খুলনা | শনিবার | ১৪ জুন ২০২৫ | ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ফেলে রাখা ১৮টি পিলারই আজ দাঁড়িয়েছে কাল হয়ে

পঁচিশ বছরের শেষ হয়নি তালার কপোতাক্ষ নদের উপর সেতুর নির্মাণ কাজ, জনভোগান্তি চরমে

জাহাঙ্গীর হাসান, তালা |
১১:২৬ পি.এম | ১৩ জুন ২০২৫


তালার কানাইদিয়া-কপিলমুনি সীমান্ত কপোতাক্ষ নদের ওপর ২৫ বছর আগে সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হলেও নানা জটিলতা ও কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে আজও শেষ হয়নি। এতে বিপাকে পড়েছে সাধারণ জনগণ। নদের এক পাড়ে সাতক্ষীরার তালা উপজেলা অন্য পাড়ে খুলনার পাইকগাছা উপজেলা, মাঝখানে কপোতাক্ষ নদ। 
জানা গেছে, দুই জেলার জনপদের সাধারণ মানুষের দীর্ঘ দিনের দাবির প্রেক্ষিতে ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কপোতাক্ষ নদের কানাইদিয়া কপিলমুনি সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু করে। সেতু নির্মাণের শুরুতেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নানা অনিয়মের পাশাপাশি পাউবো’র খাম খেয়ালিপনায় মাঝ পথে বন্ধ হয়ে যায় কানাইদিয়া কপিলমুনি সেতুর নির্মাণ কাজ। সেতু নির্মাণ বন্ধ হলেও নদের বুকে থেকে যায় ১৮ টি পরিত্যক্ত পিলার। এমন অবস্থায় কপোতাক্ষের বুকে ফেলে রাখা ব্রিজের ১৮টি অকেজো পিলারে জোয়ারের পলিমিশ্রিত পানি বাঁধাগ্রস্ত হয়ে মাত্র কয়েক বছরে নাব্যতা হ্রাস পেয়ে নদটি পরিণত হয় একটি মরা খালে। এরপর নদের প্রাণ ফেরাতে সরকার প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দে কপোতাক্ষ খনন করলেও ফেলে রাখা ১৮টি পিলারই যেন আজ কপোতাক্ষের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে সেতু নির্মাণ না হওয়ায় তালা উপজেলার জালালপুর ও খেশরা ইউনিয়নের ১৯টি গ্রামসহ বিস্তীর্ণ এলাকার হাজার হাজার মানুষ বাসের সাঁকো পার হয়েই আসে বিনোগঞ্জ (কপিলমুনি) কেন্দ্রীক ব্যবসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দৈনন্দিন নানা প্রয়োজনে। বিশেষ করে উৎপাদিত ও নিত্য প্রযোজনীয় পণ্য সরবরাহে প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পার হতে হয় সাঁকো দিয়ে।
তথ্য মতে, ব্রিটিশ শাসনামল থেকে সুন্দরবন উপক‚লীয় ঐতিহ্যবাহী কপিলমুনি-কাশিমনগর কেন্দ্রিক বাণিজ্যিক প্রসার ঘটাতে প্রায় ১ কি.মি. দূরত্বে কপিলমুনি ও কাশিমনগর হাটবাজার গড়ে ওঠে। নদীর প্রাণ থাকায় ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে ধারণ করে অল্পদিনেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হাট-বাজারগুলো ব্যাপক গুরুত্ব পায়। তবে নাব্য সংকটে একদিকে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে নৌপথ, অন্যদিকে অব্যাহত নাব্যতা সংকটে নদী তার স্বাভাবিক গতিপথ হারিয়ে পলি ভরাট হয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
এলাকাবাসী জানায়, কপোতাক্ষ নদের উপর সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা ব্রিটিশ শাসনামল থেকে পোষণ করছিল আধুনিক কপিলমুনির প্রতিষ্ঠাতা রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু। কপিলমুনি কানাইদিয়া সেতু সাতক্ষীরা সদর হয়ে কলিকাতা পর্যন্ত সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। সে সময় সেতু নির্মাণের জন্য কোলকাতা স্টেট ব্যাংকে পর্যাপ্ত টাকাও জমা রাখা হয়। কিন্তু সে সময় কিছু লোকের বিরোধিতা ও দেশ স্বাধীনের আগে তার ভারতে চলে যাওয়ায় কানাইদিয়া-কপিলমুনির সেতু নির্মাণ বাস্তবায়ন হয়নি।
তবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় দু’জনপদের সাধারণ মানুষের দীর্ঘ দিনের আন্দোলন সংগ্রামের এক পর্যায়ে ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু করে। ঐ সময় সেতুটি নির্মাণের দায়িত্ব পায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এন হক এসোসিয়েট। কার্যাদেশ পেয়ে প্রতিষ্ঠানটি ২০০০ সালের ১২ এপ্রিল এর কার্যক্রম শুরু করে ২০০৩ সালের ১২ নভেম্বর পর্যন্ত আংশিক কাজ করে। তবে ঠিকাদার আইএফআইসি ব্যাংক খুলনা শাখা হতে ১ কোটি ৬৭ লাখ ৭২২ টাকা উত্তোলন করে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়। ঐ সময় বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এক পর্যায়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নামে মামলাসহ নানা জটিলতা ও দীর্ঘ সূত্রতার কারণে সেতু নির্মাণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
তবে সেতু নির্মাণ বন্ধ হলে নদের বুকে থেকে যায় ১৮ টি পিলার। আর এই আংশিক কাজ শেষ হওয়া পিলারে পানি প্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত হয়ে পলি জমে কপোতাক্ষের নাব্যতাহ্রাস পায়। মৃতপ্রায় কপোতাক্ষ নদকে পুনর্জীবিত করতে কপোতাক্ষ পাড়ের দু’জনপদের মানুষ নদ খননের দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করে। ফলশ্র“তিতে ২০১১ সালে কপোতাক্ষ নদ খননে প্রায় ২৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার।
এলাকাবাসীর অভিযোগ অসমাপ্ত সেতুর ১৮টি পরিত্যক্ত পিলার অপসারণ না করেই কপোতাক্ষ খনন কাজ সম্পন্ন করা হয়। পিলারগুলোর কারণে একদিকে যেমন জোয়ার ভাটায় পলি জমে ভরাট হচ্ছে নদ অন্যদিকে নৌযান চলাচলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা নাগরিক বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, সাতক্ষীরা তালা উপজেলা কানাইদিয়া ও খুলনা পাইকগাছার উপজেলা কপিলমুনি সংলগ্ন কপোতাক্ষ নদের উপর সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু করলেও মামলাসহ নানা জটিলতা অসমাপ্ত অবস্থায় পরিত্যক্ত ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অসমাপ্ত পিলারে কারণে নদের জোয়ার ভাটার স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হতে থাকে। খনন প্রকল্প শেষ হওয়ার পরেও অসমাপ্ত সেতুর ১৮টি পিলার নদের বক্ষে থাকার কারণে সরকারের ২৬২ কোটি টাকা ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। অচিরেই পিলারগুলো অপসারণ করা না হলে কপোতাক্ষ আবারও হারাবে তার নাব্যতা।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) খুলনার কর্তৃপক্ষ জানান, মামলাসহ নানা জটিলতা ও দীর্ঘ সূত্রিতার কারণে কানাইদিয়া কপিলমুনি সেতু নির্মাণ প্রকল্প কপোতাক্ষ খনন শুরু আগেই বন্ধ হয়েছিল। এখন সেতুটি নির্মাণ করতে হলে নতুনভাবে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। অসমাপ্ত পিলার কপোতাক্ষ নদের জন্য বড় সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে। তবে খননের সময় অসমাপ্ত পিলারগুলো অপসারণ করলে সব থেকে ভালো হতো, কিন্তু সে সময় পিলার গুলো কেন অপসারণ করা হলো না তা বুঝতে পারলাম না।
সর্বশেষ এবছর পলি মৌসুমের অনেক আগেই কপোতক্ষে পলির আগমন ঘটেছে এবং পিলারের কারণে কপোতাক্ষের তলদেশ ভরাট হচ্ছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কপোতাক্ষ হারাবে তার নাব্যতা এবং আবারও জলাবদ্ধতার স্বীকার হবে কয়েক লাখের উর্ধ্বে কপোতাক্ষ পাড়ের মানুষ। 

্রিন্ট

আরও সংবদ