খুলনা | সোমবার | ০৯ জুন ২০২৫ | ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সেনাবাহিনীর অভিযানে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদসহ গ্রেফতার ৪

নিজস্ব প্রতিবেদক ও কুষ্টিয়া প্রতিনিধি |
০৩:৪২ পি.এম | ২৭ মে ২০২৫


কুষ্টিয়া শহরের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে শীর্ষ তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী মোল্লা মাসুদ ওরফে আবু রাসেল মাসুদকে গ্রেফতার করেছে সেনাবাহিনী। গতকাল মঙ্গলবার আনুমানিক ভোর ৫টায় কালীশংকরপুর এলাকার সোনার বাংলা মসজিদ-সংলগ্ন একটি বাসায় তিন ঘণ্টার এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে সহযোগীসহ তাকে আটক করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।
আইএসপিআর প্রেরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় এসময় তাদের নিকট হতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা হতে সুব্রত বাইন এর অপর দুই সহযোগী শ্যুটার আরাফাত এবং শরীফকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযানকালে ৫টি বিদেশী পিস্তল, ১০টি ম্যাগজিন, ৫৩ রাউন্ড এ্যামোনিশন এবং ১টি স্যাটেলাইট ফোন উদ্ধার করা হয়।
আইএসপিআর প্রেরিত বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, গ্রেফতারকৃত নামে বিভিন্ন থানায় হত্যা ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন নাশকতামূলক কার্যক্রম সংক্রান্ত মামলা রয়েছে। উলে­খ্য যে, সুব্রত বাইন এবং মোল­া মাসুদ সেভেন স্টার সন্ত্রাসী দলের নেতা এবং “তালিকাভূক্ত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের’” অন্যতম। সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল সকালে অভিযানটি পরিচালনা করা হয়। অভিযান দলের দক্ষতায় কোনরূপ ক্ষয়ক্ষতি এবং নাশকতা ছাড়াই অভিযানটি সম্পন্ন হয় এবং অপরাধীদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়। উক্ত সফল অভিযান বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ফরমেশন, দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং বাংলাদেশ পুলিশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। 
সেনাবাহিনী জননিরাপত্তা নিশ্চিত করণ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। যেকোন ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম এর তথ্য নিকটস্থ সেনা ক্যাম্প অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করার জন্য সর্বসাধারণকে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী তিনি বলেন, “দেশের ভেতর আইনশৃঙ্খলা বিঘœ ও অস্থিশীল করার জন্য তারা সন্তাসী কমকাণ্ড পরিচালনা করে আসছিল। সেনাবাহিনীর একাধিক ইউনিট গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের সহযোগিতায় দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়।”
তিনি আরো বলেন, “এই চক্রটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হত্যা, চাঁদাবাজি ও নাশকতা চালিয়ে আসছিল। উলে­খযোগ্য ভাবে, সুব্রত বাইন এবং মোল্লা মাসুদ হল ‘তালিকাভুক্ত ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী’ দলের অন্যতম নেতা এবং ‘সেভেন স্টার’ চক্রের মূল পরিকল্পনাকারী। এই অভিযান ছিল দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা তৎপরতা ও পরিকল্পনার ফসল। অপারেশনটি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে, ক্ষয়ক্ষতি বা সংঘর্ষ ছাড়াই পরিচালিত হয়-যা আমাদের বাহিনীর পেশাদারিত্ব এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।”
এদিকে মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) ফয়সাল মাহমুদ, কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশাররফ হোসেনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তা ও সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা ওই ভবনের ভাড়াটিয়া ও আশপাশের স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন।
এ বিষয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, আজ (গতকাল মঙ্গলবার) আমাদের কোনো অভিযান ছিল না। হয়তো অন্য কোনো বাহিনী করেছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনসহ দু’জনকে আটকের বিষয়টি শুনেছি। তবে এখন পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি কে বা কারা, কাকে আটক করেছে। তবে খবর শুনে আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এখনই নিশ্চিত করে কোনো কিছু বলতে পারছি না আমরা।
কালীশংকরপুর এলাকার ওই বাসার ভাড়াটিয়া সানজিদুর ও ইভান বলেন, তিনতলা বিশিষ্ট এই ভবনের নিচতলা ফাঁকা ছিল। প্রায় দেড় মাস আগে আমাদের এই বিল্ডিংয়ের পেছনের বাসার মালিকের ছেলে বাসাটি ভাড়া নিয়ে তাদের উঠান। যে দু’জন এই বসাতে থাকতেন তারা খুব বেশি চলাফেরা করতেন না। তাদের সঙ্গে আমাদের মেলামেশা ও পরিচয় ছিল না। তবে পাশের ভবনের মালিক তার আত্মীয় পরিচয় দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, তারা ব্যাবসা করবে এবং এখানে থাকবে। এরপর থেকেই তারা দু’জন এখানে থাকতেন।
গতকালকে কী ঘটনা ঘটেছিল, এ প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, ভোর ৫টা থেকে ৮টা পর্যন্ত সেনাবাহিনীর একটি টিম অভিযান চালিয়ে দু’জনকে আটক করে নিয়ে যায়। দরজা ভেঙে তারা ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় তারা পাশের ভবনের মালিকের ছেলের সঙ্গেও কথা বলেন। আমরা জানতে পেরেছি, সুব্রত বাইন নামে একজনকে সহযোগীসহ আটক করা হয়েছে। সুব্রত বাইনের চেহারার সঙ্গে মিলও খুঁজে পেয়েছি আমরা। অভিযানে অংশ নেওয়া কয়েকজন আমাদেরকে তার নামও বলেছিলেন।
ভাড়াটিয়া ও স্থানীয় কয়েকজন বলেন, মঙ্গলবার ভোরে ৩ ঘণ্টা ধরে সেখানে অভিযান চালিয়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এলাকায় অধিকাংশ বাড়িতে মেস ভাড়া দেওয়া হয়। যে বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছে, সেটির সামনে পৌরসভার সাইনবোর্ডে বাড়ির মালিকের নাম লেখা মীর মহিউদ্দিন। তিনতলা বাড়ির দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার মেসে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ১৮ জন ছাত্র থাকেন।
কালীশংকরপুর এলাকার ওই বাসার ভাড়াটিয়া শাহীন বলেন, নিচতলায় এই বাড়ির পেছনের বাড়ির এক স্থানীয় বাসিন্দা দুই মাস আগে ভাড়া নেন। দেড় মাস আগে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে এ বাসায় তাদের উঠান। নিচতলায় কী হয় বা কারা থাকেন, তা কখনো দেখেনি আমরা। তবে একজনকে কয়েকদিন দেখেছি, কাপড় রোদে দিচ্ছেন এবং বাইরে থেকে খাবার আনছেন। তার সঙ্গে সুব্রত বাইনের চেহারার মিল রয়েছে। অভিযানে অংশ নেওয়া কয়েকজন বলেছেন, তিনিই সুব্রত বাইন।
তিনি আরও বলেন, আজ (গতকাল মঙ্গলবার) ভোর ৫টার দিকে বাড়ির সামনে সেনাবাহিনীর ৫ থেকে ৬টি গাড়ি আসে। গাড়ির বহরে একটি কালো মাইক্রোবাসও ছিল। প্রায় ৫০ জন সেনাসদস্য বাড়ির তালা খুলতে বলেন। তালা খোলার পর তারা দোতলা ও তিনতলায় ওঠেন। এরপর মেসের সব বাসিন্দাদের একটি কক্ষে রাখেন। এ সময় তারা মেসের ছাত্রদের বলেন, ‘ তোমাদের কোনো ভয় বা সমস্যা নাই। তোমরা বসে থাকো। এখানে অভিযান চলছে।’ সেনা কর্মকর্তা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেন বলে ছাত্ররা জানান।
মেসের শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে নিচতলায় তল­াশি চলে। ৮টার কিছু সময় পর কালো মাইক্রোবাসটি একদম গেটের সামনে চলে আসে। নিচতলা থেকে দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তিকে হাতকড়া পরা ও মাথায় গামছা বাঁধা অবস্থায় গাড়িতে তোলা হয়। আরেক যুবকের কোমরে ও শরীরে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল।
ছাত্রদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মেসের পেছনের বাড়িতে গিয়ে ভেতর থেকে দরজা আটকানো পাওয়া যায়। একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তাদের সাড়া মিলেনি।
সুব্রত বাইন বাংলাদেশের একজন কুখ্যাত অপরাধচক্রের নেতা। তাকে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তার বিরুদ্ধে ঢাকায় কমপক্ষে ৩০টি খুনের মামলা রয়েছে। ২০০৩ পর্যন্ত সুব্রত বাইন ছিলেন ঢাকার অপরাধ জগতের প্রভাবশালী চক্র সেভেন স্টার গ্র“পের প্রধান। ১৯৯১ সালে ঢাকার আগারগাঁও এলাকায় জাসদ ছাত্রলীগ নেতা মুরাদকে হত্যার মধ্য দিয়ে নামকরা সন্ত্রাসী হিসেবে সুব্রত বাইনের অভিষেক হয়। তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।
২০০১ সালে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় যে ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, সুব্রত বাইন তাদের অন্যতম। পুলিশের হাতে আটক হওয়া এড়াতে তিনি ২০০৩ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। পশিচমবঙ্গে তিনি ব্যবসাও গড়ে তোলেন। জমি কিনে সেখানে বাড়ি বানান।
 

্রিন্ট

আরও সংবদ