খুলনা | শুক্রবার | ২৭ জুন ২০২৫ | ১৩ আষাঢ় ১৪৩২

শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক |
০২:২৮ এ.এম | ২৭ জুন ২০২৫


‘যেই গৌর সেই কৃষ্ণ সেই জগন্নাথ’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব আজ শুক্রবার সাড়ম্বরে উদযাপিত হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, খুলনা মহানগর শাখার সার্বিক পরিচালনায় এবং শ্রীশ্রীসত্যনারায়ণ মন্দির, টুটপাড়া গাছতলা মন্দির ও আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন), খুলনা’র আয়োজনে আজ শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় নগরীর স্যার ইকবাল রোডস্থ গোলকমণি শিশু পার্কে উৎসবমুখর পরিবেশে মহাধুমধামের সাথে রথযাত্রার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। 
শাস্ত্র মতে তাই মানুষের দেহ হচ্ছে রথ এবং ঈশ্বর হচ্ছেন তার সারথি। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীজগন্নাথকে দর্শন করলে এই জড় জগতের জন্ম মৃত্যুর আবদ্ধতা ও মায়া মমতা থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব। এই বিশ্বাসকে ধারণ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা রথযাত্রা উৎসব উদযাপন করে আসছে। রথযাত্রা আজ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে অন্যতম ধর্মীয় উৎসব এবং বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।
প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে আয়োজন করা হয়েছে উৎসবের। এ উৎসবের কেন্দ্রস্থল হচ্ছে ঐড়িষ্যা বা ঐড়িষ্যা রাজ্যের পুরিতে অবস্থিত জগন্নাথদেবের প্রধান মন্দিরে। এ উৎসব ভারত, বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশে পালিত হয়ে আসছে।
রথযাত্রা হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের (হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের) দেবতা জগন্নাথ, বলরাম ও শুভদ্রার তিনটি সুসজ্জিত মূর্তি রথে চেপে পুরির শ্রীজগন্নাথদেবের মন্দির থেকে মাসির বাড়িতে গুন্ডিচা যাত্রাকে বোঝায়।
পুরীতে এই রথযাত্রা দেখতে সারা পৃথিবী থেকে লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে। জগন্নাথ, বলরাম ও শুভদ্রার গুন্ডিচা মন্দিরে শ্রীজগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি হিসেবে খ্যাত সেখানে যাওয়াকে কেন্দ্র করে রথযাত্রা শুরু হয়। সাত দিন মাসির বাড়ি থেকে পোঙা পিঠা খেয়ে আবার বাড়ির পথে ফিরে আসা যা উল্টো রথ নামে পরিচিত এবং এর মাধ্যমে এ উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।
কীভাবে, কবে থেকে, জগন্নাথদেবের রথযাত্রার প্রচলন তা নিয়ে তা জানতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে মালবদেশ যা বর্তমানে উড়িষ্যা নামে পরিচিত সে রাজ্যের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছে। কেননা রথযাত্রার সূচনা হয়েছিলো এই রাজার হাত ধরেই।
পদ্মপুরাণ এর বর্ণনানুযায়ী ও তথ্যমতে এই রাজার হাত ধরেই রথযাত্রার প্রচলন। তখন সত্যযুগ, মালবদেশ এর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ছিলেন শ্রীবিষ্ণু ভক্ত। তিনি গড়ে তুলেছিলেন জগন্নাথধাম তথা শ্রীক্ষেত্র নামের এক পবিত্র মন্দির। এই মন্দিরে ছিলো না কোনো বিগ্রহ। একদিন এক সন্যাসীর আগমন ঘটে রাজপ্রাসাদে। রাজার সেবা যতেœ তুষ্ট হয়ে তাকে বললেন নীলমাধব (ভগবান বিষ্ণুর আরেক রূপ) এর গুপ্তভাবে শবরদের মাধ্যমে পূজিত হবার কথা। নীল পর্বতের ধারেই ছিলো শবরদের বসবাস। সন্যাসীর কথা শুনে নীলমাধবের দর্শনের জন্য ব্যাকুল হয়ে গেলেন রাজা। তখন সে ডেকে পাঠালেন তার পুরোহিতের ভাই বিদ্যাপতিকে এবং শবরদের দেশে গিয়ে খুঁজে আনতে বললেন নীলমাধবের মূর্তিকে।
রাজার আদেশ মেনে বিদ্যাপতি গেলেন শবররাজ বিশ্ববসুর নিকট। সেখানে একবার জঙ্গলের মাঝে বিদ্যাপতি পথ ভুলে যায়। তখন তাকে উদ্ধার করেন বিশ্ববসুর কন্যা ললিতা। ঘটনাক্রমে বিদ্যাপতি ললিতার প্রেমে পড়ে গেল। এরপর রাজা দু’জনের বিয়ে দিয়ে দিলেন। কিন্তু বিদ্যাপতির মাথার মধ্যে তখনো নীলমাধবের দর্শনের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। সে অনেক অনুনয় বিনয়ের মাধ্যমে ললিতাকে রাজি করালো নীলমাধবের দর্শন করানোর জন্য। কিন্তু ললিতার শর্ত ছিলো যে তিনি বিদ্যাপতিকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাবেন। বিদ্যাপতি গেলেন চোখ বেঁধে কিন্তু সাথে করে নিয়ে গেলেন যব এর দানা।
যাবার পথে ললিতার অগোচরে তিনি সেই দানা পথে ফেলতে ফেলতে ফেলেন চিহ্ন হিসেবে। নীল পর্বতে গিয়ে নীলমাধবের দর্শন পেয়ে বিদ্যাপতি ধন্য হলেন। এর পরে তিনি খবর পাঠালেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছে। রাজা তার রথ, সৈন্য নিয়ে এলেন নীলমাধবকে নিয়ে যেতে। কিন্তু শ্রীহরির লীলা বোঝা বড় দায়।
রাজা পৌঁছে গিয়ে দেখলেন যে মন্দিরে নীলমাধবের বিগ্রহ নেই। যদিও এ নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে কোথায় বলা হয় নীল মাধবে নীজে থেকেই লীন হয়ে যান, আবার কেউ বলে থাকেন যে শবরেরা নীলমাধবের বিগ্রহ লুকিয়ে রেখে দেয়। এতদূরে এসেও নীলমাধবের দেখা না পেয়ে ইন্দ্রদ্যুম্ন হতাশ হয়ে পড়েন এবং সিদ্ধান্ত নেন এ জীবন সে রাখবে না। ঠিক এই সময় আকাশ থেকে দৈববাণী শোনা যায়-
‘সমুদ্রের জলে ভেসে আসবে দারুব্রহ্ম কাষ্ঠ, সেই কাষ্ঠখণ্ড থেকেই তৈরি হবে বিগ্রহ’ (অর্থাৎ নীলমাধবের বিগ্রহ)।
এরপর রাজা চলে আসলেন তার নিজ রাজ্যে। হঠাৎ এক রাত্রে রাজা স্বপ্নে দেখলেন, ভগবান শ্রীহরি তাকে বলছেন-‘আমি সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে তোমার নিকট আসছি। পুরীর বাঙ্কিমুহান নামক স্থানে তুমি আমাকে দারুব্রহ্ম রূপে পাবে।’
রাজা সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সেই স্থানে গিয়ে দেখতে পেলেন এক খন্ড কাঠের টুকরো। হাতি সৈন্য এনেও সেই কাঠ নড়ানো গেলো না। তখন শ্রী হরির স্বপ্নাদেশে খবর পাঠানো হলো শবররাজ বিশ্ববসুকে। তিনি আসার পর বিদ্যাপতি, রাজা ও বিশ্ববসু এই তিনজনে মিলে সেই কাঠের টুকরো নিয়ে এলেন রাজার প্রাসাদে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো সে কাঠ খোদাই করার মত ক্ষমতা কারোরই ছিলো না ঐ রাজ্যে।
হাতুড়ি বা খোদাই করতে গেলেও তা সম্ভব হলো না। ভেঙ্গে যাচ্ছে বারবার। রাজা আবার চিন্তায় পরে গেলেন। ঠিক তখনি তার কাছে এলেন অনন্ত মহারাণা নামের এক ছুতোর। অনেকের মতে শ্রীহরি নিজেই এসেছিলেন ছুতোর হয়ে আবার মতান্তরে অনেকে বলে থাকেন বিশ্বকর্মা এসেছিলেন ভগবান এর আদেশে।
সে বললো সে এই কাঠ খোদাই করে গড়ে দিবেন নীল মাধবের বিগ্রহ। কিন্তু তার একটি শর্ত হলো ২১ দিনের মধ্যে কেউ এই মন্দিরে প্রবেশ করবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তার খোদাই এর কাজ শেষ হয়। রাজা রাজি হয়ে গেলেন। দরজায় পাহাড়া বসলো। কিন্তু বিপত্তি বাধালো ইন্দ্রদ্যুম্নের রানী গুণ্ডীচা। তার আর অপেক্ষা মানছিলো না, কাজ শেষ হবার আগেই ১৪ দিনের মাথায় তিনি মন্দিরে প্রবেশ করলেন। মন্দিরে ঢুকে তিনি দেখতে পেলেন এক অদ্ভূত দৃশ্য। সেখানে নেই কোন ছুতোর, অসম্পূর্ণ অবস্থায় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা দেবীর মূর্তি দেখে রানী ভিরমি খেলেন। একি মূর্তি! নীল নবঘন শ্যামল শ্রীবিষ্ণুর এমন গোলাকৃতি নয়ন, হস্ত পদ হীন, কালো মেঘের মতো গাত্র বর্ণ দেখে রানীর মাথা ঘুরতে লাগলো।
রাজা শুনে ছুটে এলেন। রানীর উপরে ক্ষিপ্ত হলেন এবং এও বললেন শর্ত ভঙ্গের কারণে কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই ছুতোর চলে গেছেন। বিমর্ষ হয়ে পড়লেন রাজা। কিন্তু ভক্তের কষ্ট ভগবান সইবেন কেন। সে রাত্রেই রাজাকে আবার স্বপ্নে দেখা দিলেন। তাকে বললেন তিনি এই রূপেই পূজিত হবেন। তার নিজস্ব কোনো আকার বা আকৃতি নেই। ভক্তেরা যে রূপ কল্পনা করে তার আরোধনা করেন তিনি তার কাছে ঠিক তেমনই। তিনি রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন কে বললেন এই অসম্পূর্ণ অবস্থায়ই তিনি পূজা গ্রহণ করবেন এবং তাকে পুরুষোত্তম ধামে স্থাপন করা হয় যেন এবং সেখানেই তিনি পূজা গ্রহণ করবেন। আর এভাবেই প্রতিষ্ঠা হয় জগন্নাথ দেব-এর।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ খুলনা মহানগর শাখার সভাপতি শ্যামল হালদারের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক প্রশান্ত কুমার কুণ্ডুর পরিচালনায় প্রধান অতিথি হিসেবে উদ্বোধন করবেন খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোঃ জুলফিকার আলী হায়দার। সম্মানিত অতিথি থাকবেন হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি সত্যানন্দ দত্ত ও খুলনা সেবাশ্রম সংঘের অধ্যক্ষ স্বামী বিপ্রানন্দজী মহারাজ। 
উদ্বোধন শেষে ভক্তবৃন্দ জগন্নাথদেবের ছবি সম্বলিত ব্যানার, ফেস্টুন, প্লাকার্ড, শঙ্খ-ঘণ্টা, বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নামসংকীর্ত্তন করতে করতে শোভাযাত্রা সহকারে বিভিন্ন মন্দির থেকে আগত শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের রথের দড়ি টেনে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে জোড়াগেটস্থ প্রেমকানন অঙ্গণে প্রবেশ করবে। রথ চলার পথে পিপাসার্ত ভক্তদের জলছত্রের মাধ্যমে পিপাসা নিবারণ ও প্রেমকানন অঙ্গণে প্রসাদ বিতরণ করা হবে। শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের রথ আগামী ১১ জুলাই (১৫ দিনব্যাপী) শুক্রবার পর্যন্ত প্রেমকাননে অবস্থান করবে এবং অবস্থানান্তে উল্টো রথযাত্রার মাধ্যমে রথ স্ব-স্ব মন্দিরে প্রত্যাবর্তন করবে। 
অবস্থানকালে প্রতিদিন ঊষাকীর্ত্তন, বাল্যভোগ, মধ্যাহ্নে ভোগরাগ, সন্ধ্যারতি, শ্রীমদ্ভাগবত পাঠ, ধর্মীয় আলোচনা, বৈদিক গীতিনাট্য, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নামকীর্ত্তন ও মেলা অনুষ্ঠিত হবে। উপস্থিত ভক্তবৃন্দের মাঝে প্রত্যহ প্রসাদ বিতরণ করা হবে। 
এছাড়াও আর্য্য ধর্মসভা মন্দির ও গোপাল সেবাশ্রম সংঘ এর আয়োজনে আজ শুক্রবার বেলা ১১টায় রথযাত্রা উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে রথের টানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পরিবার-পরিজনসহ উপস্থিত হওয়ার আহŸান জানিয়েছেন খুলনা জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ নেতৃবৃন্দ। 
বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা ইউনিয়নের উদ্যোগে বেতাগা কালিবাড়ি গোবিন্দ মন্দিরের প্রাঙ্গণে রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হবে।

্রিন্ট

আরও সংবদ