খুলনা | বৃহস্পতিবার | ১৩ মার্চ ২০২৫ | ২৯ ফাল্গুন ১৪৩১

৭৯০টির নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, শীর্ষে কুষ্টিয়া : অধিকাংশেরই মালিকানায় আ’লীগ নেতারা

খুলনা বিভাগে ইটভাটায় চলছে কাঠ পোড়ানোর মহোৎসব

আল মাহমুদ প্রিন্স |
০১:১২ এ.এম | ০৮ মার্চ ২০২৫


খুলনা বিভাগের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইটের ভাটায় চলছে কাঠ পোড়ানোর মহোৎসব। অধিকাংশ ভাটার মালিকানায় রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতারা। বিভাগের দশ জেলায় এক হাজার দু’টি ইটভাটার মধ্যে ৭৯০টির নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। ভাটা বন্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার। 
হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক এক পত্রে বলা হয়, ২৪ ফেব্র“য়ারির মধ্যে সকল অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করতে হবে। ফলে মালিকানাধীন সকল ভাটার বৈধ কাগজপত্র গত ১ মার্চের মধ্যে স্ব-স্ব উপজেলার সহাকারি কমিশনার (ভূমি) দপ্তর বরাবর বৈধ কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু অধিকাংশ দপ্তরে বৈধ কাগজপত্র জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন ভাটা মালিকরা। উপর্যুপরি আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে খুলনার বিভিন্ন উপজেলার ইটভাটায় কয়লার পরিমাণ কমিয়ে চলছে কাঠ পোড়ানোর মহোৎসব। ফলে খুলনা অঞ্চলের বাতাসে বাড়ছে দূষণ। স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে এ অঞ্চলের মানুষের। সংকুচিত হচ্ছে নদী। বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। হুমকিতে জনস্বাস্থ্য। আইন অনুযায়ী, আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা, পৌরসভা বা উপজেলা সদর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংলগ্ন এলাকা, কৃষি জমি এলাকায় স্থাপন করা যাবে না ইটভাটা। 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রূপসা উপজেলার আলাইপুরে ইবিএম ব্রিকস্ নামের ইট ভাটাটি আলাইপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে মাত্র ৪শ’ মিটার দূরে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে প্রেরিত চিঠির ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করলেও কর্ণপাত করছে না ভাটা মালিক। 
এদিকে অবৈধভাবে ইটভাটা পরিচালনার দায়ে গত ১০ ফেব্র“য়ারি রূপসা উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় রূপসা উপজেলার ৯টি ইটভাটায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নয় ইটভাটা মালিককে ২২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।  
হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুয়ায়ী গত ৩ মার্চ রূপসা উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উপজেলার ২২টি ইটভাটায় অভিযান চালানো হয়। এ সময় ভাটা মালিকদের অল্প সময়ের মধ্যে ভাটা গুটিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন সহকারি কমিশনার (ভূমি) অপ্রতিম কুমার চক্রবর্ত্তী। 
ডুমুরিয়া উপজেলার খর্নিয়া বাজার পেরিয়ে কিছুটা সামনে গেলেই দেখা যায় ইট তৈরির বিশাল কর্মযজ্ঞ। মেসার্স নূরজাহান ব্রিকস নামের এ ভাটায় নিম্নমানের কয়লার সাথে কাঠের গুঁড়া মিশিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে পোড়ানো হচ্ছে ইট। নদীর তীরবর্তী, কৃষি জমি ও লোকালয়ে হওয়ায় অনেক ভাটাকে ছাড়পত্র দেয়নি পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু এসব ভাটা মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অবাধে চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসা। বিগত সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ছিলেন খুলনা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগের পর বন্ধ রয়েছে তার ইটভাটা। অজ্ঞাত কারণে এ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। 
ডুমুরিয়ার আতলিয়া ইউনিয়নে খর্নিয়া এলাকায় হরি নদীর তীরে সেতু ব্রিকস্ এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ নামে ভাটা গড়ে তোলেন উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এজাজ আহমেদ। মন্ত্রীর সাথে নিবিড় সম্পর্ক থাকায় তার বিরুদ্ধে কেউ কখনো মুখ খুলতে সাহস পাননি। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন শর্তে বলেন, ভাটাগুলোতে কাঠ ও মাটি পুড়িয়ে সনাতন পদ্ধতিতে ইট তৈরি হওয়ায় বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন ভাটায় কর্মরত নারী ও পুরুষ শ্রমিকসহ স্থানীয়রা। জীবিকার তাগিদে স্বাস্থ্যের কথা ভুলে যান এসব দিনমজুর শ্রমিকরা।
কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৫০০ মিটারের মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে এবিএম নামের ভাটা। পাইকগাছায় কৃষি জমির মধ্যে এআরবি ব্রিকস্, যমুনা ব্রিকস্, এসকেবি ব্রিকসে ইট পোড়ানো হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য উপজেলায় খোঁজ নিলে একই চিত্র পাওয়া যায়। 
বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণ বা জনস্বাস্থ্যের ক্ষতিকর দিক নিয়ে ভাবতে গেলে উলে­খযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি কারণ ইটের ভাটা। এ ইটের ভাটাগুলো তিলে তিলে মানুষের শরীরে রোগের আবাসস্থান তৈরি করছে। ইট তৈরিতে জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহার ভাটা স্থাপন আইনে স্পষ্ট নিষেধ হলেও তা মানা হচ্ছেনা। এছাড়া নিম্নমানের কয়লা পোড়ানোর কারণে পরিবেশে যুক্ত হচ্ছে পার্টিকুলেট ম্যাটার, কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও কার্বন-ডাইঅক্সাইডের মতো ক্ষতিকর উপাদান। এছাড়া কৃষি জমির ওপর পড়ছে ক্ষতিকর প্রভাব।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল­াহ হারুন চৌধুরী বলেন, মানুষ ধোঁয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে। মানবদেহের জন্য ধোঁয়া মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। ইটভাটার কারণে বাড়ছে আশপাশে কার্বনের পরিমাণ। ফলে হ্রাস পাচ্ছে অক্সিজেনের পরিমাণও। 
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বিভাগের দশ জেলায় এক হাজার ২শ’টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নেই ৭৯০টির। বিভাগে সবচেয়ে বেশি ইটভাটা রয়েছে কুষ্টিয়া জেলায়। যেখানে ইটভাটার পরিমাণ ১৮৪টি। এর মধ্যে ১৬৩টি ইটভাটার নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। 
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মোঃ সাদিকুল ইসলাম বলেন, সরকার অবৈধ ইটভাটার ব্যাপারে সর্বোচ্চ কঠোর। আমরাও জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে এ বিষয়ে খুবই কঠোর। যারাই অবৈধভাবে ইটভাটা চালাবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। খুলনা জেলায় ১৫২টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ ভাটারই বৈধতা নেই। 
এর আগে খুলনা জেলা প্রশাসনের সাথে ইটভাটা মালিক সমিতির একাধিকবার সভা হয়েছে। সভায় অবৈধ ভাটা মালিকদের ভাটা বন্ধের ব্যাপারে জোরালো নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে তিনি উলে­খ করেন।   
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু ইটভাটা বন্ধ করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। ইট তৈরিতে নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন ও কংক্রিট বন্টক ব্যবহারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ তাদের। 
পরিবেশবাদী সংগঠন বলছে, দূষণ রোধে কঠোর হতে হবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে। চলতি বছর গত জানুয়ারি মাসে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানে ১৯টি ইটভাটা আংশিক এবং ১২টি ভাটা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। এছাড়া বেশকিছু ভাটা বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি করা হয় অর্থদণ্ড। 
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা’র জাতীয় পরিষদ সদস্য এড. বাবুল হাওলাদার বলেন, ‘অবৈধ ইটভাটা বন্ধে আমরা বছরের পর বছর আন্দোলন করে আসছি। তবে আমাদের সে আন্দোলন কাজে আসে না। স¤প্রতি সরকার ইটভাটা বন্ধে কঠোর হয়েছে। আমরা এটাকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে যারা এটা বাস্তবায়ন করবে, তারা সেভাবে করছে না। তারা নামমাত্র অভিযান পরিচালনা করে, সামান্য কিছু জরিমানা করে থাকে। কিছুদিন পর ফের চালু হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

্রিন্ট

আরও সংবদ