খুলনা | বৃহস্পতিবার | ৩০ জানুয়ারী ২০২৫ | ১৭ মাঘ ১৪৩১

কার্যাদেশ বাতিল করে পুনরায় নিলাম বিজ্ঞপ্তি জারির আবেদন

কোটি টাকার ভবন খুলনা মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সুজনকে ৩৮ লাখে দেয়ার অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাগেরহাট |
০১:১৭ এ.এম | ২৮ জানুয়ারী ২০২৫


বাগেরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ভবন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাত্র ৩৮ লক্ষ এক হাজার টাকায় যুবলীগ নেতার প্রতিষ্ঠানকে নিলাম দেওয়া হয়েছে। নিলাম গ্রহিতারা ইতোমধ্যে ভবন ভাঙার কাজ শুরু করেছেন। এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা ও ঠিকাদারদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। খুলনা মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ শাহজালাল হোসেন সুজনের প্রতিষ্ঠান এস রক ট্রেডার্সকে মাত্র ৩৮ লক্ষ টাকায় দেওয়া এই ভবন অন্তত এক কোটি টাকায় বিক্রি করা যেত বলে দাবি ঠিকাদারদের। ৩৮ লক্ষ টাকায় নিলাম দেওয়ায় সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে ৬০ লক্ষ টাকার বেশি। অতিদ্রুত এস কে ট্রেডার্সের কার্যাদেশ বাতিল করে পুনরায় নিলাম বিজ্ঞপ্তি জারির আবেদন করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও বঞ্চিত ঠিকাদাররা।
গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৬ মার্চ বাগেরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ব্লক-১ ও ব্লক-২ ভেঙে অপসারণের জন্য নিলামের জন্য দরপত্র আহŸান করেন তৎকালীন গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত কুমার বিশ্বাস। গণপূর্ত বিভাগের নির্ধারিত রেট অনুযায়ী ২টি ভবনের সর্বনিম্ন মূল্য ধরা হয় ৩৭ লক্ষ ৩ হাজার ২৯৩ টাকা। বাগেরহাট, খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকার ১৫০ জন ঠিকাদার শিডিউল ক্রয় করেন। এর মধ্যে মাত্র ১০ জন ঠিকাদার দরপত্রে অংশগ্রহণ করেন। অভিযোগ রয়েছে বাকি ১৪০ জন ঠিকাদারের বেশির ভাগ ঠিকাদারকে দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। অনেককে শিডিউল কিনতে পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। আর যারা কিনেছিলেন তাদের কাউকে ভয়ভীতি দেখিয়ে, আবার কাউকে এক হাজার টাকার শিডিউলের মূল্য মাত্র দুই হাজার টাকা দিয়ে শিডিউলের কপি নিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাগেরহাট জেলা যুবলীগের সভাপতি শেখ পরিবারের আস্তাভাজন সদর উপজেলা সরদার নাসির উদ্দিন ও তার লোকজন এটা করেছে বলে অভিযোগ ঠিকাদারদের।
কয়েক দফায় বিভিন্ন অফিসিয়াল প্রক্রিয়া শেষ করার পরে গেল বছরের ১৯ নভেম্বর গণপূর্ত বিভাগ, বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মাদ শাহ আলম ফারুক চৌধুরী এস কে ট্রেডার্সের অনুকূলে কার্যাদেশ প্রদান করেন। পরবর্তীতে এস কে ট্রেডার্সের পক্ষে লিঠু হোসেন নামের এক ব্যক্তি এই ভবন ভাঙা শুরু করেছেন। তার দাবি তিনি এস কে ট্রেডার্সের কাছ থেকে বৈধভাবে ভবনটি ক্রয় করেছেন। তবে কত টাকায় তিনি ক্রয় করেছেন তা বলতে নারাজ এই ব্যবসায়ী।
শিডিউল ক্রয় করেও ভয়ভীতির কারণে জমা দিতে না পারা ঠিকাদার মোঃ শওকত আলী বলেন, আমিসহ অনেকেই শিডিউল কিনেছিলাম। কিন্তু বাগেরহাট জেলা যুবলীগের সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার নাসির উদ্দিন ও তার সহযোগী যুবলীগ নেতা হুমায়ুন কবির পলি আমাকে দরপত্র জমা দিতে দেয়নি। আগ্রহী সব ঠিকাদাররা যদি এই নিলামে অংশগ্রহণ করতো, তাহলে এটি অন্তত এক কোটি টাকায় বিক্রি হতো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খুলনার এক ঠিকাদার বলেন, বাগেরহাট জেলা যুবলীগের একজন নেতা আমাকে ফোন করে দরপত্র জমা দিতে নিষেধ করেন। বলেন কাজটা খুলনা মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ শাহজালাল হোসেন সুজন পাবেন।
বাগেরহাটের আরেক ঠিকাদার বলেন, গণপূর্ত বিভাগে যখন শিডিউল কিনতে গিয়েছিলাম তখন যুবলীগ নেতা হুমায়ুন কবির পলি ও তার লোকজন আমাকে শিডিউল কিনতে নিষেধ করেন। শিডিউল বিক্রির দায়িত্বে থাকা গণপূর্ত বিভাগের এক নারী কর্মকর্তাকে আমার কাছে শিডিউল বিক্রি করতে নিষেধ করেন। অনেক বাক-বিতন্ডা ও বিভিন্ন স্থানে ফোন করার পরে আমি শিডিউল কিনতে পারি। তবে পরে বাগেরহাট জেলা যুবলীগের সভাপতি সরদার নাসির উদ্দিন ও পলির হুমকি-ধামকিতে দরপত্র জমা দিতে পারিনি।
গণপূর্ত বিভাগ থেকে পাওয়া শিডিউল ক্রয় করা ১৫০ জন ঠিকাদারের মধ্যে খুলনা ও বাগেরহাটের ৩০ জন ঠিকাদারের সাথে কথ বললে অনেকেই সংবাদকর্মী পরিচয় পাওয়ার পরে কথা বলতে রাজি হয়নি। বেশির ভাগ ঠিকাদার জানিয়েছেন বাগেরহাট জেলা যুবলীগের সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার নাসির উদ্দিনের ভয়ে তারা দরপত্র জমা দিতে পারেননি। কাউ কাউকে রেলরোডস্থ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ডেকে শিডিউল মূল্য এক হাজার টাকার স্থলে ২ হাজার টাকা দিয়ে কাগজপত্র রেখে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য এস কে ট্রেডার্সের মালিক মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ শাহজালাল হোসেন সুজনকে ফোন দেওয়া হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। জানা যায়, আওয়ামী সরকার পতনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।
আওয়ামী লীগ আমলের এসব অনিয়মকে ভাত মাছ উলে­খ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বাগেরহাটের সম্পাদক এস কে হাসিব বলেন, বিগত দিনগুলোতে বাগেরহাটে টেন্ডার সিন্ডিকেট ছিল ভাত-মাছের মত। পছন্দের লোকদের কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য সিন্ডিকেট করা, প্রকৃত ঠিকাদারদের হুমকি-ধামকি এমনকি মারধরও করা হতো। কালেক্টরেট ভবন নিলামে অংশগ্রহণের জন্য ১৫০ জন ঠিকাদার শিডিউল ক্রয় করেছিল, সেখানে মাত্র ১০ জন ঠিকাদার নিলামে অংশগ্রহণ করেছে। এ থেকেই বোঝা যায় এখানে কত বড় দুর্নীতি হয়েছে। এই অনিয়মের সাথে যারা জড়িত তদন্ত পূর্বক তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনার দাবি জনান সুশীল সমাজের এই প্রতিনিধি।
সনাক, বাগেরহাটের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক চৌধুরী আব্দুর রব বলেন, ভবনটি নিলাম প্রক্রিয়া ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে শুরু হলেও, কার্যাদেশ পেয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে-এটা একজন সচেতন মানুষ হিসেবে আমার জন্য দুঃখজনক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত এই কার্যাদেশ বাতিল করে পুনরায় নিলাম দরপত্র আহŸান করা। তাহলে প্রকৃত ঠিকাদাররা নিলামে অংশগ্রহণ করতে পারবে। সরকারের রাজস্বও বৃদ্ধি পাবে। আশা করবো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকর্তারা এই কার্যাদেশ বাতিল করে পুনরায় দরপত্র আহŸান করবেন।
গণপূর্ত বিভাগ, বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মাদ শাহ আলম ফারুক চৌধুরী বলেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী গণপূর্ত বিভাগের রেট শিডিউলের থেকে বেশি দামে ভবন দু’টি নিলামে বিক্রয় করা হয়েছে। এখানে কোন অনিয়ম হয়নি। এটা পুনরায় নিলাম দেওয়ার কোন নিয়ম নাই।
১৯৯০ এর দশকে বাগেরহাট শহরের খারদ্বার নামক স্থানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ভবন নির্মাণ করা হয়। ১৯৯৬ সালের ২৭ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই ভবনের উদ্বোধন করেন। তবে ভবনের মূল আয়তন ও নির্মাণ ব্যয় জানাতে পারেনি গণপূর্ত বিভাগ।

্রিন্ট

আরও সংবদ