খুলনা | বুধবার | ০২ এপ্রিল ২০২৫ | ১৯ চৈত্র ১৪৩১

প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে বাংলাদেশের অর্জন কী?

খবর প্রতিবেদন |
০১:০৫ পি.এম | ৩০ মার্চ ২০২৫


অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। প্রথম এই দ্বিপাক্ষিক সফরে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বেশকিছু চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এ সফরের সময়ে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের বৈঠক হয়েছে, যেখানে তারা দুই দেশের সম্পর্ক আরও গভীর ও শক্তিশালী করার বিষয়ে আলোচনা করেন। এরই মধ্যে, চীনের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কর্মসূচি ও বর্তমান পরিস্থিতির প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করা হয়েছে।

তবে এই সফরের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষকরা এখন আলোচনায় মগ্ন হয়েছেন—বাংলাদেশ কি প্রকৃতপক্ষে কোনো বড় অর্জন পেয়েছে? বিশেষ করে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং নানা গুরুত্বপূর্ণ খাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অগ্রগতির বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে।

অধ্যাপক ইউনূসের চীন সফরে দেশের জন্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন হতে পারে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলো। দুই দেশের মধ্যে যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে, চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা বিষয়ক একটি চুক্তি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিল্পখাতের অগ্রগতি এবং অন্যান্য সহযোগিতা আরও গতিশীল হবে।

বিশেষভাবে, চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে ২১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ এবং ঋণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও চাঙ্গা করতে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া, মোংলা বন্দরের উন্নয়ন এবং দুটো নতুন স্পেশাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনের ব্যাপারে চীনের সহায়তার বিষয়ে আলোচনাও হয়েছে।

বাংলাদেশ চীন অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সাহাবুল হক বলেছেন, ‘এই সফর বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত লাভজনক, কারণ এতে বিভিন্ন খাতে যৌথ কর্মপরিকল্পনা এবং বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে।’

চীনের সাথে নতুন সহযোগিতার আরেকটি বড় দিক হলো— স্বাস্থ্য সেবায় চীনের উদ্যোগ। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অনেক নাগরিক ভারতে চিকিৎসা নিতে যেতেন, তবে বর্তমানে ভারতের ভিসা পেতে সমস্যা হওয়ায় চীন একটি নতুন গন্তব্য হিসেবে হাজির হয়েছে।

চীন বাংলাদেশি রোগীদের জন্য কুনমিং শহরের চারটি হাসপাতাল বরাদ্দ করেছে। এছাড়া, চীন বাংলাদেশ থেকে চট্টগ্রাম শহর থেকে কুনমিংয়ের জন্য নতুন ফ্লাইট পরিচালনা করার পরিকল্পনা করছে। এটি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের মানুষকে চীনে সহজেই চিকিৎসা নিতে সক্ষম করবে। চীনের পক্ষ থেকে রোবটিক ফিজিওথেরাপি, কার্ডিও ভাস্কুলার সার্জারি এবং অন্যান্য উন্নত স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ জানিয়েছেন, ‘এখন থেকে চীনের কুনমিংকে বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সেবা গন্তব্য হিসেবে দেখা হবে।’

পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ চীনের সাহায্য চেয়েছে। সম্প্রতি, চীনের সঙ্গে তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা ও পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যানের জন্য চীনের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।

এছাড়া, চীনের কাছে তিস্তা নদীর ড্রেজিং এবং নদী শাসন বিষয়েও সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। চীন ইতিপূর্বে ২০২১ সালে তিস্তা নদীর ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল, তবে ভারতীয় আপত্তির কারণে সেটি থেমে গিয়েছিল। এই সফরে, বাংলাদেশ চীনের কাছে আবারও কাজ শুরু করার অনুরোধ করেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘তিস্তা ইস্যুতে চীন থেকে সহযোগিতা পাওয়া বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, কারণ চীনের উপস্থিতি এই ইস্যুতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে বাংলাদেশ চীনকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে আহ্বান জানিয়েছে। ২০১৭ সালে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল, এবং এখনও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য কোনো স্থায়ী সমাধান আসেনি।

এ সফরে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের মিয়ানমারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তাই চীন যদি আগ্রহী হয়, তবে মিয়ানমার সরকারের উপর চাপ তৈরি করে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া সহজতর হতে পারে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেছেন, ‘চীনের সাথে আলোচনা হওয়া কিছু বিষয় নতুন নয়, তবে চীন যদি উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান সম্ভব হতে পারে।’

সফরের একেবারে শেষে, বাংলাদেশ ও চীনের পক্ষ থেকে এক যৌথ বিবৃতিতে এক চীন নীতির প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ তাইওয়ানকে চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকার করে’। চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন তাইওয়ান বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে নানা মতপার্থক্য থাকলেও, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ নীতি বজায় রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন, ‘বাংলাদেশ বরাবরই এক চীন নীতি অনুসরণ করে এসেছে, এবং চীনের এই আগ্রহের কারণে বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে।’

সর্বপরি, অধ্যাপক ইউনূসের সফরটি বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় নিয়ে এসেছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য, পানি ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করেছে। তবে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যেমন তিস্তা নদী এবং রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে এখনও কিছু সময় এবং আলোচনা প্রয়োজন। চীন যদি সহযোগিতার ক্ষেত্রে আরও সক্রিয় হয়, তাহলে বাংলাদেশ তার নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে। 
সূত্র: বিবিসি

্রিন্ট

আরও সংবদ