খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২৯ মে ২০২৫ | ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

৯ সন্তান হারিয়েও সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ডা. আলা

কাঁদছে আদম, শেষ এক বোতল দুধ এখনও শিশু সিদরার অপেক্ষায়

খবর প্রতিবেদন |
০২:২৫ পি.এম | ২৬ মে ২০২৫


দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে ইসরায়েলি বিমান হামলায় একসঙ্গে ৯ সন্তান হারিয়েছেন ফিলিস্তিনি শিশু চিকিৎসক ডা. আলা আল-নাজ্জার। হৃদয়বিদারক এই ঘটনার পরও তিনি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে।

নাসের হাসপাতালের চিকিৎসক আহমদ আল-ফাররা মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে জানান, সন্তানদের হারানোর পরও ডা. নাজ্জার নিজের কাজ বন্ধ রাখেননি। মাঝে মাঝে তিনি স্বামী ও একমাত্র জীবিত সন্তানকে দেখতে যান।

গেল শুক্রবার কাজে যাওয়ার সময় নিজের ১০ সন্তানকে বাসায় রেখে গিয়েছিলেন তিনি। এরপরই ইসরায়েলি হামলায় সাত শিশুর দগ্ধ মরদেহ হাসপাতালে আনা হয়। গাজা সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, ডা. নাজ্জারের বাড়িতে বিমান হামলাতেই তারা নিহত হয়। তার ৭ মাস ও ১২ বছর বয়সী দুই সন্তান এখনও নিখোঁজ, যাদের মৃত্যু হয়েছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

সিএনএন জানায়, ডা. নাজ্জারের ১১ বছর বয়সী ছেলে আদম একমাত্র জীবিত সন্তান। হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন তার স্বামী হামদি, যিনি নিজেও পেশায় চিকিৎসক।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মুনির আল-বুরশ এক্সে (সাবেক টুইটার) জানান, ডা. নাজ্জারের স্বামী বাসায় ফেরার পরপরই সেখানে হামলা হয়। নিহত সন্তানদের মধ্যে রয়েছে ইয়াহিয়া, রাকান, রাসলান, জিবরান, হাওয়া, রিভাল, সায়দেন, লুকমান ও সিদরা।

বুরশ বলেন, ‘এই দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। গাজায় শুধু স্বাস্থ্যকর্মীরা নয়, তাদের পুরো পরিবারকেই নিশানা করা হচ্ছে।’

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা ইউসুফ আবু আল-রিশ জানান, সন্তানদের বাড়িতে রেখে ডা. নাজ্জার হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করতে যান। সেখানে তিনি আশ্রয়হীন অসুস্থ শিশুদের চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। হাসপাতাল পৌঁছানোর পর তাকে ‘দৃঢ়, ধৈর্যশীল ও আল্লাহর জিকিরে মগ্ন’ বলে বর্ণনা করেন রিশ।

৩৮ বছর বয়সী ডা. নাজ্জার শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হলেও যুদ্ধের এই সময়ে জরুরি বিভাগেই কাজ করছেন।

গাজার সিভিল ডিফেন্স ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, খান ইউনিসের বাড়িটিতে ইসরায়েলি বিমান হামলা চালানো হয়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা সেখানে ‘সন্দেহভাজনদের’ লক্ষ্য করে হামলা চালায়। বেসামরিক হতাহতের ঘটনা তারা পর্যালোচনা করছে বলেও জানায়।

আইডিএফের (ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী) এক বিবৃতি অনুযায়ী, সামরিকপ্রধান এয়াল জামির রোববার খান ইউনিস সফর করে হামাসকে ‘চূড়ান্তভাবে ধ্বংস’ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

এদিকে, গাজার সিভিল ডিফেন্স প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা যায়, ধ্বংসস্তূপ থেকে শিশুদের দগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে সাদা কাপড়ে মোড়ানো হচ্ছে, আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে দমকল কর্মীরা।

আহত হামদি আল-নাজ্জারের ভাতিজি ডা. সাহার আল-নাজ্জার জানান, হামলা চলাকালে হামদি শিশুদের জন্য খাবার আনতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে প্রথম একটি অবিস্ফোরিত ক্ষেপণাস্ত্র দেখতে পান। শিশুদের বাঁচাতে তিনি বাড়িতে ঢুকলে দ্বিতীয়বার আক্রমণের শিকার হন।

ডা. সাহার জানান, তার বাবা আহত হামদিকে উদ্ধার করতে গিয়ে রাস্তায় আদমকে পান এবং হাসপাতালে নিয়ে যান। বাকিদের দেহ পুড়ে অঙ্গার হয়ে গিয়েছিল।

তিনি আরও বলেন, বুকের দুধের শেষ বোতল দেখিয়ে রোববার ভেঙে পড়েন ডা. নাজ্জার। তিনি প্রতিদিন কাজের ফাঁকে তার শিশু কন্যা সিদরার জন্য দুধ রেখে যেতেন। এখনও তার মরদেহ উদ্ধার হয়নি।

‘তিনি এখন আর কথা বলতে পারেন না। তার মুখ দেখলেই বোঝা যায়, কতটা যন্ত্রণা তিনি সইছেন। শুধু তার স্বামী ও ছেলের সুস্থতার জন্যই এখন প্রার্থনা করছেন,’ বলেন ডা. সাহার।

একমাত্র জীবিত শিশু আদমকে যখন অস্ত্রোপচারের পর ওটি থেকে বের করা হয়, সে বোন হাওয়ার নাম ধরে চিৎকার করে বলছিল, ‘গাছে রক্ত লেগেছে।’ আদমের হাতে গুরুতর আঘাত আছে, তার আরও একটি অস্ত্রোপচার লাগবে বলে জানিয়েছে সিএনএন।

ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বার্তায় ডা. নাজ্জারকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছে, ‘তিনি সেই অবিচল ফিলিস্তিনি নারী ও চিকিৎসক, যিনি নিজের বেদনা চেপে রেখে অন্যের সেবা করে যাচ্ছেন। এই হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিতদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে চালানো একটি অপরাধ।’

এদিকে, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি (আইসিআরসি) জানিয়েছে, শনিবার খান ইউনিসে বিমান হামলায় তাদের দুই কর্মী নিহত হয়েছেন। তারা বলেছে, ‘এই মৃত্যু গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের ভয়াবহ দুর্দশার প্রতিফলন।’

্রিন্ট

আরও সংবদ