খুলনা | রবিবার | ১৫ জুন ২০২৫ | ১ আষাঢ় ১৪৩২

এক সময়ের ঘনিষ্ঠ দুই মিত্র এখন পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী

রাজনীতির নিষ্ঠুর নিয়তি : খুলনা-৫ আসন হতে পারে হাই ভোল্টেজ ম্যাচ

নিজস্ব প্রতিবেদক |
০১:৪৪ এ.এম | ১৫ জুন ২০২৫


রাজনীতির নিষ্ঠুর নিয়তির শিকার হতে যাচ্ছেন খুলনার দুই প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। জোট রাজনীতির সূত্রে তারা ছিলেন একে অপরের ঘনিষ্ঠ মিত্র। সময়ের ব্যবধানে সেটি এখন মধুর প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হতে যাচ্ছে এই দুই নেতা। যা ইতোমধ্যে খুলনার সর্বত্রই আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। একদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক সংসদ সদস অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। অন্যদিকে বিগত ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে খুলনা-২ আসনের প্রভাবশালী সাবেক সংসদ সদস্য, বিসিবির সাবেক সভাপতি ও জিয়ার পরিবারের ঘনিষ্ঠ মোহাম্মদ আসগার আলী লবী। 
২০০১ সালে খুলনার রাজনীতিতে আবির্ভূত হন সাবেক সাবেক সংসদ সদস্য আলী আসগার লবী। ২০০১ সালের নির্বাচনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া খুলনা-২ (খুলনা সদর-সোনাডাঙ্গা) আসন থেকে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। ওই সময় আলী আসগার লবী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট। আসনটি খালেদা জিয়া ছেড়ে দিলে উপ-নির্বাচনে আলী আসগার লবী নির্বাচিত হন। প্রচার রয়েছে আলী আসগার লবী ২০০১ সালের নির্বাচনে খুলনা-২ আসনসহ জেলার ৬টি আসনে চার দলীয় জোট প্রার্থীদের আর্থিকসহ নানা ধরনের সহযোগিতা করেছিলেন। যে কারণে বিএনপি-জামায়াতের অতি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় লাভ করেন। জাতীয় সংসদেও অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার ও আলী আসগার লবী ট্রেজারি বেঞ্চে বসেন। এলাকার উন্নয়নসহ নানা কর্মসূচিতে সামিল হন এই দুই নেতা।
২০০৭ সালের ১/১১ সরকারের আমলে সাবেক এমপি আলী আসগার লবী গ্রেফতার হন। বন্ধ করা হয় তার সকল ব্যাংক একাউন্ট। তার অনুসারীরা বলেন, তিনি একজন সৎজন ব্যক্তি। ওয়ান ইলেভেনের সরকার ও পরবর্তীতে আওয়ামী সরকার তাকে নির্যাতন করেছে। এখনও তার ব্যাংক একাউন্ট সচল করা হয়নি। নানাবিধ ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেছেন। সেই অর্থে তিনি দলের একজন ত্যাগী নেতা। তবে তিনি প্রায় ১৮ বছর নিঃশব্দে চললেও গত ৩০ মে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাৎবার্ষিকীতে খুলনার রাজনীতিতে সরব হয়েছেন। গেল গত ২৯ মে খুলনা প্রেসক্লাবে এক কর্মসূচিতে তিনি বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে চমক সৃষ্টি করেন। বর্তমান খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপি নেতৃবৃন্দ বলেছেন, কেন্দ্রের নির্দেশে তাকে অতিথি করা হয়েছে। চমক শুধু খুলনা প্রেসক্লাবের একটি অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধতা ছিল না। পরের দিন ৩০ মে ফুলতলার জামিরায় শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাৎবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে চমক দেন। ওই অনুষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন বর্তমান জেলা বিএনপি’র আহবায়ক মনিরুজ্জামান মন্টু। এখানে পরিষ্কার হয়ে যায় কেন্দ্রের গ্রিন সিগনালে আলী আসগার লবী খুলনা-৫ আসনে বিএনপি’র পরবর্তী প্রার্থী। এমনকি ডুমরিয়া-ফুলতলাবাসীর পাশে থাকারও আশ্বাস দেন তিনি। তার আদি বাড়ি ডুমুরিয়ার টোলনা, সেটিও উলে­খ করেন। এ সময় দলের ডুমুরিয়া ও ফুলতলার শীর্ষ নেতৃবৃন্দ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়ে জানান দেন তারা লবীর সঙ্গে আছেন।
অপরদিকে কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বিগত ১৭ বছর ফ্যাসিস্ট সরকারের জেল-জুলুম, মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে অধিকাংশ সময়ই কারাগারে দিন কাটিয়েছেন। উচ্চ আদালত থেকে কালে ভদ্রে জামিন মিললেও মুক্তির পর জেল গেটে একাধিকবার তাকে পুরানো ও গায়েবি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। বলতে গেলে ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে পুরো সময়টা কাটে তার কারাবন্দি জীবন। তবে গত বছর ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর তিনি মুক্তি পান এবং দেশের রাজনীতিতে অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হিসেবে হাজির হন। তিনি মুক্তি পাওয়ার পর থেকে গত ১০ মাস তার নির্বাচনী এলাকার সর্বত্রই উপস্থিতির জানান দেন। তার সঙ্গে রয়েছে দলীয় সুশৃঙ্খল নেতা-কর্মীর নিবেদিত শ্রম। অতীতে ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে তিনি খুলনা-৫ (ফুলতলা-ডুমুরিয়া) আসন থেকে চারদলীয় জোট থেকে মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তখন এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন করেন এবং দলের সাংগঠনিক অবস্থা সুদৃঢ় করেন। 
ডুমুরিয়া-ফুলতলা বিএনপি’র একাধিক নেতা জানান, খুলনা-৫ আসনে বিএনপি’র ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকলেও বিগত দিনে দলীয় প্রার্থী না থাকা এবং দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বিএনপি’র সাংগঠনিক অবস্থা নিরূপন করা সম্ভব হয়নি। তবে বিগত ২০১১ সালে ইউপি নির্বাচনে ডুমুরিয়ার ১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে বিএনপি প্রার্থীরা ১১টিতে এবং জামায়াত প্রার্থী ১টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। অপর দিকে ফুলতলা উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের তিনটিতে বিএনপি’র দখল ছিল। তবে ওই সময় বিএনপি-জামায়াত জোটবদ্ধ ছিল। বিএনপি-জামায়াতের সম্মিলিত ভোটে তারা নির্বাচিত হন। যে কারণে বিএনপি-জামায়াতের কার কতো ভোট তা সঠিক নিরুপন করা সম্ভব হয়নি। তখন মূল প্রতিদ্ব›দ্বী ছিল আ’লীগ। এবার মাঠে আ’লীগ থাকছে না, এটা প্রায় নিশ্চিত। এবাইর বোঝা যাবে বিএনপি-জামায়াতের কার কেমন ভোট। যদি উভয়ের ভোট কাছাকাছি হয়, সেক্ষেত্রে সাধারণ আ’লীগের সমর্থক ও সংখ্যালঘু হিন্দু স¤প্রদায়ের ভোট হবে জয়-পরাজয়ের নির্ণয়ক। এছাড়া দলীয় কোন্দল নিরসন করে এক সঙ্গে কাজ করলে বিএনপি এখানে চমক দেখাতে পারে। আসনটি মূলতঃ আ’ালীগের আসন হিসেবে পরিচিত থাকলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়ে চমক সৃষ্টি করেনে। গত ৫ আগস্টের পর বলতে গেলে অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এক চিটিয়া দখলে রেখেছেন রাজনীতির মাঠ। অনায়াসে তিনি জিতে যাবেন এমনটি ধারণা এলাকায় প্রচার ছিল। তাছাড়া সুসংগঠিত জামায়াতের সাংগঠনিক শক্তি অন্যতম নিয়মক। অপর খুলনা-৫ আসনে দীর্ঘদিন বিএনপি’র কোনো যোগ্যপ্রার্থী না থাকায় নেতা-কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের আপসোস ছিল। এবার আলী আসগার লবী প্রার্থী হওয়ায় ঐক্যবদ্ধ বিএনপিই বদলে দিতে পারে সকল হিসাব-নিকাষ। জমে উঠেছে খুলনা-৫ আসনে আগামী ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যে কারণে একটু হলেও চিন্তার ভাজ পড়ছে জামায়াত তথা সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার শিবিরে।
তবে সব কিছু ঠিক থাকলে খুলনা-৫ আসন হতে পারে হাই ভোল্টেজ ম্যাচ। যিনি বিজয় হবেন, তিনি রেকর্ড সৃষ্টি করবেন। একই সঙ্গে এক সময়ের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মিত্র ভোটের মাঠে পরস্পর প্রতিদ্ব›দ্বী সময়ে নিষ্ঠুর বলি হতে পারেন যে কেউ। যার অপেক্ষা করতে হবে আগামী ত্রয়োদ্বশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত।

্রিন্ট

আরও সংবদ