খুলনা | শনিবার | ০৩ মে ২০২৫ | ২০ বৈশাখ ১৪৩২

স্থানীয় দুর্বৃত্তদের রোষানলে পড়ে সর্বশান্ত স্বামী, সন্তান নিয়ে জীবন বাঁচাতে শহরে নিয়েছেন আশ্রয়

একজন সফল নারী উদ্যোক্তার করুণ কাহিনী

নিজস্ব প্রতিবেদক |
০২:০১ এ.এম | ০১ মে ২০২৫


ইসরাত জাহান। একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। মাত্র দশ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করা পোল্ট্রি খামারটি বৃহৎ আকার ধারণ করে। দিন-রাত পরিশ্রম করে স্যাটিনারী, মেডিসিন, কাপড়, ট্রেডিং, টাইপিংয়ের দোকান, মাছের ঘের করে স্বাবলম্বীও হয়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয় দুর্বৃত্তদের রোষানলে পড়ে এবং তাদের হুমকি-আজ তিনি সর্বশান্ত হয়ে  স্বামী, সন্তান নিয়ে জীবন বাঁচাতে খুলনা শহরে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। গ্রাম থেকে উঠে আসা ইসরাত জাহান বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে নিজের জীবনের উত্থান-পতনের কাহিনী তুলে ধরেন।
খুলনা প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ইসরাত জাহান বলেন স্বল্প পুঁজি নিয়ে খুলনার রূপসার নৈহাটী পৈতৃক বাড়িতে মুরগীর খামার গড়ে তুলে দিন-রাত পরিশ্রম করে ধীরে ধীরে সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করি। বছরের পর বছর অন্যান্য ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে নিজেকে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে এলাকায় পরিচিতি পাই। আমার মাসিক আয় ছিল দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। কিন্তু স্থানীয় দুর্বৃত্তদের রোষণালয়ে পড়ে এবং তাদের হুমকি-আজ আমি সর্বশান্ত।
তিনি বলেন, রূপসার নৈহাটি গ্রামে আমার পৈতৃক বাড়িতে ২০১৩ সালে আমি পোল্ট্রি খামার গড়ে তুলি। দিন-রাত পরিশ্রম করে খামরটিকে দাঁড় করাই। লাভজনক হওয়ায় ব্যবসার পরিধি বাড়াই। নিজে ৫ কাঠা জমি ক্রয় করে বসত বাড়ি ৪ তলা এবং খামার প্রকল্পে ৫ তলা ফাউন্ডেশন তৈরি করি। পাশাপাশি প্রভিটা ফিড কোম্পানির ডিলারশীপ নিই। এছাড়া ভ্যাটিনারী, মেডিসিন, কাপড়, ট্রেডিং, টাইপিংয়ের দোকান, মাছের ঘের ইত্যাদি ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে নিজেকে আরো স্বাবলম্বী করে তুলি। এসব ব্যবসা থেকে আমার প্রতিমাসে আয় ছিল দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। আমার মুরগীর খামারের শেডগুলো ছিল দেখার মতো। সেখানে ১ হাজার ৮শ’ মুরগির মধ্যে ৯৪% মুরগী প্রতিদিন ডিম দিতো।
এই নারী উদ্যোক্তা আরো বলেন, ২০২১ সালে এলাকার কতিপয় দুর্বৃত্ত আমার খামারে বিষ প্রয়োগ করে। এতে আমার সব মুরগী মারা যায়। এ ঘটনায় আমার সব মিলিয়ে প্রায় ২৮ লাখ টাকা ক্ষতি হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় থানায় মামলা করতে গেলে তারা মামলা নেয়নি। তখন আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে বিচার চাইলে তিনি থানার ওসিকে ফোন করে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান। তখন স্থানীয় চেয়ারম্যানের নির্দেশে ইউপি সদস্য সোহেল, আলমগীর এবং থানার এএসআই আজাদের উপস্থিতিতে শালিসী বৈঠকে এ ঘটনার সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করা হয়। বিচারকরা প্রতিপক্ষের নিকট আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিচারে মাত্র ৭ হাজার টাকা জরিমানা করে। আমি ক্ষতিপূরণ না নিয়ে রাগে-দুঃখে সেখান থেকে চলে আসি। আমি নাকি ‘বিএনপির’ রাজনীতি করি এই তকমা দিয়ে আইনগত সহায়তা গ্রহণে বাধা প্রদান করে এলাকার কুচক্রী মহলেরা। একসাথে এতগুলো টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর মানুসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি। ফলে অন্যান্য ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সর্বশান্ত হয়ে যাই। তখন খামারটিকে দাঁড় করানোর জন্য যুব উন্নয়ন থেকে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে নতুন করে শুরু করি। কিন্তু এরপর খামারে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে খামার ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে নিঃস্ব হয়ে ধারদেনা পরিশোধ এবং স্বামীকে বিদেশে পাঠানোর জন্য ৫ কাঠার উপর নির্মিত বাসভবনটি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিই।
ইসরাত জাহান বলেন, ভবনসহ ওই জমিটি ৩৭ লাখ টাকায় বিক্রির জন্য একজন গ্রাহকের সাথে কথাবার্তা ফাইনাল হলে তা জানাজানি হয়। আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেই জমি ক্রয় করার আগ্রহ দেখিয়ে ২৫ লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। স্বামীকে বিদেশে পাঠানোর জন্য এবং দেনা পরিশোধ করার জন্য আমার নগদ টাকার অনেক প্রয়োজন ছিল। ফলে শেষ পর্যন্ত রাজী হই। কথা হয় সব টাকা এক সাথে পরিশোধ করার পর রেজিস্ট্রি করে দেব। কিন্তু ইব্রাহীম হুজুর তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে নগদ দুই লাখ টাকা দেয়। এরপর সে আজ-কাল বলে ঘোরাতে থাকে। আমার নগদ টাকার দরকার হওয়ায় জমি রেজিস্ট্রি করার জন্য চাপ দেই। তখন সে আমাকে আরো এক লাখ টাকা দেয়। এরপর তাকে জমি রেজিস্ট্রি করার জন্য তাগিদ দিলে গোল্লা হুজুর বিভিন্ন সময়ে ৫ হাজার দশ হাজার করে সর্বমোট ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা প্রদান করে। এদিকে আমার স্বামীর বিদেশ যাওয়ার ভিসা এসে গেলে জমি রেজিস্ট্রি করার জন্য ইব্রাহীম হুজুরকে অনুনয় বিনয় করতে থাকি। তখন তিনি ২৫ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে ২২ লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। স্বামীকে বিদেশে পাঠাতে দশ লাখ টাকা দরকার। রোমানিয়া থেকে ভিসা এসে গেছে। তখন ২২ লাখেই রাজী হই। কিন্তু জমি রেজিস্ট্রি না করে ওই প্রতারক আমাকে ঘোরাতে থাকে। এরপর বলে ১৮ লাখ টাকায় জমি বিক্রি করলে তিনি পরের দিন রেজিস্ট্রি করবেন। তবে বাড়ির চাবি আজই দিতে হবে, বাড়িতে থাকা ফার্নিচারসহ কোন আসবাবপত্র নেওয়া যাবে না এমন শর্ত জুড়ে দিয়ে তিনি বলেন, শর্ত মানলে পরের দিন টাকা দিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে দিবেন। এভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ঘোরাতে থাকায় টাকার জন্য আমার স্বামী বিদেশে যেতে পারেনি।
ইসরাত জাহান বলেন, আমি তখন বাড়ি বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নেই এবং তাকে জানিয়ে দেই। ফলে আমার কাছে পাওনা ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। ৫ আগস্টের পর আমাকে আওয়ামী লীগের নেত্রী তকমা দিয়ে বিএনপি’র পরিচয়ে একদল লোক নিয়ে আমার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং জীবননাশের হুমকি দিয়ে বাড়ি দখলের চেষ্টা চালায়। আমার এক মেয়ে কলেজে লেখাপড়া করে। ছোট ছোট সন্তান রয়েছে। তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে ওই রাতেই এলাকা ছেড়ে খুলনার গল্লামারী এলাকায় আশ্রয় নিই। বর্তমানে খুলনা বিশ্ববিদ্যলয় রোডে একটি ছোটখাট রেস্টুরেন্ট দিয়ে কোনমতে বেঁচে আছি। এ খবর জানতে পেরে গত ৮ ফেব্র“য়ারি ইব্রাহীম হুজুর লোকজন নিয়ে আমার রেস্টুরেন্টে এসে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও জীবন নাশের হুমকি দেয়।
সফল নারী উদ্যোক্তা ইসরাত জাহান সংবাদ সম্মেলনে পরিবারসহ জীবনের নিরাপত্তায় প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা ও তদন্তের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। 

্রিন্ট

আরও সংবদ