খুলনা | মঙ্গলবার | ১৮ মার্চ ২০২৫ | ৩ চৈত্র ১৪৩১

১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন্সের নামে ‘মহব্বতে জিন্দাবাদ’

এড. এম. মাফতুন আহমেদ |
০১:১২ এ.এম | ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫


ইংরেজীতে ‘ভ্যালেনটাইন ডে’। বাংলায় ‘ভালবাসা দিবস’। প্রতি বছর ইংরেজি ১৪ ফেব্র“য়ারি ঘুর-ফিরে আসে। তথাকথিত ‘ভ্যালেনটাইন ডে’র নামে যুবক-যুবতি, বয়স্ক-বয়স্কাদের একটি অংশ তথাকথিত ভালবাসার উন্মাদনায় মেতে উঠে। এরা উচ্ছৃঙ্খল, এরা বর্বর, এরা অবুঝ। বাঙালি মহিলারা ঘটা করে লালপেড়ে শাড়ি পড়ে। পুরুষেরা ভালবাসার ফেরিওয়ালা সাজে। হাতে হাতে পরস্পর রাখী বন্ধন। চুলের খোপে খোপে বাহারী ফুলের সমারোহ। নামিদামি উপহার। আরও কত কি। পরস্পর ‘ভ্যালেনটাইন ডে’র নামে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। হোটেল, রেস্তোরায়, ঘাটে-মাঠে বিভিন্ন বারে নানাভাবে আনন্দফুর্তি করে। 
এসব কাছে থেকে দেখি আর বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখি, কোথায় চলেছে আমাদের সমাজ-সভ্যতা। কোথায় আমাদের কৃষ্টি সভ্যতা? কোথায় আমাদের সংস্কৃতি? কখনও কখনও বলি ভালবাসার নামে এই উদোম সংস্কৃতি দেখিয়ে লাভ কী? মাত্র একদিনের উপচেপড়া ভালবাসার ভীড়। উন্মাদনায় একে অপরকে জড়িয়ে ধরছি। অতঃপর......বাকি অংশটুকু নাই বা বললাম। ধরে নিতে পারেন নিছক প্রতারণা এক উচ্ছৃঙ্খলতা জীবন। 
এসব ভালবাসার ফেরিওয়ালারা ৩৬৪ দিন ঘরে-বাইরে-পাড়া-প্রতিবেশি, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির ওপর একটু ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দেন? খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে ঘরে ঘরে, শরীরের গোটা অঙ্গে বিজাতীয় সংস্কৃতি মাকড়সা জালের মতো জেঁকে বসেছে। এমন উচ্ছৃঙ্খলায় জেঁকে বসেছে যে, স্বামী রাখে না স্ত্রী খবর, স্ত্রী রাখে না স্বামীর খবর। সন্তান রাখে না মা-বাবার খবর। মা রাখে না সন্তানের খবর। 
তাই ১৪ ফেব্র“য়ারি ‘ভ্যালেনটাইন্স ডে’তে ভালবাসার নামে পরকীয়া সংস্কৃতিতে মেতে উঠে। একদিনের মেকি ভালবাসার নামে রাস্তায় রাস্তায়, নামীদামী হোটেল-রেস্তোরায় উচ্ছৃঙ্খলতায় গা ভাসিয়ে দেয়। নেমে পড়ে বলগাহীন এক বর্বর জীবনে। 
আসলে বাঙালিদের সব কিছুতেই আদিখ্যেতা। না বুঝে আমরা একটু বেশি বাড়াবাড়ি করি। নাচনেওয়ালা পুতুলের মত নাচতে থাকি। কখনও কখনও নির্বোধের মত কাজ করি। পশ্চিমারা যেটা বর্জন করে আমরা সেটা গ্রহণ করি। ভ্যালেনটাইন্স ডে’তে বড় প্রেমিক সাজি। ভ্যালেনটাইন্স ডে’র উৎকট আনন্দে মেতে উঠি। ৩৬৪ দিন ভালোবাসাহীন জীবন-যাপন করি। আমরা দিন দিন হৃদয়হীন হচ্ছি। আর আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ হচ্ছি। বাইরে আমাদের ভালবাসার রঙিন সাজ, ভেতরে হিংসার বাস। মানবিকতা কমছে, দানবিকতা বাড়ছে, আর বাড়ছে কপটতা। আমরা কি নিজের দেশকে ভালবাসি? আমরা কি দেশের মানুষকে ভালবাসি? পাড়া-প্রতিবেশী, মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী, সন্তান পরিজন তাদের কি ভালবাসি? বছরে ক’দিন তাদের খোঁজ-খবর রাখি? আমরা কি নিজেকে ভালবাসি? আমরা অর্থহীন হাসি, করি ভালোবাসার অর্থহীন অভিনয়। তাই আমাদের ভালোবাসা ঘরে-বাইরে ‘কেবলই যাতনাময়’। 
চুটিয়ে অবৈধ প্রেম বৈধ করার দিনের নাম ‘ভ্যালেনটাইন্স ডে’। তথাকথিত এ ‘ভ্যালেনটাইন্স ডে’তে যেসব তরুণ-তরুণীরা কলকলিয়ে ওঠে এরা কারা? ঘর পালিয়ে বাইরে যারা প্রেম করে তারা কারা? পরিচিতজনের চোখের আড়ালে যারা প্রেম করে তারা কারা? ক্লাব, হোটেল, রেস্তোরাঁ, পার্কে যেয়ে প্রেম করে ওরা কারা? 
এরা তারাই, যেখানে কোন সহজ-সরল সমাজ স্বীকৃত বন্ধন নেই। নেই ধর্মীয় কোন বিধি-বিধান। ফ্রী ষ্টাইলে বিজাতীয় সভ্যতার গো গ্রাসে ওরা নিমজ্জিত। ওরা বাপ-দাদার চোদ্দ-পুরুষের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে মুছে দিয়ে চায়। ওরা অবলীলায় গাঁ ভাসিয়ে দিয়ে ‘মহব্বতে জিন্দাবাদ’ প্রেমের জোয়ারে ভাসতে চায়। অবৈধ প্রেমে যুবক-যুবতি, তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীকে অনুপ্রাণিত করতে চায়। এসব ব্যভিচারের ঠিকাদাররা একটি জাতির কৃষ্টি সভ্যতা সর্বোপরি গোটা পৃথিবীর নৈতিক চরিত্রকে ধ্বংস করতে চায়। এরা এক প্রশ্নবিদ্ধ নৈতিকতা নিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য নানা প্রচার মাধ্যম, নানা রংঙের তাজমহল তৈরি করেছে। সৃষ্টি করেছে নানা আইন-কানুন। তৈরি করেছে অবৈধ প্রেম প্রকাশ করার বাৎসরিক স্মারক দিবস। যার নাম ‘ভ্যালেনটাইন্স ডে’ বা ভালবাসা দিবস। 
এই ভালবাসা দিবসের নামে পাশ্চত্য সভ্যতার ফেরিওয়ালারা আমাদের স্বকীয়তা, দেশপ্রেম ও মানবতাবোধ সর্বোপরি স্বজাতীয় সংস্কৃতিকে গলাটিপে হত্যা করছে। মেধা-মননে সূ²াতিসূ²ভাবে ঢুকিয়ে দিচ্ছে তাদের অপসংস্কৃতিগুলো। এই বিষাক্ত সাপের ছোবল থেকে রেহাই পাচ্ছেনা শিশু-কিশোরী, তরুণ-তরুণী থেকে আমাদের বৃদ্ধারাও। 
ভ্যালেন্টাই’স ডে’র নামে ঐদিন আমরা বাংলাদেশের এক শ্রেণি প্রেমেরলীলায় মত্ত হয়ে কপোত-কপোতিরা সারা বছরের অবৈধ প্রেমেরভাব প্রকাশ করে। কার্ড বিনিময় করে। লাল গোলাপ বিনিময় করে। পরস্পর কেক, মিঠাই বিনিময় করে। প্রেমিক-প্রেমিকারা ঘাটে-মাঠে-পথে-পার্কে বের হয়। একত্রিত হয় নাইট ক্লাবে, বিভিন্ন হোটেলে। বিরতিহীনভাবে চলে মদ-হুস্কির আসর। চলে নানাভাবে বলগাহীন নৃত্য। চলে ডিস্ক, ড্যান্স ও ব্যাভিচারের বিরাট ধূম! গলা ফাটিয়ে গেয়ে ওঠে,
“প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোঁহারে
বাঁধন খুলে দাও, দাও দাও দাও।
ভুলিব ভাবনা পিছনে চাব না 
পাল তুলে দাও, দাও দাও দাও”। 
এরা কী অর্ধমৃত্যু তাসলিমা নাসরিনের ভাবশিষ্য? তাসলিমা নাসরিনের থিওরী অনুযায়ী বিয়ে-শাদীর কোন প্রয়োজন নেই। তার থিওরী জরায়ু’র অবাধ স্বাধীনতা। ভ্যালেন্টানই ডের নামে আমাদের কী সেদিকে নিয়ে যাবার আহŸান করছে ? প্রিয় পাঠক, আপনি বলুন এ সব কোন সংস্কৃতি? একজন সুস্থ মস্তিস্ক মানুষ হয়ে কী এ সব মেনে নেবেন? মুসলমান কেন, যে কোন বিবেক সম্পন্ন মানুষ বিবাহের পূর্বে কোন নারীর সাথে অবৈধ প্রণয় বা কোন সম্পর্ক কী গড়তে পারে? 
বৃটিশ রচিত আজকের আমাদের প্রচলিত আইনের দৃষ্টিতে মারাত্মক অপরাধ। আর ইসলামী দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম। কারণ কোন মুসলমান কোন বিজাতীয় কালচারে আনন্দিত হতে পারে না। নিজস্ব স্বকীয়তা বিসর্জন দিতে পারেন না। শুধু আমাদের দেশে ভ্যালেন্টাই’স ডে বস্তা পচা একটি অপসংস্কৃতি নয়, যেখানে এই সংস্কৃতির উৎসস্থল পশ্চিমা দেশের অনেকে এটিকে এখন ঘৃণাভরে বর্জন করে।  
লেখক : আইনজীবী, কলামিষ্ট, সম্পাদক, আজাদবার্তা ।

্রিন্ট

আরও সংবদ

অন্যান্য

প্রায় ৩ মাস আগে