও সংবদ