খুলনা | রবিবার | ২৯ জুন ২০২৫ | ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

এএফপির রিপোর্ট

বিনা বিচারে ভারত থেকে মুসলিমদের বিতাড়নের অভিযোগ, আতঙ্কে বাঙালি মুসলমানেরা

খবর প্রতিবেদন |
০৫:২৪ পি.এম | ২৭ জুন ২০২৫


ভারত বিনা বিচারে শত শত মানুষকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর এই বিষয়টি দুই দেশের কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করেছেন। এ নিয়ে মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা কড়া সমালোচনা করেছেন। তারা বলছেন, এসব বহিষ্কার বেআইনি এবং জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে করা হয়েছে।
তবে ভারতের দাবি, যাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে তারা ‘অবৈধ অভিবাসী’। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীদের ভাষ্য, এই প্রক্রিয়া বেআইনি এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রসূত। শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এএফপি।
বার্তাসংস্থাটি বলছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার দীর্ঘদিন ধরেই অভিবাসন, বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। শীর্ষ কর্মকর্তারা অতীতে এসব অভিবাসীদের ‘উইপোকা’ বা ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের এমন অবস্থান ভারতের প্রায় ২০ কোটিরও বেশি মুসলমানের মধ্যে, বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে চরম উদ্বেগ ও আতঙ্ক তৈরি করেছে।
মুসলমানরা এখন ভয়ে আছে : ভারতের বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী হর্ষ মন্দার বলেন, বিশেষ করে দেশের (ভারতের) পূর্বাঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে ভীষণ ভয় ও উদ্বেগ বিরাজ করছে। যেন তাদের অস্তিত্বই এখন হুমকির মুখে।
২০২৪ সালে ঢাকায় সরকার পতনের পর দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়। বাংলাদেশ, যেটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে ভারতের স্থলসীমানায় ঘেরা, অতীতে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল।
কাশ্মির হামলার পর লাগামহীন দমন-পীড়ন : গত ২২ এপ্রিল ভারতশাসিত কাম্মিরে ২৬ জন, যাদের বেশির ভাগই হিন্দু পর্যটক, নিহত হওয়ার ঘটনায় ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে। যদিও ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করে। এর জেরে চারদিনের সীমান্ত সংঘাতে ৭০ জনের বেশি প্রাণ হারায়। এই ঘটনার পর ভারত জুড়ে নজিরবিহীন নিরাপত্তা অভিযান শুরু হয়। হাজার হাজার মানুষকে আটক করা হয় এবং অনেককেই বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে গিয়ে বন্দুকের মুখে জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
দাঁড়াবে না, না হলে গুলি করবো : আসামের রহিমা বেগম নামে এক নারী জানান, গত মে মাসের শেষদিকে তাকে পুলিশ কয়েকদিন আটকে রাখে। পরে পাঁচজন মুসলিমসহ তাকে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। রহিমা বলেন, আমার জন্ম, বাবা-মা, দাদা-দাদি সবাই এখানকার। জানি না কেন আমাদের সঙ্গে এমন করা হলো।
এএফপি বলছে, রাতের অন্ধকারে তাদের জলাভূমির দিকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বলা হয়, ওই দূরের গ্রামে হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছাও। দাঁড়াতে চেয়ো না, দাঁড়ালে গুলি করে দেব।
বাংলাদেশের স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের খুঁজে পেয়ে বর্ডার গার্ডের কাছে তুলে দেয়। এরপর বাংলাদেশি বাহিনী তাদের মারধর করে এবং ভারতীয় ভূখণ্ডে ফিরে যেতে বলে। ফিরে যাওয়ার সময় সীমান্তের ওপার থেকে গুলি ছোঁড়া হয় বলে রাহিমা জানান। তার ভাষায়, আমরা ভেবেছিলাম, এখানেই শেষ। সবাই মারা যাব।
এক সপ্তাহ পর তাকে ফের আসামে এনে ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে সতর্ক করে দেওয়া হয়, চুপচাপ থাকো।
আইনের কোনো বালাই নেই : নয়াদিলি­ভিত্তিক আইনজীবী সঞ্জয় হেগড়ে বলেন, কোনও রাষ্ট্র কাউকে ফেরত পাঠাতে পারে না যদি না গ্রহণকারী রাষ্ট্র তাদের স্বীকার করে। আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াও কাউকে নির্বাসন দেওয়া বা বিতাড়ন করা বেআইনি।
বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, চলতি বছরের মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত ভারতের পক্ষ থেকে ১৬০০ জনকে সীমান্তে ঠেলে পাঠানো হয়েছে। তবে ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি, প্রকৃত সংখ্যা ২৫০০ জনেরও বেশি।
বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা বলছে, ফেরত পাঠানোদের মধ্যে অন্তত ১০০ জন প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক ছিলেন, যাদের তারা আবার ভারতে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
ঘৃণাভিত্তিক অভিযানের শিকার মুসলিমরা : অধিকার কর্মীরা বলছেন, মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) শাসিত রাজ্যগুলোতেই বেশি নির্যাতন চলছে, যেখানে অনেকেই নিম্ন বেতনভোগী শ্রমিক, তাদের বেশির ভাগই বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান।
গুজরাটের পুলিশ প্রধান জানিয়েছেন, রাজ্যজুড়ে ৬৫০০ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের অনেকেই বাংলা ভাষাভাষী ভারতীয় ছিলেন, পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। হর্ষ মন্দার বলেন, বাংলা ভাষায় কথা বলা মুসলমানদের একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারাভিত্তিক ঘৃণানীতির অংশ হিসেবে টার্গেট করা হচ্ছে।
আমার পরিচয় দেখালাম, বিশ্বাস করলো না : ৩৫ বছর বয়সী নির্মাণ শ্রমিক নাজিমুদ্দিন মণ্ডল জানান, মুম্বাই থেকে তাকে পুলিশ তুলে নেয়, এরপর সামরিক বিমানে করে ত্রিপুরা সীমান্তে নিয়ে যায় এবং জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। পরে তিনি কোনো ভাবে ফিরে এসে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে আছেন।
তিনি বলেন, আমি সরকার-প্রদত্ত পরিচয়পত্র দেখালাম, কিন্তু তারা শুনতেই চায়নি। এখন কাজে বের হতেও ভয় লাগে।
কড়া সমালোচনা করেছেন মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীরা : ভারতের এ অভিযানের কড়া সমালোচনা করেছেন মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা। তারা বলছেন, এই পদক্ষেপ আইন বহির্ভূত।
নয়াদিলি­ভিত্তিক মানবাধিকার আইনজীবী সঞ্জয় হেগড়ে বলেন, ‘কোনো দেশ কাউকে ফেরত পাঠাতে পারে না, যদি না অন্য দেশ তাকে গ্রহণে রাজি থাকে।’  তার ভাষায়, ভারতের আইন অনুসারে যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া কাউকে বহিষ্কার করা বেআইনি।
বাংলাদেশ জানিয়েছে, মে মাস থেকে ভারত ১,৬০০’র বেশি মানুষকে জোরপূর্বক সীমান্ত পার করেছে। তবে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, প্রকৃত সংখ্যা ২,৫০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডস (বিজিবি) জানিয়েছে, এদের মধ্যে ১০০ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে, কারণ তারা ভারতীয় নাগরিক।
ভারতের বিরুদ্ধে এর আগেও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের জোর করে ফেরত পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে। তখন ভারতীয় নৌবাহিনী এসব মানুষকে যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের উপকূলে নামিয়ে দেয়।
মানবাধিকার কর্মীদের মতে, বর্তমানে যাদের টার্গেট করা হচ্ছে, তারা মূলত বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর দরিদ্র মুসলিম শ্রমজীবী মানুষ।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেয়নি। তবে আসামের মুখ্যমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, তার রাজ্য থেকে অন্তত ৩০০ জনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এদিকে গুজরাটের পুলিশ প্রধান জানিয়েছেন, রাজ্যে এখন পর্যন্ত ৬,৫০০’র বেশি মানুষকে আটক করা হয়েছে। এটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর রাজ্য। অধিকাংশ আটক ব্যক্তি বাংলা ভাষাভাষী ছিলেন এবং পরবর্তীতে তাদের অনেককে ছেড়ে দেওয়া হয়।
মানবাধিকারকর্মী হর্ষ মন্দার বলেন, ‘যারা মুসলমান এবং বাংলা ভাষায় কথা বলেন, তাদের পরিকল্পিতভাবে টার্গেট করা হচ্ছে। এটি একটি চিন্তাধারাভিত্তিক ঘৃণার অভিযান। ’ 
৩৫ বছর বয়সি রাজমিস্ত্রি নাজিমউদ্দিন মণ্ডল জানান, মুম্বাইয়ে পুলিশ তাকে আটক করে এবং একটি সামরিক বিমানে করে ত্রিপুরা সীমান্তে নিয়ে যায়; সেখান থেকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়। তিনি কোনোরকমে ফিরে এসেছেন এবং এখন পশ্চিমবঙ্গের নিজের জন্মভূমিতে রয়েছেন।
নাজিমউদ্দিন মণ্ডল বলেন, ‘আমি আমার সরকারি পরিচয়পত্র দেখালেও তারা শুনলো না। আমরা তাদের বলছিলাম আমরা ভারতীয়, কিন্তু তারা আমাদের লাঠিপেটা করছিল। এখন আমি এতটাই ভয়ে আছি যে কাজের খোঁজে বাইরে যেতেও সাহস হয় না।’

্রিন্ট

আরও সংবদ