খুলনা | বৃহস্পতিবার | ০৯ জানুয়ারী ২০২৫ | ২৫ পৌষ ১৪৩১

ক্ষতির মুখে বাংলাদেশসহ ক্ষুদ্র ক্রিকেট বোর্ড

জয় শাহর যে বৈঠক বিভক্ত করে দেবে ক্রিকেটের দুনিয়া

ক্রীড়া প্রতিবেদক |
০৩:৩৭ পি.এম | ০৭ জানুয়ারী ২০২৫


চলতি সপ্তাহেই বিশেষ এক বৈঠকে বসবেন আইসিসি চেয়ারম্যান জয় শাহ। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ট্যাবলয়েড দ্য এজ এর সংবাদ অনুযায়ী, চলতি মাসেরই শেষ দিকে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান মাইক বাইর্ড এবং ইংল্যান্ড ও ওয়েলশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান রিচার্ড থম্পসন থাকবেন সেই বৈঠকে। আর এই তিনজনের বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয়টাও সবারই জানা। আলাপ হবে দ্বি-স্তরের টেস্ট কাঠামো নিয়ে।

দ্বি-স্তরের এই কাঠামোর রূপরেখা বেশ সহজ। একপাশে থাকবে ক্রিকেটের তিন মোড়ল দেশ ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড। সঙ্গে যোগ দেবে আরও চার দেশ পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কা। আর অন্যপাশে রাখা হচ্ছে ৫ দেশ। যেখানে সবচেয়ে বড় নামটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং বাংলাদেশ। এর বাইরে আছে জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তান এবং আয়ারল্যান্ড।

যদিও এই প্রস্তাবনা নিয়ে হাজির হচ্ছে আইসিসি চেয়ারম্যান জয় শাহ। বিশ্বক্রিকেটের শীর্ষ পদে বসে থাকা এই ব্যক্তি কেবলই উঠে এসেছেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সদস্য সচিবের পদ থেকে। তার আইসিসির শীর্ষকর্তা হওয়ার সময় থেকেই যে ‘একপেশে’ সিদ্ধান্তের শঙ্কা ছিল, সেটাই হয়ত বাস্তব হচ্ছে জানুয়ারির সেই বৈঠক থেকে।

কিন্তু কেন এমন এক মডেল নিয়ে হাজির হচ্ছেন আইসিসির প্রধান? কী হতে পারে এর পেছনের উদ্দেশ্য? কেন দীর্ঘদিনের প্রচলিত ধারা ভেঙে দুই স্তরের টেস্টের প্রতি আগ্রহ ক্রিকেট বিশ্বের তথাকথিত ‘মোড়ল সদস্য’দের।

বিগ থ্রি এবং লাভজনক টেস্ট মডেল 
শুরুটা আইসিসির বিগ থ্রি মডেল থেকে। ২০১৪ সালে ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডকে বড় রকমের লভ্যাংশ দেয়ার ভিত্তিতে যা শুরু হয়েছিল। এরপর একপর্যায়ে সেটা ভেঙেও যায়। তবে আর্থিক বন্টনের দিকটা ভেঙে গেলেও ক্রিকেটের বড় মঞ্চে ঠিকই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এই দেশগুলোর আধিপত্য। যেটার সবশেষ রূপ হতে পারে দ্বি-স্তরের টেস্ট ক্রিকেট মডেল।

একথা সত্য, ভারত-অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডেই এখন পর্যন্ত লাভজনক টেস্ট ক্রিকেটের দেখা মেলে।  টিকিট বিক্রি, মাঠে দর্শক সমাগম, অনলাইন এবং টিভিতে খেলার সম্প্রচারস্বত্ত্ব বিক্রিসহ যাবতীয় ক্ষেত্রেই লাভ করে থাকে এই তিন দেশ। সম্প্রতি শেষ হওয়া বোর্ডার-গাভাস্কার সিরিজের প্রতিটি টেস্টেই দেখা গিয়েছে রেকর্ডসংখ্যক উপস্থিতি।

পাঁচ টেস্ট মিলিয়ে উপস্থিত ছিল ৮ লাখ ৩৭ হাজার ৮৭৯ দর্শল। মেলবোর্নে বক্সিং ডে টেস্ট দেখেছেন রেকর্ড ৩ লাখ ৭৩ হাজারের বেশি দর্শক। চলতি গ্রীষ্মে গড়ে উপস্থিত ছিলেন ৪১ হাজার ৮৯৪ দর্শক। ফক্স ক্রিকেটের ভাষ্য অনুযায়ী, বিগত কয়েক বছরের হিসেবে বোর্ডার-গাভাস্কার সিরিজ এবং অ্যাশেজ থেকেই সবচেয়ে বেশি আয় করেছে অস্ট্রেলিয়া। একইকথা সত্য ভারতের জন্য। এমনিতেই ক্রিকেটের বড় এক বাজার ভারতে। টেস্ট ক্রিকেটেও থাকে দর্শকদের সমান উন্মাদনা। আর সেটারই সুযোগ নিতে মুখিয়ে আছে বিসিসিআই।

কী সুবিধা পাবে ‘বিগ থ্রি’
প্রস্তাবিত নতুন মডেল বাস্তবায়ন হলে ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড একে অন্যের বিপক্ষে প্রতি ৩ বছরে অন্তত ২ বার করে মুখোমুখি হতে পারবে। এতে করে আর্থিকভাবে ব্যাপক আকারে লাভবান হবে ওই তিন দেশের বোর্ড। নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতেও এখন পর্যন্ত আছে টেস্টের উন্মাদনা। আর্থিক সুবিধা পাবে তারাও। তবে মূল লাভ হবে সেই তিন দেশেরই।

একইসঙ্গে আইসিসি থেকে লভ্যাংশ পাওয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাপক আকারে লাভবান হবে এই তিন বোর্ড। সংস্থাটির লাভের ৩৮.৫ শতাংশ পাচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড বিসিসিআই। চার বছর মেয়াদী এই চুক্তির বর্তমানে চলছে দ্বিতীয় বছর। ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড পাবেন ৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ডের কাছে যাবে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ।

২০২৭ সাল থেকে পরবর্তী বন্টনে এই শতাংশের হিসেব বাড়িয়ে নিতে আগ্রহীই হবে ভারত। লভ্যাংশ বন্টনের সবশেষ বৈঠকে ৫৭০ কোটি ইউএস ডলারের দাবি করে বসেছিল বিসিসিআই। সেই সভায় ভারতের প্রতিনিধি ছিলেন জয় শাহ, তিনিই বর্তমানে আইসিসির চেয়ারম্যানের পদে বসছেন। আইসিসির সর্বোচ্চ আসনে বসেও ভারতের স্বার্থটাই আপাতত এগিয়ে রাখছেন ক্রিকেট বিশ্বের সর্বোচ্চ আসনে বসা ব্যক্তিটি।

টেস্টের ‘মৃত্যু’, ক্ষতির মুখে বাংলাদেশসহ অন্যান্য সব দেশ  
জয় শাহর এই বৈঠকের পর থেকে টেস্ট ক্রিকেটেরই মৃত্যু হতে পারে বলে উল্লেখ করেছে ফক্স এবং এএফপির ক্রীড়া সাংবাদিকের দল। এই সিদ্ধান্তের ফলে বিগত কয়েকবছর ধরে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সুবাদে বেশি ম্যাচের সুযোগ পাওয়া দলগুলো আবারও আটকে যাবে কম ম্যাচের চক্রে। নতুন পদ্ধতিতে বাংলাদেশ প্রতিপক্ষ হিসেবে পাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আয়ারল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে এবং আফগানিস্তানের মতো দলকে।

এমনিতেই বড় দলগুলোর বিপক্ষে একরকম উপেক্ষারই শিকার বাংলাদেশ। ২০১৯ সালের আগে বাংলাদেশ ভারতের বিপক্ষে টেস্ট খেলারই সুযোগ পায়নি। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রায় ২০ বছর টেস্ট খেলেনি, ইংল্যান্ডে খেলা হয়নি ২০১০ সালের পর থেকে। অন্যদিকে, দেশের মাটিতেও এমন বড় দলের বিপক্ষে বাংলাদেশের খেলার সুযোগ কমে আসবে।

টেস্ট ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করার উদ্যোগ না নিয়ে একপ্রকার নির্বাসনে পাঠানো হবে এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। যেখানে নির্বাসনের কেন্দ্র হবে টেস্টের মোড়ল দেশগুলো। আর তাতে লাভ হবে কেবল ওই তিন দেশেরই। বিলীন হয়ে যাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যেকার ফ্র্যাংক-ওরেল ট্রফির মতো ঐতিহাসিক সিরিজও।

টেস্ট শুধুই অভিজাতদের, বাকিরা বঞ্চিত 
২০১৬ সালেই এমনই এক প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ভারতের সেই সময়ের ক্রিকেট বোর্ড প্রধান অনুরাগ ঠাকুর। নিচের দিকে থাকা দলগুলোর বড় রকমের ক্ষতি হবে এমন যুক্তিতেই দ্বি-স্তরী টেস্ট কাঠামোর ধারণা বাতিল করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন বিসিসিআই সবার স্বার্থকেই রক্ষা করতে চায়। যদিও শেষ পর্যন্ত এই ধারণায় বজায় থাকেনি জয় শাহ আমলে।

একই আশঙ্কা ছিল সদ্য বিদায়ী আইসিসি চেয়ারম্যান গ্রেগ বার্কলের। তার শঙ্কা ছিল, বেশিরভাগ দেশই টেস্ট ক্রিকেটের খরচের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে সক্ষম হবে না। বর্তমান চক্রেই দক্ষিণ আফ্রিকা খরচ কমিয়ে আনার তাগিদে কোনো সিরিজেই ২টির বেশি টেস্ট খেলেনি। যা নিয়ে কথা বলেছিলেন তাদেরই তারকা মার্কো ইয়ানসেন।

তবু জানুয়ারি মাসের এক বৈঠকে দ্বি-স্তরী ক্রিকেটের জয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে বেশি। সেক্ষেত্রে বিশ্ব ক্রিকেটে টেস্ট হবে কেবল অভিজাত ক্রিকেট বোর্ডের খেলা। তাতে কিছু দেশের জন্য টেস্ট থাকবে উপভোগ্য। বাকিদের জন্য টেস্ট ক্রিকেট নিছকই এক বিলাসিতা। 

্রিন্ট

আরও সংবদ