খুলনা | বুধবার | ০২ এপ্রিল ২০২৫ | ১৯ চৈত্র ১৪৩১

এক ভূমিকম্পে কাঁপলো ৬ দেশ : আহত ৭ শতাধিক, ধ্বংসস্তূপে পরিণত, জরুরি অবস্থা জারি : নিরাপদে বাংলাদেশীরা

ভয়াবহ ভূমিকম্পে মিয়ানমার-থাইল্যান্ডে নিহত ১৫০

খবর প্রতিবেদন |
০১:১৬ এ.এম | ২৯ মার্চ ২০২৫


মিয়ানমারে কেন্দ্রীভূত এক শক্তিশালী ভূমিকম্প দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। এর প্রভাবে কেঁপে উঠেছে থাইল্যান্ডসহ আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চল। শুক্রবারের এই ভয়াবহ ভূ-কম্পনে কেবল মিয়ানমারেই ১৪৪ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আহত হয়েছে আহত ৭ শতাধিক। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইং-এর বরাত দিয়ে এই পরিসংখ্যান জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
অন্যদিকে এই ভূমিকম্পের কারণে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে একটি বহুতল ভবন ধসে পড়েছে। যেখানে উদ্ধারকারীরা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়াদের সন্ধান করছে। এ ঘটনায় ১১৭ জন নিখোঁজ ও ৫ জন নিহত হয়েছেন। দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
মিয়ানমার সরকার সূত্র জানিয়েছে, ভূমিকম্পে অসংখ্য অবকাঠামো ধসে পড়েছে। ভবন ধসে শুধু নাইপিতাও শহরে ৯৬ জন মারা গেছেন, এছাড়া সাইগাইংয়ে ১৮ জন এবং মান্দালয়ে ৩০ জন মারা গেছেন।
সরকার বলছে, ক্ষয়ক্ষতির এই পরিসংখ্যান নির্দিষ্ট নয়। বিভিন্ন এলাকায় এখনো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ মূল্যায়ন করা হচ্ছে। মিয়ানমারের স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ভূমিকম্পে মিয়ানমারের মান্দালয় প্রদেশের ফো শিং মসজিদসহ অন্তত তিনটি মসজিদ ধসে পড়েছে। এতে অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে প্রথমবার তীব্র কম্পন অনুভূত হয়। শক্তিশালী এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৭। এর কিছুক্ষণ পরই দ্বিতীয় ভূমিকম্পটি আঘাত হানে, যেটি ছিল ৬ দশমিক ৪ মাত্রার। মিয়ানমারের পাশাপাশি থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককসহ ওই অঞ্চলের অন্যান্য স্থানেও কম্পন অনুভূত হয়েছে। ভূমিকম্পে মিয়ানমারের ইরাবতী নদীর উপর নির্মিত ৯১ বছর পুরনো আভা ব্রিজ ধসে পড়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে মিয়ানমারে ভূমিকম্পে কেঁপেছে বাংলাদেশও। বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী এই ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্তি¡ক জরিপ সংস্থা (টঝএঝ) জানিয়েছে, ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৭.৭ এবং এটি ১০ কিলোমিটার গভীরতায় সংঘটিত হয়েছে। এর কেন্দ্রস্থল ছিল মিয়ানমারের মান্দালয়ের ১৭ কিলোমিটার দূরে। মান্দালয় শহরের জনসংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এটি মিয়ানমারের প্রাচীন রাজকীয় রাজধানী এবং বৌদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্র।
স্থানীয় বাসিন্দারা ও সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ভূমিকম্পের ফলে এদিন দেশটির বহু ভবন, সেতু ও রাস্তাঘাট ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল মান্দালয় শহর থেকে প্রায় ১৭.২ কিলোমিটার দূরে, যার জনসংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। মান্দালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিতে পারেনি।
তবে সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টগুলোতে ধসে পড়া ভবন এবং শহরের রাস্তায় ধ্বংসস্তূপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা গেছে। রয়টার্স তাৎক্ষণিকভাবে পোস্টগুলোর সত্যতা যাচাই করতে পারেনি।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় স¤প্রচারমাধ্যম এমআরটিভি তাদের অফিশিয়াল টেলিগ্রাম চ্যানেলে জানিয়েছে, মিয়ানমারে কমপক্ষে ১৪৪ জন নিহত ও ৭৩২ জন আহত হয়েছেন।
মান্দালয়ের একজন বাসিন্দা রয়টার্সকে বলেন, ‘সবকিছু কাঁপতে শুরু করলে আমরা সবাই দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসি। আমার সামনেই পাঁচতলা একটি ভবন ধসে পড়তে দেখেছি। পুরো শহরের মানুষ রাস্তায় এসে অবস্থান নিয়েছে, কেউ আর ভবনে ফিরে যেতে সাহস পাচ্ছে না’।
একটি উদ্ধারকারী সংস্থার সদস্য জানিয়েছেন, ‘আমরা কেবল পাইনমানার শহরে ৬০টি মৃতদেহ উদ্ধার করেছি। আরও অনেকে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছেন’।
এছাড়া ভূমিকম্পের সময় মান্দালয়ের ঐতিহাসিক আভা সেতুটিও ভেঙে পড়েছে এবং ঐতিহাসিক মান্দালয় প্রাসাদটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
রাষ্ট্র পরিচালিত এমআরটিভি তাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে রাজ্য প্রশাসন পরিষদের এক বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি সাগাইং অঞ্চল, মান্দালয় অঞ্চল, ম্যাগওয়ে অঞ্চল এবং উত্তর-পূর্ব শান রাজ্য, নেপিদো কাউন্সিল এলাকা এবং বাগো অঞ্চলের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে।
এমআরটিভি জানিয়েছে, ইতোমধ্যে জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি পরিদর্শন করতে ভূমিকম্প-কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। ধসে পড়া ভবনে আটকে পড়া ব্যক্তিদের সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি দেশের অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন অব্যাহত রাখবেন।
রাজধানী নেপিদোর একটি প্রধান হাসপাতালেও অনেক হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। জানা গেছে, আহতরা সাগাইং অঞ্চল, মান্দালয় অঞ্চল এবং নেপিদো কাউন্সিল এলাকার সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং রক্তের জরুরি প্রয়োজন রয়েছে।
মিয়ানমারে বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের ভবনও ধসে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। যার মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ও রয়েছে। ভূমিকম্পে শহরের বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের কর্মচারীরা নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শিশু জরুরি তহবিল বলেছে, তারা ভয়াবহ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত শিশু এবং পরিবারের নিরাপত্তার জন্য গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। 'পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে আমরা প্রভাব মূল্যায়ন করতে এবং তাৎক্ষণিক সহায়তা প্রদানের জন্য অংশীদারদের সাথে কাজ করছি।'
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার ইতোমধ্যে বিদ্রোহীদের দমন নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে। যা উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে।
তবে জান্তা সরকার ইতোমধ্যেই দেশটির ৬টি অঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি করেছে। অঞ্চলগুলো হলো- সাগাইং, মান্দালাই, ম্যাগওয়ে, বাগো, ইস্টার শান রাজ্য এবং নেইপিদো।
মিয়ানমারের জান্তা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, কর্মকর্তারা ক্ষয়ক্ষতির তদন্ত করবেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধারকাজ সমন্বয় শুরু করবেন।
থাইল্যান্ড : মিয়ানমারে শক্তিশালী ভূমিকম্পের ব্যাপক ধাক্কা লেগেছে প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ডেও। রাজধানী ব্যাংককে একটি নির্মাণাধীন ৩০ তলা ভবন ধসে পড়েছে এবং এতে আটকা পড়েছেন অন্তত ৪৩ জন নির্মাণ কর্মী।
ব্যাংকক পুলিশ জানিয়েছে, রাজধানী শহরের চাতুচাক মার্কেটের কাছে ছিল এই ভবনটির অবস্থান। ভূমিকম্পের সময় ৫০ জন কর্মী ছিলেন ভবনটিতে। ভূমিকম্পের সময়ে তাদের মধ্যে ৭ জন ভবনটির বাইরে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন, বাকিরা বের হতে পারেননি।
ভবন ধসের চিত্রটি ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেন একজন নেটিজেন। মুহূর্তের মধ্যেই ভাইরাল হয় সে ভিডিওটি।
শুক্রবার দুপুরে মিয়ানমারে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। দেশটির মধ্যাঞ্চলীয় শহর সাগাইংয়ে ভূ-পৃষ্ঠের ১৬ কিলোমিটার গভীরে ছিল ভূকম্পটির এপিসেন্টার বা উৎপত্তিস্থল।
মার্কিন ভূতাত্তি¡ক জরিপ সংস্থা ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) অনুসারে, মিয়ানমারে ৭.৭ এবং ৬.৪ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে।
ভূমিকম্পের পর মিয়ানমারের হালনাগাদ অবস্থা সম্পর্কে এখনও বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি; তবে থাইল্যান্ডে ক্ষয়ক্ষতির বিভিন্ন চিত্র, ভিডিও ও তথ্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে এবং এসব থেকে বোঝা যাচ্ছে যে ভূমিকম্পটি বেশ বিধ্বংসী ছিল।
রাজধানী ব্যাংককের বেশ কিছু সড়কে ফাটল ধরেছে, একাধিক ভবনও ধসে পড়েছে। থাই প্রধানমন্ত্রী পায়েতংতার্ন সিনাওয়াত্রা ইতোমধ্যে ব্যাংককে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন।
ব্যাংককের পাশাপাশি কম্পন অনুভূত হয়েছে থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল এবং ব্যাংককের আশপাশের এলাকাতেও। উত্তরাঞ্চলীয় বিভিন্ন শহরে ভবনকে কাঁপতে দেখে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন শত শত মানুষ।
উত্তর থাইল্যান্ডের পর্যটন শহর চিয়াং মাইয়ের বাসিন্দা দুয়াংজাই এএফপিকে বলেন, “আমি আমার ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম। কম্পন টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির বাইরে সড়কের দিকে ছুটে বেরিয়ে এসেছি।”
অন্যদিকে শক্তিশালী ভূমিকম্পের আঘাতের পর থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। থাই প্রধানমন্ত্রী পেতাংতার্ন সিনাওয়াত্রা জানিয়েছেন, মিয়ানমারকে কেন্দ্র করে একটি বড় ভূমিকম্পে ব্যাংকক শহরে আঘাত হানার পর শুক্রবার থাই কর্তৃপক্ষ ব্যাংককে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে।
নিরাপদে বাংলাদেশীরা : তবে দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকরা নিরাপদ রয়েছেন বলে জানিয়েছেন দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোঃ মনোয়ার হোসেন। শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে এ তথ্য জানান তিনি।
রাষ্ট্রদূত বলেন, 'মিয়ানমারে অবস্থানরত সব বাংলাদেশি নাগরিক নিরাপদ রয়েছে। শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টায় একটি শক্তিশালী ৬ দশমিক ৪ এবং ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প উত্তর মায়ানমার অংশে অনুভূত হয়েছে।’ 
সূত্র : এএফপি, বিবিসি, রয়টার্স।

্রিন্ট

আরও সংবদ