খুলনা | রবিবার | ০১ জুন ২০২৫ | ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং একজন শহিদ জিয়া

এড এম মাফতুন আহমেদ |
০২:০২ এ.এম | ৩০ মে ২০২৫


কোন আধিপত্যবাদী শক্তি বা তাদের দোসরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে নিয়ে আর কোন ছিনিমিনি খেলতে না পারে এ উপলব্ধি সর্বপ্রথম করে ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের নায়ক, প্রবাদ প্রতীম দূরদর্শি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সাফল রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান। তিনি বলেছিলেন-‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ দুর্বল হলে আপনারা ধ্বংস  হয়ে যাবেন’। 
তিনি ছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ঝংকার। এক কথায় রূপকার। একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে, জাতির সাহসী সন্তান হিসেবে সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, ভৌগলিক পারিপার্শ্বিকতায় ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ একটি অচল এবং অসার রাজনৈতিক মতবাদ। একটি স্বাধীন জাতির জাতীয়তার পরিচয়ে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। শুধু রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে এই জাতীয়তাবাদ বাধা গ্রস্ত করছে না। ভবিষ্যৎ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। 
এসব বুঝে দেশপ্রেমিক জিয়া ১৯৭৭ সালে জাতীয়তা পরিবর্তনে আনেন ব্যাপক এক পরিবর্তন। ঐ উদ্যোগের ফলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নতুন সংবিধানের ৬নং ধারার (২) উপধারায় বলা হয়-“বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচয় হইবেন”। 
এভাবে স্বাধীনতা প্রাপ্তির তিন বছর পর, এই প্রথম ত্রিশটি বাঙালি উপজাতি তাঁরা বাংলাদেশের মানুষ বলে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। সেই সাথে সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইল এলাকার জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলে একটি রাষ্ট্রীয় পরিচয় লাভ করে। একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃত লাভ করে। ইতিহাসের গতিধারায় শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা ছিল তার জীবনের এক আলেখ্য ঘটনা।
এ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ড জিয়াউর রহমান ৪ নভেম্বর ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কেন্দ্রীয় আহবায়ক কমিটির এক সভায় বলেছিলেন-“বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অর্থ হচ্ছে আমরা বাংলাদেশী। আমাদের পৃথক ইতিহাস রয়েছে। আমাদের দেশ এক ভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করেছে। আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পৃথক। আমাদের ভাষা পৃথক। আমরা তাকে নিজের মত করে গড়ে তুলছি। আমরা তাকে আধুনিক করছি। আমাদের পৃথক সাহিত্য ও কবিতা রয়েছে। আমাদের পৃথক শিল্প ও চিন্তাধারা রয়েছে। আমাদের  ভৌগলিক অবস্থান পৃথক। আমাদের নদী ও ভূমি পৃথক। আমাদের জনগণ পৃথক। আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম। আজ আমাদের জনগনের মধ্যে এক চেতনা গড়ে উঠেছে। যে চেতনা আমাদের প্রতিবেশী দেশ ও এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের জনগনের থেকে ভিন্ন’। 
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আরও বলেনঃ-“আমরা ধর্মে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ভাষায় এবং সংস্কৃতির বৃহত্তর সংজ্ঞায় বাঙালি। (পাহাড়ের ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষা উলে­খ্য) কিন্তু ইতিহাস, ভুগোল, ভাষা যুদ্ধ, অর্থনীতি,ভাষায় কী জাতিত্বের সজ্ঞা দেয়া চলবে? এ জন্য ভাষায় বাঙালি এবং ধর্মে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান হলেও আমরা জাতিত্বের সমগ্র সজ্ঞায় ‘বাংলাদেশী’ পরিচয় দেব মাথা উঁচু করে,স্বগর্বে”। 
ইস্পাত কঠিন গণ ঐক্য না হলে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক শান্তিপূর্ণ বিপ্লব সফল হবে না। দেশের মানুষ স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে পারবে না। ঐ ধারনার ভিত্তিতে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন সেদিন দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
জিয়াউর রহমান বললেন, বাংলাদেশ আমাদের সবার জন্য প্রথম এবং শেষ আশ্রয়। ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’ এই সীমানায় আমার শেষ কথা। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা আমার শেষ ঠিকানা। এই ভাবনার জন্ম দিতে পারে, লালন করতে পারে, চূড়ান্ত দেশপ্রেমে জাতীয়তাবাদী চেতনার উচ্ছ¡সিত একটি রাজনৈতিক দর্শন ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’।
আসলে নজরুল-জসিম উদ্দিনের পূণ্যস্মৃতি ভূমি এই বাংলাদেশকে শহিদ জিয়া চিনে ছিলেন অন্তরর অন্তঃস্থল থেকে। এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহিদ সোহরাওয়ার্দী, রবীন্দ্রনাথ, তিতুমীর, সূর্যসেন, প্রীতিলতার ভূমিকাকে সম্মান করেছেন সমান ভাবে। 
তিনি বলেছিলেন,-“জাতীয়তাবাদ কোন প্রতিক্রিয়াশীল শব্দ নয়। বরং বিশ্ব মানচিত্রে জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও জাতীয় ঐক্য নির্ভর করছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ওপর”। 
এখন যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলেন, তাদের কাছে প্রশ্ন, যদি আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলি, তাহলে দেশের বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন উপজাতির মূল্যায়ন হবে কি করে? জাতীয় উন্নয়নে তারা শরীক হবে কী ভাবে? এক কথায় বাঙালি বলে তাদেরকে স্বাভাবিক ভাবেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। জাতীয় একটি অংশকে দূরে রেখে জাতীয় উন্নয়ন কী সম্ভব হবে? মোটেই না। একমাত্র বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করা সহজতর হবে।
জাতীয়তাবাদের আরো একটি সংক্ষিপ্ত উদাহরণ দিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব, সাবেক প্রেসিডেন্ট ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তিনি বলেছেন,-“যারা ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা বলেন, তারা একটি ফুলের কথা বলেন মাত্র। আর যারা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা বলেন, তারা একটি সাজানো মালার কথা বলেন। যেমন একটি রাষ্ট্র একটি বাড়ি নিয়ে হয় না। একটি বাড়ির পরিচয় হয় একটি রান্না ঘর, শোবার ঘর, বসার ঘর নিয়ে। তেমনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একটি শব্দের বা একটি ঘরের মতো নয় বরং ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক কাঠামো, ভৌগলিক রূপরেখা সর্বোপরি স্বাধীনতা যুদ্ধ এর সমন্বয়েই হবে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” ।
আমাদের জাতীয়তাকে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ বলাই যুক্তি সঙ্গত। কারণ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। ধর্ম-গোত্র নির্বিশেষে ৫৫,৫৯৮ বর্গমাইল এলাকাই আমাদের আবাস স্থল। যাদের রয়েছে গৌরবময় আত্ম  পরিচয়, ঐতিহ্য-ইতিহাস, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, স্থাপত্য সর্বোপরি, ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন ও ‘৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস, যাদের কাছে নিজস্ব জীবনবোধ, জীবনধারা, মনস্তাত্তি¡ক গড়ন-গঠন, ভাবধারা, সমষ্টিগত বিশেষ মনোভঙ্গি, আবেগ-আকাক্সক্ষা ও হৃদয়নুভূতির বন্ধন। 
এই রাষ্ট্রীয় সীমায় ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে বসবাসকারী জনগণের হৃদয়তন্ত্রীতে বাজে একই সুখ-দুঃখের সুর, একই আবেগ ও অনুভুতির ঝংকার। এদের জীবনে ও মনোজগতে রয়েছে অসংখ্য বৈশিষ্ট্য, যা সারা বিশ্ব থেকে এদের স্বাতন্ত্র দান করেছে । এমনকি অন্যান্য দেশের বা অঞ্চলের বাংলা ভাষা-ভাষী ও ইসলাম অনুসারীদের থেকেও। উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য গুলোই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উপাদান। এর নির্যাসই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল শক্তি, ভিত্তি ও বুনিয়াদ।  
লেখক : কলামিষ্ট, সম্পাদক আজাদবার্তা।

্রিন্ট

আরও সংবদ

অন্যান্য

প্রায় ৫ মাস আগে