খুলনা | সোমবার | ০৬ জানুয়ারী ২০২৫ | ২৩ পৌষ ১৪৩১

মৌসুম পরিবর্তনের সাথে পেশারও পরিবর্তন হয় কালীগঞ্জের বামনের বিল পাড়ের মানুষের

কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি |
১১:১৫ পি.এম | ০৩ জানুয়ারী ২০২৫


প্রাকৃতিকভাবেই শস্য ও মৎস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার জামাল ইউনিয়নের নাটোপাড়ার বামনের বিল। বিলের সাথেই সংযুক্ত বেগবতি ও ফটকি নদী। বামনের বিলটি বেগবতি ও ফটকি নদি মোহনা সংলগ্ন হওয়াই বিলটি পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয়। যার কারণে ভরা বর্ষার মৌসুমে পানিতে টইটুম্বুর, চারদিকে শুধু পানি আর পানি থই থই করে, তার মাঝে নান্দনিক সবুজের সমাহার। 
কালীগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে জামাল ইউনিয়নের নাটোয়াপাড়া থেকে শুরু বামনের বিল। নাটোপাড়া গ্রামটি কালীগঞ্জ উপজেলার পূর্বাঞ্চলের শেষ গ্রাম। এগ্রামের অপর প্রান্তে রয়েছে মাগুরার শালিখা উপজেলার মশাখালী গ্রাম। এ বিলের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে ফটকি ও বেগবতি নদীর মিলনে। মৌসুম পরিবর্তনের সাথে সাথে পেশারও পরিবর্তন করেন এই বিল পাড়ের মানুষের। বর্ষার মৌসূমে ঝিনাইদহ, মাগুরা ও যশোরের বিভিন্ন উপজেলা থেকে মানুষ বিল ভ্রমণে আসে বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। আর এসময় বিল পাড়ের মানুষ ছোট ছোট ডিঙি নৌকা ও টলার চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। এসব নৌকা রিজার্ভ করে পুরো বিলের সৌন্দর্য ঘুরে ঘুরে উপভোগ করেন। পুরো বিল ঘুরতে তারা আটশ’ টাকা থেকে এক হাজার টাকা ভাড়া নেন। এভাবে প্রতিদিন ৩/৪ টা ভাড়া মারতে পারেন তারা। বর্ষার মৌসুমে বিল পাড়ের মানুষ নৌকা ভাড়া ও মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত থাকেন। আবার শুষ্ক মৌসুমে কৃষিকাজের পাশাপাশি অনেকে মাছ ধরেও জীবিকা নির্বাহ করেন। 
সরেজমিনে দেখা যায়, বিলটি শুকিয়ে বিলের পানি ফটকি ও বেগবতি নদিতে গিয়ে জমেছে। নদি দুইটাতে পানিও কমে আসছে তাই এখানকার বাসিন্দারা এখন আর নৌকা বা টলারে ভাড়া মারেন না। এখন তারা ছোট ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত। নদি এবং নদি সংলগ্ন কয়েকটি খালে তারা ভেষাল জাল, বড়শি, ঝাকি জাল, পাতা জাল, বাশের তৈরী বিভিন্ন যন্ত্র দিয়ে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন রকমের মাছ শিকার করছেন। এখন তারা মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। কেউ আবার বিলের জমিতে আগাছা পরিস্কার করছেন ধান ও অন্যান্য শষ্য চাষ করার জন্য জমি উপযোগী করার কাজে ব্যস্ত। এভাবে এই পাড়ের মানুষ মৌসুম পরিবর্তনের সাথে সাথে পেশারও পরিবর্তন করেন। 
কথা হয় নাটোপাড়া গ্রামের পল­ী চিকিৎসক ফরিদ আহমেদ এর সাথে। তিনি বলেন বেগবতি, ফটকি নদির মোহনা এবং নদি সংলগ্ন বামনের বিলটি তিন দিক দিয়ে সমৃদ্ধ। কারণ এখানে বর্ষার সময় মাছ ধরা ও পর্যটকদের নিয়ে বিল ভ্রমন করে মানুষ আয় রোজগার করেন আবার শুষ্ক মৌসূমে কৃষিকাজ ও নদি, খাল ও বিলে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যায়। এবার বৃষ্টি বেশী হওয়ায় মাছের পরিমাণও বেশী। এখন বিল পাড়ের মানুষ মাছ ধরে বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি করছেন। আর বর্ষার সময় এখানে লোক সমাগম বেশী হয় কারণ বিভিন্ন এলাকা থেকে সব বয়সী ভ্রমণ পিপাসু মানুষ আসে বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। বিলটির নাম বামনাইল হলেও ভ্রমণ পিপাসুরা এর নাম দিয়েছেন রাতার গুল বা টাঙ্গুয়ার হাওড়। বর্ষার সময় বিলের অপরূপ সৌন্দর্য দেখার জন্য মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। তবে বিকেলের দিকে ভীড় বেশী থাকে। 
স্থানীয় বাসিন্দা খলিল উদ্দিন বলেন, আপনারা বর্তমান যে দৃশ্য দেখছেন এটা তো শুকনা মৌসুমের দৃশ্য। তবে বর্ষায় এই বিলের রূপ থাকে ভিন্ন। চারিদিকে থইথই ঢেউহীন পানি, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যেমন রূপ বদলায় এ বিলের, তেমনি কাজের ধরণেরও পরিবর্তন হয় বিলপাড়ের বাসিন্দাদের। একেক সময়ে একেক কাজকে পেশা হিসেবে নিয়ে পুরো বছর কর্মব্যস্ত সময় পার করেন তাঁরা। এর ফলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি এভাবেই বামনের বিল এখন কর্মসংস্থানের বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
বর্ষা মৌসুমে বামনের বিলে মাছে ভরে ওঠে। বর্ষার পানিতে প্রচুর দেশি মাছ প্রবেশ করে। বিলের নিচু অংশে প্রায় পুরো বছরই চলে মাছ শিকার। অনেকেই বিলের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট পুকুর খনন করেছেন। এসব পুকুরে দেশি মাছের চাষ হচ্ছে। এ থেকে বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে বহু মানুষের। বামনের বিলকে কেন্দ্র করে ঝিনাইদহ সদর, শালিখা ও কালীগঞ্জ উপজেলা এই তিনটি উপজেলাই অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। কৃষিকাজের পাশাপাশি মাছ চাষ করে সাবলম্বী হয়েছেন অনেকে। অনেকে আবার বিলের উন্মুক্ত জলাশয়ে হাঁস পালন করছেন। বাঁশ-বেতশিল্প ও জাল বোনার মতো পুরোনো পেশা আঁকড়ে রেখেছেন অনেকে।
তিন উপজেলার বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই বিলের মাটি খুব উর্বর। ফলে বিলের উঁচু জমিতে প্রায় সব ধরণের ফসল উৎপাদিত হয়। শুকনা মৌসুমে কৃষিপ্রধান হয়ে ওঠে বামনের বিল। বিলের টাটকা ঘাস ও ধানের খড়ে খাবারের জোগান হয় গবাদিপশুর। বিল পাড়ের বহু মানুষ গরু ও ছাগল পালন করে সাবলম্বী হয়েছেন। বিকল্প পেশা হিসেবে অনেকে হাঁস-মুরগি পালন করছেন। বিলের উন্মুক্ত জলাশয়েই মিলছে হাঁসের খাবার। বাড়তি খরচ কম হচ্ছে। অন্যদিকে বর্ষায় বিলে মাছ ধরে বাড়তি আয় করেন এখানকার বাসিন্দারা। স্থানীয় আরেক বাসিন্দা তোরাপ আলী বলেন, বামনাইল বিলে বেড়ানোর উত্তম সময় বর্ষাকাল। বর্ষায় বামনাইল বিল বেড়াতে হলে আগে আসতে হবে ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ শহরে। পৌঁছে ইজিবাইক বা শ্যালো ইঞ্জিন চালিত যানবাহনে যেতে হবে নাটোপাড়া বাজারে। নাটোপাড়া বাজারের সেতুর পাশ থেকে  ট্রলার বা নৌকা রির্জাভ করতে হবে। দলবেঁধে গেলে ঘণ্টা চুক্তিতে নৌকা বা ট্রলার ভাড়া নেওয়া যাবে। বর্ষাকালে কখনো রোদ কখনো বৃষ্টি। তাই বামনাইল বিল ভ্রমণের সময় অবশ্যই ছাতা, রোদ টুপি সঙ্গে নিতে হবে। বিলের ভেতর কোথাও দোকানপাট নেই। তাই সঙ্গে অবশ্যই পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ খাবার পানি ও শুকনা খাবার সাথে রাখলে ভালো হবে। অপচনশীল বর্জ্য যেমন পলিথিন ও প্লাস্টিকের বোতল বিলে ফেলে পরিবেশ ধ্বংসের অংশীদার হওয়া যাবে না। ফেরার পথে বিলের পানিতে দেখা যাবে আগুনরঙা সূর্য অস্ত। 
নাটোপাড়া গ্রামের যুবক নৌকার মাঝি জানান, নৌকায় আগে তেমন ভাড়া হতো না। জুলাই মাসের প্রথম থেকে দিন দিন ভাড়া বাড়তে থাকে। বর্তমানে এখানে বেশ কয়েকটি নৌকা আছে। তবে যেভাবে মানুষ আসছে তাতে আরও নৌকা বাড়াতে হবে। কালীগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ হাসান সাজ্জাদ বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার বৃষ্টির পরিমাণ বেশী হওয়ায় বামনের বিল সহ উপজেলার খাল, বিল, বাওড়, পুকুর ও নদি নালায় দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে ও চাষের মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী মাছের উৎপাদন আরও বৃদ্ধির জন্য মৎস্য বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। অবৈধভাবে মাছ শিকার বন্ধ করতে আমাদের অভিযান অব্যহত আছে। পরিকল্পিতভাবে বামনের বিলকে ব্যবহার করা গেলে আরও অনেক মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হতো বলে আমি মনে করি। প্রাকৃতিকভাবেই বামনের বিল শস্য ও মৎস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত। শুকনা মৌসুমে যেমন ফসলের মাঠ নিয়ে বিলের বাসিন্দারা ব্যস্ত থাকেন, তেমনি ভাবে বর্ষায় পর্যটক ও মাছ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তারা। এই বিলের মধ্যে বিকল্প আয়ের উৎস দিন দিন বাড়ছে। বিভিন্নভাবে মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। তবে বিল নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগের অভাব রয়েছে। এ বিলে মাছের উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে যদি বিল পাড়ের বাসিন্দারা মৎস্য বিভাগের সকল নিয়ম মেনে মৎস্য শিকার করেন। 

্রিন্ট

আরও সংবদ