খুলনা | বুধবার | ২৮ মে ২০২৫ | ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

‘৫ আগস্ট বাথরুমে পাঁচ ঘণ্টা লুকিয়ে ছিলাম’

দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে ‘জুলাই বিপ্লব’ নিয়ে মুখ খুললেন ওবায়দুল কাদের, দায় চাপালেন নিঝুম মজুমদারের ওপর!

খবর প্রতিবেদন |
০১:৫৬ এ.এম | ২৭ মে ২০২৫


দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে আলোচিত ‘জুলাই বিপ্লব’ নিয়ে মুখ খুললেন নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দিন আতঙ্কে পাঁচ ঘণ্টা বাথরুমে লুকিয়ে ছিলেন বলে জানিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।  ভারতের সংবাদ মাধ্যম দ্য ওয়াল’র এক্সিকিউটিভ এডিটর অমল সরকারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য জানিয়েছেন তিনি। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এই প্রথম গণমাধ্যমে কথা বলেন দলটির তিনবারের সাধারণ সম্পাদক। ৫ আগস্টের সেই উত্তাল দিনটির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি জানান, ছাত্র-জনতার সেই অভ্যুত্থানের সময় তিনি প্রাণে বেঁচেছিলেন ‘সৌভাগ্যক্রমে’। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা তিনি এবং তার স্ত্রী একটি বাথরুমে লুকিয়ে ছিলেন বলেও জানান তিনি।
কাদের বলেন, সেদিন তার নিজ এলাকায় থাকা নিজের বাসায় না থেকে পাশের একটি বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বাসাতেও হামলা হয়। ভাঙচুর আর লুটপাটের মধ্যে হঠাৎই পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। ‘আমরা বাথরুমে লুকিয়ে ছিলাম। আমার স্ত্রী মুখে বলছিলেন আমি অসুস্থ। এরপরও ওরা ঢুকতে চাচ্ছিল। একপর্যায়ে বললাম, দরজা খুলে দাও‘, বলেন কাদের।
বাথরুমে ঢোকা ছেলে গুলোর আচরণ প্রথমে উত্তেজনাপূর্ণ হলেও, হঠাৎই তাদের মধ্যে আচরণ বদলে যায়। কেউ কেউ কাদেরের সঙ্গে সেলফি তুলতে শুরু করে। আবার কেউ তাকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার কথাও বলেছিল। শেষ পর্যন্ত তাদেরই কয়েকজন তাকে ও তার স্ত্রীকে একটি অটোতে তুলে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যায়। ‘ওরা বলছিল চাচা-চাচি অসুস্থ, হাসপাতালে নিচ্ছি। এর ফলে বিভিন্ন চেকপোস্ট পার হয়ে যেতে পেরেছি’, জানান তিনি।
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে কাদের বলেন, আমি খুবই ভাগ্যবান। সেদিন হয়তো আমার বেঁচে থাকারই কথা ছিল না। আমার নিজের বাসা ছেড়ে পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিই। চারদিক থেকে মিছিল আসছিল। হঠাৎ করে তা সংসদ এলাকা ঘিরে ফেলে। শুরু হয় লুটপাট।
তিনি বলেন, যে বাসায় ছিলাম, সেখানেও হামলা হয়। তারা জানতো না আমি সেখানে আছি। আমি স্ত্রীসহ বাথরুমে লুকাই। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা বাথরুমে অবস্থান করি। একসময় তারা বাথরুমে ঢুকতে চায়। আমার স্ত্রী বারবার বলেন আমি অসুস্থ। পরে বাধ্য হয়ে দরজা খুলে দিই। ‘তখন কয়েকজন ছেলে ঢোকে, মুখে মাস্ক, হাতে লাল পতাকার ব্যাজ। প্রথমে তারা উত্তেজিত ছিল, কিন্তু আমাকে দেখে আচমকা আচরণ বদলে যায়। তারা সেলফি তোলে, ছবি তোলে। কেউ কেউ বলেছিল সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিতে। আবার কেউ জনতার হাতে।’
ওবায়দুল কাদের জানান, পরে তারা তাকে একজন সাধারণ রোগীর মতো পরিচয় দিয়ে একটি ইজিবাইকে করে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেয়। ওরা বলছিল চাচা-চাচি অসুস্থ, হাসপাতালে নিচ্ছি। ভাগ্য ভালো ছিল বলেই বেঁচে গেছি।
এই অভ্যুত্থানের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কাদের বলেন, এটা কোনো রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ছিল না বরং ‘লুটপাটের লুম্পেন কায়দায় সংঘটিত’ ঘটনা ছিল। তিনি বলেন, ‘এটা ছাত্রদের আন্দোলনের ছদ্মাবরণে একটি ষড়যন্ত্রমূলক বিস্ফোরণ ছিল।’
নিঝুম মজুমদারকে দায় দিলেন কাদের : এক প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের দাবি তিনি কখনো ছাত্রলীগকে আন্দোলন দমনে নামাতে বলেননি। এই বিষয়ে ইউটিউবে যে ভিডিও ছড়িয়েছে, তা ছিল লন্ডন প্রবাসী ব্যারিস্টার নিঝুম মজুমদারের প্রচারিত একটি পুরনো ভিডিও’র ওপর ভিত্তি করে। সেখানে ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। ‘আমি ছাত্রলীগকে নামাতে বলেছি এই কথাটা যে বলেছে, সে ভিডিওটা এডিট করে বলেছে। ছাত্রলীগের নামই ছিল না। ও (নিঝুম) নিজে ইউটিউবে এটা ছড়িয়েছে’, বলেন কাদের।
কাদের জানান, ঘটনার পর তিনি প্রায় তিন মাস দেশেই ছিলেন। তখন তিনি বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলন ও অসন্তোষ পর্যবেক্ষণ করছিলেন। পরে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে গেলে এবং একাধিক মামলায় আসামি হয়ে পড়লে, স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে দেশত্যাগ করেন। ‘আমি বাইপাস সার্জারির রোগী। ধরা পড়লে ওষুধ খাওয়াবে কে? তাই সিদ্ধান্ত নিই বেরিয়ে যাওয়ার’, বলেন তিনি।
তিনি স্মরণ করেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরও তিনি কলকাতায় ছিলেন ৯ মাস। এরপর একাধিকবার ভারতে গেছেন, তবে মূলত রাজনৈতিক দায়িত্বের সূত্রে।
ভুল স্বীকার? দায় নিলেন আংশিক : আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পেছনে জনপ্রিয় অসন্তোষ ও দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভের কথা অনেকেই বললেও, কাদের তা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, কোটা আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে এটি ষড়যন্ত্রের রূপ নেয়। এটি ছিল একটি গোয়েন্দা ব্যর্থতা।
জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে দায় নিচ্ছেন কি না জানতে চাইলে কাদের বলেন, ‘আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। ভুল থাকতে পারে। তবে চাঁদাবাজি করিনি, কমিশন নেইনি, দল গঠনে টাকার বিনিময়ে পদ দিইনি। এ বিষয়ে আমি নির্দোষ।’
দীর্ঘ সময় তাকে প্রকাশ্যে দেখা না যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাকে অনেকেই বলে চুপ থাকতে বলা হয়েছিল। এটা যারা বলে, তারা বলতে পছন্দ করে। কিন্তু আমি অসুস্থ ছিলাম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিজেই খোঁজ নিয়েছেন।’ শেষ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা দেশকে যা দিয়েছি, তা তুলনার বাইরে। সময় হলে দেশের মাটিতে সব কিছুরই মূল্যায়ন হবে।’
ছাত্রলীগকে উত্থান দমন করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন কি না-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি কখনও বলিনি ছাত্রলীগ এই অভ্যুত্থান দমন করুক। ইউটিউবে কেউ একজন বলেছে, সেটা সত্য নয়। তিনি বলেন, আমি তখন পার্টির সেক্রেটারি ছিলাম। দায়িত্ব পালন করেছি। পার্টি অফিস, মেট্রোরেল, বিটিভি ভবন পুড়ছিল। আমি কি নিজেকে নিরাপদ রাখবো না? আমার নেত্রীকে নিরাপদ রাখতে হবে না? কেউ থাকলেও সেটাই করতো।
তৎকালীন পরিস্থিতিতে জনরোষের কারণ কী ছিল জানতে চাইলে কাদের বলেন, এটা আকস্মিক ঘটনা। কোটা আন্দোলন থেকে শুরু, এক দফায় শেষ। ষড়যন্ত্রও ছিল। ইন্টেলিজেন্স ব্যর্থ হয়েছে।
একটি বড় রাজনৈতিক দলে দীর্ঘদিন সাধারণ সম্পাদক থাকা সত্তে¡ও জনগণের ক্ষোভ আগে বোঝা যায়নি কেন? জবাবে তিনি বলেন, মানুষ ভুল করে। আমিও ভুল করেছি হতে পারে। তবে আমি চাঁদাবাজি করিনি, কমিশন খাইনি। আমার মন্ত্রণালয় সবার সামনে। আমি কোনো পদ বিক্রি করিনি।
দলীয় শাসনামলে নির্বাচন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সমালোচনা হবে। তবে আমাদের উন্নয়ন কারও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আমরা এই দেশকে বদলে দিয়েছি। সময় হলে মূল্যায়নও হবে।
অনেক দিন নীরব ছিলেন কেন এই প্রশ্নে কাদের বলেন, অনেকে বলে আমাকে চুপ থাকতে বলা হয়েছিল। এটা ঠিক নয়। আমি অসুস্থ ছিলাম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) নিজেই আমাকে খুঁজেছেন, আমার খোঁজ নিয়েছেন।
দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, দলে প্রতিদ্ব›িদ্বতা ছিল, আছে। তিনবার সাধারণ সম্পাদক হওয়াটা অনেকের পছন্দ না হওয়াও স্বাভাবিক। ‘এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও তাই ঘটে,’ বলেন কাদের।
তিনি বলেন, ৫ আগস্টের সেই দিনটা আমার জীবনে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। তবে আমি ভাগ্যবান ছিলাম-বেঁচে ফিরতে পেরেছি। এটাই সবচেয়ে বড় বিষয়।

্রিন্ট

আরও সংবদ