খুলনা | সোমবার | ০২ জুন ২০২৫ | ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সাতক্ষীরায় আম পাকাতে স্প্রে করা হচ্ছে ইথেফোন ঐতিহ্য হারাতে বসেছে সুস্বাদু হিমসাগর ও ল্যাংড়া

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা |
০২:২৯ এ.এম | ২৯ মে ২০২৫


সাতক্ষীরার সুস্বাদু গোবিন্দভোগ, গোপালভোগ, হিমসাগর, ল্যাংড়া ও আম্রপালি জাতের আমের কদর আছে দেশ বিদেশে। সাতক্ষীরায় উৎপাদিত আম শুধু বাংলাদেশের বাজারে নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু একটি অসাধু চক্র অধিক মুনাফা লাভের আশায় দ্রুত পাকানোর জন্য আমে ইথেফোন নামের একটি রাসায়নিক পদার্থ স্প্রে করে বাজারজাত করছে। ফলে সাতক্ষীরার সুস্বাদু আমের সুনাম নষ্ট হতে বসেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের প্রত্যক্ষ মদদে বাজারের আড়ৎদাররা সাতক্ষীরার আমের সুনাম নষ্টের এই হীন চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে।
সাতক্ষীরা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরা জেলায় ৪ হাজার ১৩৫ হেক্টর জমিতে প্রায় ৫ হাজার আম বাগান রয়েছে। চলতি বছর এখান থেকে ৬২ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে জেলা কৃষি বিভাগ। যার মধ্যে প্রায় ৫০০ মেট্রিক টন আম বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। যেখান থেকে আয় হবে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। 
সাতক্ষীরা জেলার সবচেয়ে বড় আমের আড়ৎ হচ্ছে সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুর বড় বাজার। আম বিক্রির মৌসুর শুরু হলে বাজারের দক্ষিণ পাশে মাঠে বসে আমের আড়ৎ। জেলা বাইরে থেকে পাইকররা এখানে এসে আম কিনে দেশের বিভিন্ন বাজারে পাঠায়। প্রতিদিন এখান থেকে প্রায় ১৫টি ট্রাকে ৬ হাজার ক্যারেটে এক লাখ কেজির বেশি আম জেলার বাইরে চলে যায়। কিন্তু এই আম ক্যারেটে ভরার আগে আড়তের মাটিতে বিছিয়ে ইথেফোন নামের একটি রাসায়নিক পদার্থ ¯েপ্র করা হয়। এতে করে অপরিপক্ব আমও  দ্রুত পেকে যায়। পরের দিন গন্তব্যে পৌঁছানোর পর প্রায় খাওয়ার উপযোগী হয়ে যায় এই আম। স্থানীয় বাজার কমিটির নেতৃবৃন্দ বিষয়টি জানলেও তারা না জানার ভ্যান করে থাকেন। 
বুধবার (২৮ মে) দুপুরে সাতক্ষীরার শহরেরর সুলতানসপুর বড় বাজারের জনৈক নাজমুলের আমের আড়তে গিয়ে দেখা গেছে একটি লোক মাটিতে বিছানো আমে ইথেফোন ¯েপ্র করছেন। এভাবে বাজারের পাশে মাঠে গড়ে উঠা অস্থায়ী আমের আড়তের প্রায় সব ঘরে খড় অথবা ত্রিপল বিছিয়ে তার উপর আম বসানো  রয়েছে। ¯েপ্র করার পর বিকালে ক্যারেট ভরে তা লোড করা হবে ট্রাকে। আমে ¯েপ্র করার জন্য আড়ৎদারদের নির্দিষ্ট খাজনা ছাড়াও গুণতে হয় অতিরিক্ত টাকা। এসব আম কিনে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন ক্রেতারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আড়তদার জানান, প্রতিটি আমের ক্যারেটে বাজার কমিটি, পুলিশ ও সাংবাদিকদের জন্য পৃথক ভাবে ১০ টাকা করে দিতে হয়। এছাড়া আড়ৎদারি ও কুলি বাবদ দিতে হয় আরো ২০ টাকা। এভাবে প্রতি ক্যারেট আমে তাদের ৭০ থেকে ৮০ টাকা খরচ হয়। যে কারণে আমে ইথেফোন ¯েপ্র করার বিষয়টি জানলেও কেউ কিছু বলে না। এভাবে প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার আমের ক্যারেট থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। 
এ বিষয়ে সাতক্ষীরার শহরের সুলতানপুর বড় বাজারের কাঁচা পাকা মাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রজব আলী জানান, সাতক্ষীরার এই বাজার থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ ট্রাকে ৬ হাজার ক্যারেটে প্রায় এক লাখ কেজি আম দেশের বিভিন্ন বাজারে চলে যায়। বাজারের কিছু কিছু আড়ৎদাররা চুরি করে আমে ¯েপ্র করে স্বীকার করে তিনি বলেন, আমরা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি তারপরও সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেকে এই কাজ করছে। আগামীকাল থেকে কেউ আর আমে ¯েপ্র করতে পারবে না বলে তিনি জানান। তবে আড়তদারদের কাছ থেকে আমের ক্যারেট প্রতি পুলিশ ও সাংবাদিকদের নামে ১০ টাকা করে আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। 
সাতক্ষীরার নাগরিক নেতা আলী নুর খান বাবুল জানান, প্রতি মৌসুমে দেশের গন্ডি পেরিয়ে ২০১৫ সাল থেকেই আমেরিকা ও ইউরোপে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে সাতক্ষীরার আম। যা জেলার অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তবে এভাবে আম পাকানোর জন্য রাসায়নিক দ্রব্য ইথেফোন ব্যবহার করা হলে একদিন সাতক্ষীরার আম তার ঐতিহ্য হারাবে। একটি কুচক্রি মহল পরিকল্পিতভাবে সাতক্ষীরার আমের সুনাম নষ্ট করার জন্য এ ধরনের হীন কাজ করছে। তিনি এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। 
ইথেফোন জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পাকানো ফলে স্বাদে পরিবর্তন আসতে পারে জানিয়ে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাঃ মনোয়ার হোসেন বলেন, স্বাভাবিকভাবে পাকানো আমের যে স্বাদ বা গন্ধ বা অন্যান্য গুণাবলী থাকে, রাসায়নিক ব্যবহার করে পাকানো ফলের গুণাবলী সেই একই মানের হবে না। এছাড়া ইথেফোন, বিশেষ করে উচ্চ ঘনত্বে, মানুষের জন্য বিষাক্ত হতে পারে এর সংস্পর্শে লালা, ডায়রিয়া, পেট ফাঁপা, এবং মাথা ঘোরার মতো ¯œায়বিক প্রভাবসহ বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে। 
সাতক্ষীরা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরার গোবিন্দভোগ, গোপালভোগ, হিমসাগর, ল্যাংড়া ও আম্রপালি জাতের আমের কদর আছে দেশ বিদেশে। ২০১৫ সাল থেকে সাতক্ষীরার আম ইউরোপে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে, যা জেলার অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তবে কোন ক্যামিকেল ব্যবহার করলে আমের গুনাগুণ নষ্ট হয়ে যাবে। জেলা প্রশাসক মহাদয়ের সাথে আলাপ করে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে জানার জন্য সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ এর সরকারি মোবাইলে একাধিকবার রিং করলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

্রিন্ট

আরও সংবদ