খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২৯ মে ২০২৫ | ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

* ক্লাসে ফিরতে চায় শিক্ষার্থীরা * আন্দোলনের হুঁশিয়ারি কর্মকর্তাদের

অচলাবস্থা কাটছে না কুয়েটে

এন আই রকি |
০১:৩৪ এ.এম | ২৭ মে ২০২৫


খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) অচল অবস্থা নিরসন হচ্ছে না। দুইজন উপাচার্য বদল, শিক্ষকদের আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণসহ নানা কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। গত ১৮ ফেব্র“য়ারি থেকে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এমন অবস্থায় সকল সংকট কাটিয়ে ক্লাসে ফিরতে চায় শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করে একাডেমিক কার্যক্রমে ফিরতে সহমত শিক্ষক সমিতির। তবে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি কুয়েতের বর্তমান অবস্থা নিরসনের জন্য কুয়েট বান্ধব একজন উপচার্যের প্রয়োজন, অন্যথায় সহসা সমাধান হবে না।  
ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে ১৮ ফেব্র“য়ারি কুয়েটে ছাত্রদের সাথে বহিরাগতদের সংঘর্ষ ঘটে। এ সময়ে তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ডঃ মুহাম্মদ  মাছুদসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সকল কার্যক্রম স্থগিত করে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলনে মাঠে নেমে পড়ে। পরবর্তীতে সেটি উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে পরিণত হয়। ২৩ এপ্রিল উপাচার্যের পদ থেকে দাবিতে শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশন শুরু করে। সরকার ২৫ এপ্রিল উপাচার্য প্রফেসর ডঃ মুহাম্মদ মাছুদ এবং উপ-উপাচার্য শেখ শরিফুল আলমকে অব্যাহতি প্রদান করে। এরপরে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরো কৌশল বিভাগের প্রফেসর ডঃ মোঃ হযরত আলীকে গত পহেলা ১ মে কুয়েটের অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর সাধারণ শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক সমিতির সাথে পৃথক ভাবে আলোচনা করেন। শিক্ষক সমিতি ১৮ ও ১৯  ফেব্র“য়ারি শিক্ষক লাঞ্ছনার বিচারের  দাবি জানিয়ে ৪ মে থেকে ক্লাস কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এদিকে ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে ওই সময়ের সংঘর্ষের জড়িত থাকার বিষয়ে শোকজ নোটিশ দেয়া হয়।  শিক্ষার্থীরা শোকজের নোটিশ পাওয়ার পর তার প্রতিবাদ করেন। এমন পরিস্থিতিতে গত সপ্তাহে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য। গত ২১ মে তিনি কুয়েটের অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্যের পর থেকে পদত্যাগ করেন। 
যার ফলে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে কুয়েট। শিক্ষকদের  দাবির  প্রেক্ষিতে বন্ধ রয়েছে একাডেমিক কার্যক্রম, সেশনজটের সম্ভাবনায় পড়েছে শিক্ষার্থী এবং আসন্ন ঈদে বেতন বোনাস নিয়ে দুশ্চিন্তায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। 
কুয়েটের একাধিক শিক্ষার্থীরা জানান, কুয়েটের বর্তমান অবস্থা যদি ঠিক থাকতো তাহলে একটি ব্যাচ এতদিন বের হয়ে যেত। সিনিয়র ভাইয়েরা ইতিমধ্যে অনেকগুলো সার্কুলার মিস করেছে। আমরা যারা অন্যান্য ব্যাচে আছি, তাদের মধ্যে অনেকেই বুয়েটের সাথেই ছিলাম, অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিলাম। আমরা বেশ সুষ্ঠু ও সুন্দর ভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। সে ক্ষেত্রে আমাদের সেশন জোটের সম্ভাবনা ছিল না। বর্তমান যে অবস্থা সেটা নিরসন করে সুষ্ঠু ও সুন্দর ভাবে দ্রুত ক্লাস শুরু না হলে আমাদের সেশন জোটে পড়া সম্ভাবনা রয়েছে।  
ইন্টেরিম গভমেন্টকে উদ্দেশ্য করে শিক্ষার্থীরা বলেন, দীর্ঘ ৯৮ দিনের বেশি ক্যাম্পাসটি বন্ধ। সেভাবে আসলে মন্ত্রণালয়সহ কোন দিক থেকে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। আমরা চাই খুব দ্রুত সুস্থ সমাধানের মাধ্যমে একাডেমিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হবে এবং শিক্ষার্থীরা যেন দ্রুত ক্লাসে ফিরতে পারে সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। 
কুয়েট কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ হাসিব সরদার বলেন,  উপাচার্যের পদটি শূন্য থাকায় আসন্ন ঈদুল আযহার পূর্বে আমাদের বেতন বোনাস এখনো হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় সাড়ে ৬০০ কর্মচারী রয়েছে। বেতন বোনাস না হয় কর্মচারীরা দুশ্চিন্তায় আছে। সরকারের কাছে অনুরোধ, অতি দ্রুত একজন কুয়েট বান্ধব উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে কর্মচারীদের বেতন বোনাসের ব্যবস্থা করা হোক।  
কুয়েট অফিসার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ও ডেপুটি রেজিস্টার মোঃ মঈনুল হক জানান, বর্তমান সমস্যা সমাধানের জন্য একজন কুয়েট বান্ধব উপাচার্য প্রয়োজন। ঈদের আগে যদি সমস্যার সমাধান না হয় তাহলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবে। 
লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর মোঃ গোলাম কাদের জানান, গত ১৮ ফেব্র“য়ারি কুয়েটে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর বহিরাগতরা হামলা চালায়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনাও ঘটে। উত্তেজিত অবস্থায় ছাত্ররাই এই ঘটনা  ঘটায়। ওই সময় শিক্ষার্থীদের যে পাঁচ দফা দাবি ছিল এই দাবিতে আমরা শিক্ষকরা একমত পোষন করেছিলাম। পরবর্তীতে শিক্ষকরা উপাচার্য পদত্যাগের এক দফা দাবি করে। শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে কোন প্রকার তদন্ত ছাড়াই সরকার উপাচার্য এবং  উপ-উপাচার্যকে সরিয়ে দেয়। যেটা আমরা শিক্ষক সমাজ কোনভাবে মেনে নিতে পারি না। পরবর্তীতে সরকারের সিদ্ধান্তে বাইরে একজন শিক্ষক কুয়েটের উপাচার্য  হিসেবে যোগদান করেন। আমরা চেয়েছিলাম শিক্ষার্থীদের পাঁচ দফা দাবি যথাযথভাবে পূরণ করে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হবে। কিন্তু তিনি কোন প্রকার সিদ্ধান্ত ছাড়াই কর্মস্থল ত্যাগ করে চলে যান। যার কারণে আমরা অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়েছি এখন। অচিরে এই সমস্যা সমাধানের জন্য কুয়েট বান্ধব উপাচার্যের প্রয়োজন। 
কুয়েট শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. মোঃ ফারুক হোসেন বলেন, বর্তমানে কোন উপাচার্য না থাকায় আমরা অভিভাবক শূন্য। এই অচলাবস্থা নিরসনের জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই, যত দ্রুত সম্ভব একজন কুয়েট বান্ধব উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হোক। যিনি  কুয়েটের বিধিবিধান মেনে ‘ল’ এ্যান্ড অর্ডার’ নিশ্চিত  করবেন। এ রকম একজন উপাচার্য আসলেই সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে সেই এবং আমরা ক্লাসে ফিরতে পারবো। 
তিনি বলেন, আগের উপাচার্যের বিষয়টা ছিল অন্যরকম। সেখানে ছাত্রদের এক ধরনের দাবিদাবা ছিল, প্রশাসন সেটা পারছে কি পারছে না এটা নিয়ে একটা অনাস্থা তারা জানিয়েছিল। একটা পর্যায়ে সরকার উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যকে  অব্যাহতি দিয়েছিল। যে কারণগুলোর কারণে একজন উপাচার্যের অব্যাহতির চাওয়া হয়েছিল সে কারণগুলো যুক্তিসঙ্গত কিনা শিক্ষক সমিতির বরাবর একটি বক্তব্য ছিল। বিষয়টি সরকারের ইখতিয়ারভুক্ত ছিল এবং সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।  পরবর্তীতে যিনি এসেছিলেন, তিনি আসার সাথে সাথেই তাকে চাপ দেয়া হয়েছিল আপনি আমাদের কথা শুনলে আমাদের উপাচার্য আর না শুনলে আমাদের উপাচার্য থাকবেন না।  অনেকটা আগের উপাচার্যকে যেমনটি বলা হয়েছিল সে রকম। পরবর্তীতে উপাচার্য আসার পর তিনি কাজও শুরু করেছিলেন এবং আমরা তাকে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা দিয়ে কাজ করছিলাম। কিন্তু উনি কোন একটা পর্যায়ে হঠাৎ করে থেমে গেলেন। তিনি আর আগাতে পারবেন না। বিভিন্ন বিষয় তিনি ফেস করেছেন, যার কারণে তিনি আর এগিয়ে যেতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম নীতিকে সুরক্ষা দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে এটা আমাদের দাবি ছিল। 
তিনি আরো বলেন, এসব ঘটনায় কুয়েটের সুনাম ক্ষুণœ  হয়েছে। এখানে আমরা যারা আছি এবং সাধারণ শিক্ষার্থী তাদের অধিকাংশই কোন ভূমিকা ছিল না। এটাই বাস্তবতা। স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসলে আমাদের শিক্ষকদের চেষ্টা থাকবে  যত দ্রুত এই সংকট কাটিয়ে ওঠা যায় এবং যে ক্ষতি হয়েছে এটা যতটুকু রিকভারি করা যায়।  
তবে আমরা দেখেছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন মহল বিভিন্ন গোষ্ঠী মন্তব্য করছে এবং  তারা বিবৃতি দিচ্ছে। এটাতে বোঝাই যায় এটা শুধু আমাদের কুয়েটের ছাত্র শিক্ষকদের বিষয় ছিল না। আমাদের যে অবজারভেশন, কুয়েট অনেক সুনাম নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। শান্তশিষ্ট একটা পরিবেশ। সেখানে হঠাৎ করে এরকম একটি পরিবেশ তৈরি করা, সেটা শুধু আমাদের অল্প কয়েকজন ছাত্রদের দিয়ে হয়নি। আমার ধারণা আমাদের ছাত্ররা সেটা বুঝতে পেরেছে। যে জিনিসগুলো আমাদের প্রাপ্য ছিল না সেই জিনিসগুলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ঘটে গেছে। যে যে জিনিসগুলো কুয়েটের ঐতিহ্যের সাথে যায় না সেগুলো ঘটে গেছে। এখনো শিক্ষকরা সেই জায়গাতেই আছে। আমাদের যে ঐতিহ্য যে সুনাম  সেটাকে ধরে রাখতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ম শৃঙ্খলা থাকতে হবে এবং প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটিই প্রতিষ্ঠা করলেই একাডেমিক ক্লাসে যাওয়ার মত নিশ্চয়তা পাবে সবাই এবং সাথে সাথে ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।

্রিন্ট

আরও সংবদ