খুলনা | সোমবার | ২৩ জুন ২০২৫ | ৯ আষাঢ় ১৪৩২

হরমুজ প্রণালী বন্ধ করতে পারে ইরান, পার্লামেন্টে অনুমোদন

খবর প্রতিবেদন |
১০:৫৮ পি.এম | ২২ জুন ২০২৫


যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুট হরমুজ প্রণালি বন্ধের পক্ষে ভোট দিয়েছে ইরানের পার্লামেন্ট। রোববার ইরানের পার্লামেন্টে এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ বিষয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদকে।
খবরে বলা হয়, প্রস্তাবটি এখন ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। এই কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত পাওয়ার পরই প্রণারিটি বন্ধের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইরানি আইন প্রণেতা ও বিপ্লবী গার্ড কমান্ডার ইসমাইল কোসারিকে উদ্ধৃত করে রোববার এই তথ্য জানিয়েছে ইরানের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গণমাধ্যম প্রেস টিভি।
পার্লামেন্টের সদস্য এবং ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) কমান্ডার এসমাইল কোসারি জানিয়েছেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা বর্তমানে ইরানের কৌশলগত বিবেচনায় রয়েছে এবং ‘প্রয়োজন মনে হলে তা করা হবেই।’
ইসমাইল কোসারি রোববার ইয়ং জার্নালিস্ট ক্লাবকে বলেন, এমন পদক্ষেপের বিষয়টি আমাদের আলোচ্যসূচিতে আছে ওযখন প্রয়াজন হবে তখনই কার্যকর করা হবে।
গণমাধ্যম জানিয়েছে, হরমুজ প্রাণালী দিয়ে প্রতিদিন বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ তেল ও গ্যাস বিভিন্ন দেশে যায়। তেল-গ্যাস সরবরাহে এই প্রণালীর গুরুত্ব অপরিসীম। ইরান যদি এটি বন্ধ করে দেয় তাহলে বিশ্ব বাজারে তেলের মূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে। 
৩৫ থেকে ৬০ মাইল (৫৫ থেকে ৯৫ কিলোমিটার) প্রশস্ত হরমুজ প্রণালি পারস্য উপসাগর ও আরব সাগরকে সংযুক্ত করেছে। এই রুট দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ব্যারেল তেল ও তেলজাত পণ্য পরিবহন করে বিশ্ব শিপিং সংস্থাগুলো, যা বিশ্বব্যাপী তেল সরবরাহের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ।
ইরানের দক্ষিণে অবস্থিত এই জলপথটি বিশ্বের জীবাশ্ম জ্বালানি সরবরাহের জন্য একটি সংকীর্ণ বাধাবিন্দু, যার মধ্য দিয় বিশ্বব্যাপী তেল সরবরাহের ২০ শতাংশ এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ২০ শতাংশ প্রবাহিত হয়। হরমুজ প্রণালিকে ঘিরে থাকা প্রধান দেশগুলো হলো ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমান। এই দেশগুলোই হরমুজ প্রণালি নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করে।
ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয় তবে বিশ্বব্যাপী তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে উলে­খযোগ্য সময় বেশি ব্যয় হতে পারে এবং এর তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে তেলের দামের ওপর। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য যেসব দেশ উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে তেল আমদানির ওপর নির্ভরশীল তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিশ্লেষক সংস্থা ভোরটেক্সার গবেষণায় দেখা গেছে, সৌদি আরব হরমুজ প্রণালি দিয় প্রতিদিন প্রায় ৬০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করে যা অন্য প্রতিবেশী দেশের তুলনায় বেশি।
এই প্রণালি ব্যবহার করে যে দেশগুলো অপরিশোধিত তেল আমদানি করে তাদের মধ্যে শীর্ষ স্থানীয় হলো চীন, ভারত, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া। ইআইএ-র অনুমান ২০২২ সালে, হরমুজ প্রণালি দিয়ে যাওয়া প্রায় ৮২ শতাংশ অপরিশোধিত তেল এবং ঘনীভূত তেলই (কম ঘনত্বের তরল হাইড্রোকার্বন যা সাধারণত প্রাকৃতিক গ্যাসের সাথে তৈরি হয়) পাঠানো হতো এশিয়ার দেশগুলোতে।
চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল ইরানের সরকারি সংবাদ সংস্থা ইসলামিক রিপাবলিক নিউজ এজেন্সি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছিল সে দেশে (দক্ষিণ কোরিয়ার) সরবরাহ হওয়া তেলের ৬০ শতাংশ হরমুজ প্রণালি দিয় যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদিন এই প্রণালি ব্যবহার করে প্রায় সাত লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল এবং ঘনীভূত তেল আমদানি করে-যা তাদের মোট তেল আমদানির প্রায় ১১ শতাংশ এবং পেট্রোল ব্যবহারের তিন শতাংশ।
হরমুজ প্রণালি ব্যবহার করে প্রতিদিন ইউরোপের সামগ্রিক তেলের ১০ লাখ ব্যারেলের কম বলে মনে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে আরব ও এশীয় দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় শক্তির চেয়ে বেশি পরিমাণে ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
ইরান ও ওমানের মাঝখানে অবস্থিত হরমুজ প্রণালি আরব উপসাগরকে আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এটি বৈশ্বিক জ্বালানি পরিবহনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পথ। বিশ্বের মোট তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের প্রায় ২০ শতাংশ এই প্রণালি দিয় অতিক্রম করে।
এই পথ বন্ধ হয় গেলে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে প্রভাব পড়বে এবং তেলের দামে হঠাৎ বড় রকমের ঊর্ধ্বগতি ঘটাতে পারে, যা ইতোমধ্যেই অস্থির একটি অঞ্চলে আরও অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।
হরমুজ প্রণালি দীর্ঘদিন ধরেই একটি ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু। অতীতেও ইরান একাধিকবার প্রণালিটি বন্ধ করার হুমকি দিয়ছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনার সময়। তবে বহুবার হুমকি দিলেও ইরান এখনো পর্যন্ত কখনোই সত্যিকার অর্থে এই প্রণালি বন্ধ করেনি, কারণ এমন একটি পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক পরিসরে চরম উত্তেজনা বৃদ্ধির ইঙ্গিত হিসেবে বিবেচিত হবে। 
উলে­খ্য, হরমুজ প্রণালিটি আরব উপসাগর এবং আরব সাগরের সংযোগকারী একটি সংকীর্ণ সামুদ্রিক পথ, যা বিশ্বে তেল ও গ্যাস পরিবহনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ তেল ও তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (খঘএ) এ পথ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে এশিয়া, ইউরোপ এবং অন্যান্য অঞ্চলে রপ্তানি হয়।
এই প্রণালিতে যদি কোনও ধরনের বাধা সৃষ্টি হয়, তাহলে তা বিশ্বব্যাপী জ্বালানি বাজারে বিশাল ধাক্কা সৃষ্টি করবে। এতে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়া, সরবরাহ ব্যাহত হওয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে আরও বড় পরিসরে অস্থিরতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ইরান অতীতেও হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে, বিশেষত যখন দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ও নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে। তবে ইতিহাসে কখনোই তারা বাস্তবিক অর্থে প্রণালিটি বন্ধ করেনি। এটি এমন একটি পদক্ষেপ, যা আন্তর্জাতিকভাবে ‘চরম উত্তেজনাকর পদক্ষেপ’ হিসেবে দেখা হবে এবং যার পরিণতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সা¤প্রতিক হামলা এবং আন্তর্জাতিক চাপে জর্জরিত ইরান হয়তো এবার হুমকিকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে, যদি তারা নিজেদের নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক আধিপত্য রক্ষায় এমন সিদ্ধান্তকে অপরিহার্য মনে করে। 
সূত্র: আল অ্যারাবিয়া, বিবিসি, রয়াটার্স, কুয়েত টাইমর্স।

্রিন্ট

আরও সংবদ