খুলনা | সোমবার | ১২ মে ২০২৫ | ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

একজন গুণীব্যক্তি অহনের আত্মহত্যা ও অন্তরালের কতিপয় ভাবনা

প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী |
০১:২৭ এ.এম | ১০ মে ২০২৫

 
কথায় আছে-আপনি ১ মিনিট বিষণœতার মধ্যে সময় কাটালেন তো ৬০ সেকেন্ড জীবনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলেন। আকাশে যখন রংধনু দেখা যায়, তখন তা রোদ্র ও বৃষ্টি উভয়কে মোকাবেলা করে অতঃপর তাকে আকাশে আবির্ভাব হতে দেখা যায়। তেমনি জীবন অনেক সুন্দর-আর জীবনকে ব্যথা-বেদনার বাহুডোরে আবদ্ধ থেকে তাকে আরো সুন্দরতম স্থানে অধিষ্ঠিত করার দায়িত্ব আমার নিজেরই।
স¤প্রতি আমাদের সমাজে আত্মহত্যা প্রবনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের অভিভাবক সমাজ তাদের সন্তানদের বর্তমান জীবনবোধকে কেন্দ্র করে বেশ উদ্বিগ্ন। অত্যন্ত তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করেও সন্তানদের স্বচেতনায় আত্মহনন সদৃশ অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্ত গ্রহনে বর্তমান হালচাল প্রাজ্ঞ সমাজ থেকে সাধারণ মানুষের নিকট আজ মাথা বেদনার বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি আমাদের মাঝ হতে চির বিদায় নিলেন অহন (ছদ্ম নাম) নামক এক জন গুনি ও জ্ঞানী ব্যক্তি। মূলত: অহনের মত অনেকেই জীবন হতে পালানোর আশা হতে আত্মহনন নামক অবিমৃশ্যকারী পথকে বেছে নিতে উদ্ধত হচ্ছে। মূলত এর কারণ সমূহ কি হতে পারে - একজন মনস্তাত্তিক কাউন্সেলির হিসেবে বাস্তব বিষয় সমূহ নিয়ে কাজ করার সুবাদে সম্ভব্য কিছু বিষয় তুলে ধরলাম।
একজন স্বামী আক্ষেপ করে বলছে- ২৭ বছর ধরে তার সাথে সংসার করে যাচ্ছি। আপদ মস্তক তার জন্য তথা তাকে ভালো রাখার জন্য দিন রাত্র খেটে যাচ্ছি। এর পরও আমি খুব অসহায় বোধ করি-যখন দেখি তাকে আমি খুশি করতে পারিনি বা সে যখন অন্যের সামনে বা আমার বাবা মায়ের সামনে আমাকে অপমান করে বা অবহেলা করে। তখন আমার মনে হয়-আমি যেন তার নিকট ডোরম্যাট বা পাপোসের মত ব্যবহৃত হচ্ছি। পাপসকে আমরা সবাই চিনি বা জানি। পাপসকে আমরা সারা দিন পা দিয়ে মাড়ালেও সে কোন প্রতিবাদ করবেনা কারণ পাপোস একটি জড় পদার্থ,তার প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নাই। কিন্তু আমাদের স্পাউস তথা স্বামী বা স্ত্রী অথবা মা-বাবা কি পাপোস?  অবশ্যই নয়-কারণ তারা অবজেক্ট নয়। তাদের প্রাণ আছে। যার প্রাণ আছে,তার ভালো লাগা বা মন্দ লাগা আছে, তার চাহিদা আছে, তাদের আকাক্সক্ষা আছে-আমরা আমাদের স্পাউস তথা স্বামী বা স্ত্রী অথবা মা-বাবার সাথে ডোরম্যাট বা পাপোসের মত ব্যবহার করছি নাতো? মনে রাখতে হবে আমাদের স্পাউস তথা স্বামী বা স্ত্রী অথবা মা-বাবা ডোরম্যাট বা পাপোসের নয়। আর যদি আমরা তাদের সাথে ডোরম্যাট বা পাপোসের মত ব্যবহার করি ,তবে তারা এক সময় হতাশায় নিমজ্জিত হতে বাধ্য হবে এবং বিপক্ষেও চলে যেতে পারে। আমি  নিশ্চিত নয় তবু মনে হয় – অহনের ক্ষেত্রে ডোরম্যাট বা পাপোসের মত আচরণ করাও হতে পারে। তাকে মানুষ নয়, একটা অবজেক্ট হিসেবে বিবেচনা করে সব সময় তার সাথে খারার আচরণ করা হতে পারে। যে কারণে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে।
আমরা ইন লাভ ও রিয়েল লাভের কথা সবাই জানি। আমাদের মৌলিক আবেগীয় চাহিদা হলো ভালোবাসায় পতিত হওয়া নয় বরং প্রকৃত ভালোবাসায় আবদ্ধ হওয়া। আমাদের মৌলিক আবেগীয় চাহিদার মধ্যে ভালোবাসা একটি অন্যতম। ভালোবাসা ছাড়া জীবন অচল। আমার একজনের ভালোবাসা পাওয়া প্রয়োজন-যে সত্যিকারে আমাকে ভালোবাসতে চায়, আমাকে পছন্দ করবে, যে আমার ভিতর গুরুত্ব খুঁজে পায়। আমরা তখনই নিরাপত্তা বোধ করি; যখন আমারা নিশ্চিত হতে পারি যে-আমার সাথি আমাকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করে, আমাকে গভীর ভাবে চায় এবং আমাকে ভালো রাখতে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ। আমরা ভালোবাসার  ইন লাভ স্টেজে-এরুপ সব আবেগ অনুভব করি। যতক্ষণ এরূপ ভাবনা টিকে থাকে ততক্ষণ আমার ভালোবাসার অপর আনন্দে ভেসে থাকি। তখন সংসারটা মনে হয় স্বর্গ সুখ স্বরূপ। কিন্তু ভালোবাসার অবসেসন চিরস্থায়ী নয়। যখন ভালোবাসার অবসেসন চলে যায়-তখন শুরু হয় দোষ-ত্র“টি খোঁজার পালা। কিন্তু মনে রাখার দরকার-প্রকৃত ভালোবাসা হলো একটা ইতিবাচক মনোভাব, যেখানে ভাবনা তৈরি হয়- আমি তোমার সাথে গভীর ভালোর সম্পর্কে আবদ্ধ এবং আমি তোমার পছেন্দের অনুকুলে যে কোন কাজ করতে আগ্রহী। প্রকৃত ভালোবাসার সম্পর্কে অপরকে ভালো রাখতে অন্যজন যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতেও রাজি হয়। জানিনা অহন পরিবার প্রকৃত ভালোবাসার চাদরে আবদ্ধ ছিল কি? প্রশ্ন রয়ে যায়।
আমরা ভালোবাসার জন্য কান্না করি। সেই বোঝে ভালোবাসা বিহীন জীবনের কষ্ট; যে তার প্রকৃত ভালাবাসার সাথীকে হারায়ে ভালোবাসাকে হারায়েছে। আমরা বিবাহ করি কেন? কারণ আমরা অন্যের নিকট বিধির আওতায় সম্পর্কে আবদ্ধ হতে চায় এবং ভালোবাসা পেতে চায়। বিবাহের পর দুটি আত্মা তখনই একটি আত্মায় পরিণত হয়,যখন তারা সম্পর্কের অতল গভীরে প্রবেশ করে।  সম্পর্কে অতল গভীরে প্রবেশ করার কারণে দু’টি আত্মা একটি আত্মায় পরিণত হয়েছেন- তার মানে আপনি আপনার সত্ত¡া বা আত্ম পরিচিতিকে হারিয়ে ফেলেছেন; তাহা নয় কিন্তু। বরং আপনি আপনার সম্পর্কেকে আরো সুদৃঢ় গভীরে প্রবেশ করেছেন। এরুপ সম্পর্ক বিহীন ভাবনা  পরিণত হয় ভালোবাসা বিহীন বটমলেস বাস্কেটে- যা সম্পর্ককে ক্রমে দূরে সরিয়ে দেয় বটে।
আমার অনেক দম্পতির অন্তরের কষ্টকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমাদের ভালাবাসা চলে গেছে, আমরা আর আগের মত ঘনিষ্ঠতা উপভোগ করি না। আমরা আর আগের মত আমাদের সম্পকর্কে উপভোগ করি না। আমাদের সম্পর্কটা চার দেওয়ালে আটকে আছে। আমরা আগের মত একজন আপরকে বিশ^াস করতে পারছি না। আমর মনে হয়-আমরা শুধু এখন রুমমেটের মত বসবাস করছি। এ সব কিছু ইমোসনাল লাভ ট্যাং- কে শূন্যতাতে নির্দেশ করছে। এখনকার সম্পর্কে ইমোসনাল লাভ ট্যাং শূন্য হওয়ায় - আমাদের এখন দোষ-ত্র“টি ধরার সংসার হয়েছে। আমরা এখন এক অপরের সমালোচনায় ব্যস্ত কারণ এখন আমাদের ইমোসনাল লাভ ট্যাং শূন্য অবস্থায় অবস্থান করছে। কিন্তু মনে রাখার দরকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইমোসনাল লাভ ট্যাংকে পরিপূর্ণ রাখা খুবই জরুরী যেমনটা প্রয়োজন মটর বাইক সচল রাখার ক্ষেত্রে তেলের ট্যাঙ্কিতে সঠিক মাত্রায় তৈলকে বজায়ে রাখা। সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইমোসনাল লাভ ট্যাংকে শূন্য রেখে আমরা যদি সম্পর্কে টিকায়ে রাখতে চেষ্টা করি-তবে হবে অনেকটা তৈল বিহীন গাড়িকে সচল রাখার বৃথা প্রচেষ্টা মাত্র। যখন আপনার সাথির ইমোসনাল লাভ ট্যাং পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং যদি সে মনে করে-আপনার সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সে নিরাপদ: তবে তার নিকট পৃথিবীটা অনেক সম্ভাবনাময় এবং উজ্জ্বল হয় উঠতে পারে এবং সে তখন সাফল্যের উচ্চ দ্বারে পৌঁছাতে সক্ষম হতে পারে। আর যদি আপনার সাথির ইমোসনাল লাভ ট্যাং শূন্যতায় পর্যবসিত হয় এবং যদি সে মনে করে- আপনার সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সে ব্যবহৃত হয়েছে: তবে তার নিকট পৃথিবীটা সম্ভাবনাময় এবং উজ্জ্বল হওয়ার পরিবর্তে অন্ধকারে পর্যবসিত হতে পারে  এবং  তখন তার সকল সক্ষমতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত । অহনের ক্ষেতে এমনটি হতে পারে যা তাকে মৃত্যুর ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতে পারে। 
আত্মহত্যা পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতি সবার জন্য পরম দু:খ ও কষ্টের। আত্মহত্যার মাধ্যমে পাবার কিছু নাই বরং আত্মহত্যার পরিণতিতে বহন করতে হয় আধ্যাত্ম জগতের দুঃখ ও যন্ত্রণা। তাই আসুন সমস্বরে ’আত্মহত্যাকে না বলি, সুন্দর জীবন গড়ি’। 
(লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ, খুলনা, ফ্রি পরামর্শ; ০১৭১৪৬১৬০০১)

্রিন্ট

আরও সংবদ

অন্যান্য

প্রায় ৫ মাস আগে