খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২২ মে ২০২৫ | ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

পরিত্যক্ত পিলার যেন কপোতাক্ষের বোবা কান্না!

পারভেজ মোহাম্মদ |
০২:১২ এ.এম | ২২ মে ২০২৫


কেউ কথা রাখেনি। দেখতে দেখতে এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে ২২টি বছর। রয়েছে অযুত আর নিযুতের মাঝ বরাবর মানুষের দীর্ঘশ্বাস। অসমাপ্ত সেতুর ১৮টি পরিত্যক্ত পিলার গর্ভে ধারণ করে রেখেছে কপোতাক্ষ নদ। মৃতপ্রাই কপোতাক্ষ বাঁচাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা। নদী খননের সেই সুফল ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে পরিত্যক্ত পিলারের কারনে। একটি মাত্র ব্রিজ। সেই ব্রিটিশ শাসনামল থেকে অনেকগুলো স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু। পাইকগাছা উপজেলার আধুনিক কপিলমুনির রুপকার রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু। এই জনপদের বাণিজ্যিক স¤প্রসারণে  কোলকাতার সাথে সরাসরি যোগাযোগ সৃষ্টিতে কপোতাক্ষের উপর  একটি সেতু বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন জনপদের মানুষকে। সেই থেকে শুরু সেতুর জন্য স্বপ্ন দেখা।
সূত্রমতে, গণদাবির প্রেক্ষিতে সরকার সেতু নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে ১ কোটি ৯৩ লাখ ৪২ হাজার ৯শ’ ১৯ টাকা ৫৫ পয়সা ব্যয় বরাদ্দ করে। পরে কাজের মানোন্নয়নে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে ২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা করা হয়। সেতুটির নির্মাণ কাজ পান সাবেক সংসদ সদস্য এড. শেখ মোঃ নুরুল হকের মালিকানাধীন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এন হক এসোসিয়েট। প্রতিষ্ঠানটি ২০০০ সালে সেতু নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করে। এরপর ২০০৩ সালের ১২ নভেম্বর পর্যন্ত আংশিক কাজ করে ১ কোটি ৬৭ লাখ ৭২২ টাকা আই এফ আই সি ব্যাংক খুলনা হতে উত্তোলন করে এর নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়।
বিষয়টি নিয়ে ঐ সময় আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে মামলাসহ নানা জটিলতায় বন্ধ থাকে সেতুর নির্মাণ কাজ। এমন পরিস্থিতিতে সেতুর বাকি নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করতে অপর একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিলেও সাতক্ষীরা পাউবোর ভ্রান্ত ধারণার উপর ভর করে বিশেষত, কপোতাক্ষ নদের স্রোতে বাধা পাওয়ার আশঙ্কার কথা উলে­খ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো একটি পত্রে একবারে বন্ধ হয়ে যায় সেতুর সামগ্রিক নির্মাণ কাজ। সেই থেকে গত ২২ বছর বন্ধ রয়েছে এর নির্মাণ কাজ। এরআগে সেতুর এপ্রোচ সড়ক নির্মাণে দু’পারে জমি অধিগ্রহণ ও সংযোগ সড়ক নির্মাণে মাটি ভরাট করে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে পাউবোর আশঙ্কায় সেতু নির্মাণ কাজ বন্ধ হলেও নদের বুকে থেকে যায় সেতুর নির্মাণাধীন ১৮টি পিলার। এরপর ২০১১ সালে কপোতাক্ষ নদ খননে প্রায় ২৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার।
ইতোপূর্বে সেতু বাস্তবায়নে কার্যক্রম শুরু করেও শেষ করা যায়নি। আর এর সাথে অপমৃত্যু ঘটে দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন। তবে সর্বশেষ ফাইল চালাচালির এক পর্যায়ে  গত বছর আবারো আলোচনায় আসে কপিলমুনির সেতু বাস্তবায়নের বিষয়টি। শুরু হয়  নতুন করে  স্বপ্নের বীজ বুননের। স্থানীয়রা জানান, কপোতাক্ষের কপিলমুনি কেন্দ্রিক সেতুর বাস্তবায়ন হলে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর থেকে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন হবে কপিলমুনির। বর্তমানে দু’টি রোড ক্রস করে ভোমরা থেকে কপিলমুনির দূরত্ব প্রায় ৪০/৪৫ কিলোমিটার যা, কমে অর্ধেকে চলে আসবে।
এমনটি হলে দক্ষিণ খুলনার অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র কপিলমুনি কেন্দ্রিক গড়ে উঠবে বহুমাত্রিক বাণিজ্যিক জোন। যেখান থেকে এর সুবিধা পৌঁছে যাবে সাতক্ষীরার আশাশুনি, তালা, খুলনার পাইকগাছা, কয়রা, ডুমুরিয়া, দাকোপ, বটিয়াঘাটা তথা সরাসরি খুলনায়।
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত হিমায়িত চিংড়ি। এর উৎপাদনস্থল সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট হলেও দীর্ঘ দিনেও এর কোন নির্দিষ্ট জোন গড়ে ওঠেনি। সেতুটিকে কেন্দ্র করে বিস্তীর্ণ জনপদের পারস্পরিক স্বার্থ সুরক্ষায় সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় গড়ে উঠতে পারে চিংড়ি জোন। এছাড়া সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার অভাবে অত্রাঞ্চলে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের সঠিক দাম থেকে বরাবরই বঞ্চিত হন এ অঞ্চলের কৃষকরা। সেতুটির বাস্তবায়নে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সাথে সড়ক যোগাযোগে ব্যবস্থা স্থাপন হলে বাজার ব্যবস্থাপনায়ও ঘটবে আমুল পরিবর্তন।
এছাড়া ভারত থেকে ভোমরা হয়ে সরাসরি আমদানি পণ্য যেমন পৌঁছে যাবে কপিলমুনিতে তেমনি রপ্তানি পণ্যও সরাসরি পৌঁছাবে ভারতে। আর সরাসরি আমদানি রপ্তানির বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বানিজ্যিক স¤প্রসারণে নতুন মাত্রায় যুক্ত হবে নতুন নতুন উদ্যোক্তা।
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার জালালপুর ও খেশরা ইউনিয়নের ১৯টি গ্রামসহ বিস্তীর্ণ এলাকার হাজার হাজার মানুষ সাঁকো পার হয়েই আসে বিনোগঞ্জ (কপিলমুনি) কেন্দ্রীক ব্যবসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দৈনন্দিন নানা প্রয়োজনে। বিশেষ করে উৎপাদিত ও নিত্য প্রযোজনীয় পণ্য সরবরাহে প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পার হতে হয় সাঁকোটি।
কপিলমুনির এড. দীপঙ্কর সাহা জানান, আধুনিক কপিলমুনির স্থপতি রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু কপোতাক্ষের উপর সেতু নির্মাণে তৎকালীন কলকাতা রিজার্ভ ব্যাংকে এক লক্ষরও বেশি পরিমাণ টাকা রেখে যান। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত সম্পর্কের অবনতির আগ পর্যন্ত বিনোদ বিহারী সাধু প্রতিষ্ঠিত কপিলমুনি সহচরী বিদ্যা মন্দির ও সিদ্ধেশ্বরী ব্যাংক প্রতি বছর ঐ টাকার লভ্যাংশ হিসেবে অর্ধ লক্ষাধিক টাকা পেত।
দীর্ঘ দিন ব্রিজটির বাস্তবায়ন নিয়ে কাজ করা বিশিষ্ট সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী পারভেজ জানান, তিনি দীর্ঘ দিন যাবৎ ব্রিজটির বাস্তবায়ন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন, কপোতাক্ষের উপর কপিলমুনি-কানাইদিয়া সেতু নির্মাণে প্রকৃত পক্ষে কোন বাধা নেই। সারাদেশে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর যে পরিমাণ উন্নয়ন কাজ তরান্বিত করছে তাতে করে শুধু দরকার আমাদের সদিচ্ছা। তবেই সম্ভব হবে স্বপ্নের বাস্তবায়ন। তা না হলে অসমাপ্ত ব্রিজের ১৮টি প্লেয়ার ওকে ধারণ করে কপোতাক্ষের বোবা কান্না চলবে যুগের পর যুগ। দক্ষিণাঞ্চলের  কপোতাক্ষ তীরবর্তী মানুষের প্রতিদিনের রাতের স্বপ্ন দিনের আলোয় ম্লান হয়ে যাবে। 

্রিন্ট

আরও সংবদ