খুলনা | সোমবার | ০২ জুন ২০২৫ | ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

দক্ষিণাঞ্চলের ধর্ম প্রচারক কপিলমুনির জাগ্রত পীর হযরত জাফর আউলিয়া (রহঃ)

পারভেজ মোহাম্মদ |
০২:১১ এ.এম | ৩০ মে ২০২৫


আজ থেকে কয়েকশ’ বছর আগে সাধক পীর জাফর আউলিয়া (রহঃ) কপিলমুনিতে ধর্ম প্রচারের জন্য আসেন। তখন এ অঞ্চল ছিল বনজঙ্গলে ভরা, সুন্দরবনের একটি অংশ বলা চলে। এই নির্জন স্থানেই সাধনার জন্য আশ্রম গড়ে তোলেন পীর জাফর আউলিয়া। তিনি হযরত খাজা খানজাহান আলী (রহঃ)-এর শিষ্য ছিলেন। তবে সঠিক কোন সময় তিনি কপিলমুনিতে আসেন এর সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। সে সময় বেত বনে ঘেরা কপিলমুনিতে যে সাধনা আশ্রম গড়ে তোলেন তার স্মৃতিচিহ্ন এখনো রয়েছে। তার অসংখ্য শিষ্য ও ভক্ত ছিল। আর সাধনা আশ্রমেই তার মৃত্যু হয় বলে জানা যায়। সেখানে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
স্থানীয়রা জানান, প্রথমত তাঁর সমাধিস্থল মারাত্মক ভাবে অবহেলিত ছিল। কপিলমুনির হযরত জাফর আউলিয়া’র মাজার উত্তরে হাসপাতাল, পশ্চিমে কপিলমুনি বাজার, পূর্বে জাফর আউলিয়া মাদ্রাসা, দক্ষিণ-উত্তর কোণে কপিলেশ্বরী কালী বাড়ি, আর এই সীমানার মধ্যেই অবস্থিত পীর জাফর আউলিয়া (রহঃ) এর মাজার।  খুলনা জেলা সদর থেকে ৫০ কিঃ মিঃ দূরে কপিলমুনিতে জাফর আউলিয়া মাজারের অবস্থান। এক প্রকার অনেকটা যেন অবহেলার শিকার দক্ষিণ বঙ্গের অন্যতম এ পীরের মাজারটি। তাঁকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য কীর্তিগাঁথা। আর মাজার ও পীরকে ঘিরে রয়েছে অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য।
স্থানীয়রা জানান, প্রথমত তাঁর সমাধিস্থল মারাত্মক ভাবে অবহেলিত ছিল। ১৯৬৯ সালের দিকে জাতীয় সংসদের সাবেক স্পীকার প্রয়াত শেখ রাজ্জাক আলী তৎকালীন প্রায় ৮শ’ টাকা খরচ করে তার নাতি জামাতা শেখ নেছার আলীর তত্ত¡াবধানে মাজারটি সংস্কার করান। তারপর ৩ দফায় সরকারি ও ব্যক্তিগত অর্থায়নে তিনি দর্শনীয় একটি মাজারে রূপ দেন। ১৯৫৮ সালে তাঁর নামানুসারে এলাকার কিছু প্রগতিশীল মানুষের প্রচেষ্টায় জাফর আউলিয়া ডিগ্রি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয়। সাবেক স্পীকার প্রয়াত শেখ রাজ্জাক আলী নিজস্ব হতবিল থেকে ১০ লক্ষ টাকা খরচ করে মাজার প্রাঙ্গনে জাফর আউলিয়া জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রতিদিন পীরজাফর আউলিয়ার মাজারে আসে অসংখ্য ভক্ত। সা¤প্রদায়িক বিভেদ ভুলে হিন্দু-মুসলিমসহ সব ধর্মের মানুষ মানত ও শিরনি নিয়ে আসেন করুণা প্রত্যাশার আশায়। তাছাড়া চৈত্র মাসে কপিলমুনি কপোতাক্ষ নদে বারুনি স্নান উপলক্ষে মাসব্যাপী মাজারের চার পাশে বসতো রকমারি দোকান নিয়ে মেলা। কপিলমুনি-কাঠামারী সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামানুসারে ‘জাফর আউলিয়া সড়ক’। পীরজাফর আউলিয়াকে (রহঃ) ঘিরে রয়েছে অনেক অলৌকিক কাহিনী।
জানা যায়, একদিন তিনি তাঁর অন্যতম শিষ্য ছালাওয়ালা ফকিরসহ দুর্গম এলাকায় যান। সেখানে কিছুদিন অবস্থানকালে এক বৃদ্ধা তাকে পানের জন্য দুধ দিতেন। হঠাৎ বৃদ্ধার গাভীটি মারা যায়। এদিকে প্রতিদিনের মতো পীর সাহেবের শিষ্য ছালাওয়ালা বৃদ্ধার বাড়ি যান দুধ আনতে। তিনি বৃদ্ধার গরুর মৃত্যু খবর শুনে হতবাক হয়ে পড়েন। দুধ না হলে হুজুর কি খাবেন? তিনি বৃদ্ধার কাছ থেকে জেনে নেন মরা গাভীটির কোথায় ফেলা হয়েছে। এরপর ছালাওয়ালা ফকির মরা গাভীটি লেজ ধরে টেনে বলেন, এই গাভী ওঠ। অমনি জীবিত হয়ে ওঠে গাভীটি। আর ওই গাভীর দুধ এনে পান করান পীরকে। বিষয়টি আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে পীর কেবলা বিষয়টি অবগত হন। তিনি ছালাওয়ালাকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘তুই আমাকে মরা গরুর দুধ খাওয়াবি’। সঙ্গে সঙ্গে এহেন অপরাধে অন্য শিষ্যরা ছালাওয়ালাকে বস্তাবন্দি করে নদীতে ফেলে দেয়। পুরো এলাকায় কানাঘুষা শুরু হয়, পীর কেবলা তার এক শিষ্যকে বস্তাবন্দি করে নদীতে ডুবিয়ে মেরেছে’। হুজুরে অলৌকিক শক্তি বলে সম্ভবত তিনি চমক দেওয়ার জন্যই ওই এলাকা ত্যাগ করে কপিলমুনি ফিরে আসেন এবং শিষ্যদের নিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে তিনি স্থায়ী স্থান তৈরি করেন। তিনি ইসলাম প্রচার কর্মকান্ডের সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিক বলে মানুষের খেদমত শুরু করেন। নদীভাঙন, খালের বাঁধ, বনে বাঘের হাত থেকে রক্ষা পেতে তদবির দিতেন। এ ধরনের অসংখ্য অলৌকিক শক্তির কথা শোনা যায় এ জাগ্রত পীরজাফর আউলিয়া সম্পর্কে।
মাজারে আসা এক ভক্ত বলেন, ‘আমি অনেক দিন ধরে এই পীরের মাজারে আসি। এখান থেকে ধুলিমাটি নিয়ে যাই, প্রার্থনা করি, মনোবাসনা পূরণ হয়’।
মাজারটির খাদেম ইউনুস ফকির জানান ‘আমরা বংশ পরমপরায় সেই অতীত কাল থেকে মাজারের খাদেম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। বাজারে আসা ভক্তদের দানিও পণ্য তারা সেবা হিসেবে গ্রহণ করেন। প্রতিবছর পৌষ এবং বৈশাখ মাসে আশপাশের কয়েকটি থানার ভক্তবৃন্দের বাড়ি থেকে তারা খাদ্যশস্য  ফলফলালী, শাকসবজি এমনকি নগদ অর্থ উপহার হিসেবে পেয়ে থাকেন। মাজারের দেখভালের দায়িত্বে থাকা পাঁচটি ফকির পরিবার এই উপহার গ্রহণ করে থাকেন।
এলাকাবাসী বলছেন, নিঃসন্দেহে পীর জাফর আউলিয়ার মাজার খুলনা জেলার একটি ঐতিহাসিক স্থান। শুধু তাই নয়, পর্যটকদের জন্য হয়ে উঠতে পারে একটি দর্শনীয় স্থানও।

্রিন্ট

আরও সংবদ