খুলনা | শনিবার | ১২ জুলাই ২০২৫ | ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

যে সমস্ত বিষয়গুলো রিয়ার অন্তর্ভুক্ত নয়

ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন |
১২:১২ এ.এম | ১২ জুলাই ২০২৫


হযরতে ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, কিছু কাজ লোক দেখানো বা শির্ক বলে মনে হলেও, মূলত তা রিয়া নয়, যেমন : সুন্দর পোশাক পরিধান করা। মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধ পাওয়ার লক্ষে পোশাক নির্বাচন করা, পোশাকের ভিন্নতা ও চাকচিক্য এজন্য বেছে নেওয়া যেন লোকসমাজে আমি প্রসিদ্ধ পাই। এককথায় মানুষের নিকট আলোচিত ও প্রসিদ্ধ হওয়ার নিয়তে পোশাক গ্রহণ করা জায়েয নয়। এছাড়াও এমন পোশাক পরিধান করা নিষিদ্ধ, যেগুলোকে শরীয়ত অহংকারীদের নিদর্শন সাব্যস্ত করেছে এবং তা পরিধান করতে নিষেধ করেছে। তবে সুন্নাত সম্মত উপায়ে সুন্দর, রুচি সম্মত ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে না।
পাপ গোপন করা বা তা প্রকাশ না করা : আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, ‘আমার সকল উম্মত মাফ পাবে, তবে প্রকাশকারী ব্যতীত। আর নিশ্চয়ই এ বড় ধৃষ্টতা যে, কোনো ব্যক্তি রাতে অপরাধ করলো যা আল্লাহ গোপন রাখলেন। কিন্তু সে ভোর হলে বলে বেড়াতে লাগলো, হে অমুক! আমি আজ রাতে এমন এমন কর্ম করেছি। অথচ সে এমন অবস্থায় রাত অতিবাহিত করলো যে, আল্লাহ তার কর্ম গোপন রেখেছিলেন, আর সে ভোরে উঠে তার উপর আল্লাহর পর্দা খুলে ফেললেন’। (বুখারী)
ইবাদতকারীকে দেখে ইবাদতের প্রতি উৎসাহ-উদ্দীপনা বৃদ্ধি পাওয়া : ইমাম মাকদিসী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘কেউ অধিক ইবাদতকারীর সাথে রাত্রি যাপন করলে তার অল্প ইবাদত করার অভ্যাস থাকলে সে যদি উক্ত ব্যক্তির দ্বারা উৎসাহিত হয়ে বেশি সালাত ও সাওম পালন করে তবে কেউ হয়তো ভাবতে পারে এটা রিয়া তথা লৌকিকতা। আসলে ব্যাপারটা মোটেও এরূপ নয়। বরং এতে ফায়েদা আছে। মূলত সব মু’মিনই আল্লাহর ইবাদত করতে চায়, কিন্তু অনেক সময় বিভিন্ন বাঁধা-বিপত্তি ও অলসতার কারণে সম্ভব হয়ে উঠে না, তখন অন্যের কারণে সে অলসতা দূর হয়ে যায়’। (মিনহাজুল ক্বাসেদীন)
কোন কাজ ইখলাসের সাথে করার পর মানুষ তার প্রশংসা করলে খুশি হওয়া : ব্যক্তির ইচ্ছা ছিল ইবাদত গোপনভাবে করা এবং একমাত্র আল্লাহর জন্যই করা, কিন্তু মানুষ যদি জেনে যায় তবে বুঝতে হবে আল্লাহ তা’য়ালা তার ইবাদতের সৌন্দর্য মানুষের মাঝে প্রকাশ করেছেন, তখন মানুষের প্রশংসা ও সম্মানের আশা না করে আল্লাহর এ সুন্দর কাজে খুশি হওয়া এবং আল্লাহ তার গুনাহ গোপন করায় আনন্দিত হওয়া প্রয়োজন।
প্রত্যাশা ছাড়াই সুনাম সুখ্যাতি অর্জিত হলে : ফুদাইল ইবন ‘ইয়াদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘লোক দেখানোর ভয়ে আমল ছেড়ে দেওয়া রিয়া, আর লোক দেখানোর জন্য আমল করা শির্ক, আল্লাহ তোমাকে এ থেকে মুক্ত রাখা হলো ইখলাস’। ইমাম নাওয়াবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ কথার ব্যাখ্যায় বলেন, তার কথার উদ্দেশ্য হলো কেউ কোনো ইবাদত করার ইচ্ছা পোষণ করলে লৌকিকতার ভয়ে তা ছেড়ে দিলে রিয়া হিসেবে গণ্য হবে, কেননা মানুষের কারণে আমল ছেড়ে দিলে নফল আমল হলে হয়ত সে নির্জনে সালাত আদায় করবে, আর তা মুস্তাহাবও বটে, কিন্তু ফরয সালাত হলে অথবা ফরয যাকাত হলে বা উক্ত ব্যক্তি এমন বিজ্ঞ আলেম হলে যাকে মানুষ অনুসরণ করে, এরূপ অবস্থায় প্রকাশ্যে ইবাদত করাই উত্তম। (শরহে আরবা‘উন)
যদি কেও আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য ইখলাসের সাথে কোন কর্ম সম্পাদন করে, অতঃপর উক্ত কাজের জন্য অর্থ সম্পদগ্রহণ করে।
যেমন কোন মুজাহিদকে গণিমতের সম্পদ হতে বা নির্ধারিত বেতন-ভাতা প্রদান করা হয় বা আল্লাহর পথে আহŸানকারী (দ্বাঈ) কিছু অর্থ-কড়ি ভাতা হিসাবেগ্রহণ করে, যা তার ধর্মীয় দাওয়াতের জন্য সহায়ক। এরকম বেতন-ভাতাগ্রহণ কোন ক্ষতি করে না। কেননা একব্যক্তি তার কর্ম দ্বারা দ্বীনের খিদমত করছে, আর তার ভাতা যাগ্রহণ করছে তা তার দ্বীনী কর্মে সহায়ক।
ইবাদতের সাথে অন্য কোন উদ্দেশ্য মিলিতকরণ : যেমন কেউ জিহাদ করে আল্লাহর আনুগত্য ও গণিমতের সম্পদ অর্জনের উদ্দেশ্যে। অথবা হজ্ব করার সাথে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য একত্রিত করে, বা সিয়াম পালন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও স্বাস্থ্য রক্ষার উদ্দেশ্যে। এসকল উদ্দেশ্যের মধ্যে কোন সৃষ্ট জীব বা বস্তুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয় না, বরং ইবাদতের সাথে কিছু কল্যাণকর বিষয়কে একত্রিত করা হয়েছে। এসকল উদ্দেশ্য একত্রিত করার ফলে কখনও সওয়াব কম হতে পারে। আর যদি ইবাদত এসব বিষয় মুক্ত হয় তখন সওয়াব আরও অধিক হবে।
কোন ব্যক্তি যদি এমন কিছু করে যা দেখে লোকজন অনুসরণ করতে পারে, তবে ঐ কাজটি রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে না। বরং তা এক ধরণের দাওয়াতের অন্তর্ভুক্ত।
মুসলিম শরীফের উল্লেখিত হাদীসের নীতির আলোকে বুঝা যায় যে, কোনো ব্যক্তির কোন আমল প্রকাশ পেলে ঐ আমল যদি অন্য কোনো ব্যক্তি শুরু করে তবে তা যতদিন চলমান থাকবে ততদিন আমলকারী ব্যক্তি এ আমলের প্রতিদান বা সাওয়াব পেতে থাকবে।
আখিরাতে প্রতিদানের আশা করা : কিছু লোক ইবাদত বন্দেগীতে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের ব্যাপারে এতই বাড়াবাড়ি করেন যে, তারা মনে করেন আল্লাহ সালেহীন বান্দাদেরকে পরকালের যে সব প্রতিদানের ওয়াদা করেছেন সে জন্য ইবাদত করা ইখলাসের পরিপন্থী।
পবিত্র কুরআনে কারীমায় মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, ‘তারা সৎকাজে প্রতিযোগিতা করতো। আর আমাকে আশা ও ভীতি সহকারে ডাকতো। আর তারা ছিল আমার নিকট বিনয়ী’। (সূরা আম্বিয়া; ৯০)
আল্লাহ সূরা আল-মুতাফফিফীনে জান্নাতের নাজ নিয়ামতের বর্ণনা দেয়ার পরে মানুষকে তা অর্জনে প্রতিযোগিতা করতে উৎসাহিত করেছেন, ‘আর প্রতিযোগিতাকারীদের উচিৎ এ বিষয়ে প্রতিযোগিতা করা’। (সূরা আল্-মুতাফফিফীন, ২৬)
তাহলে সাওয়াবের আশা করা যাবে না একথা কিভাবে বলা যায়, অথচ আল্লাহর সমস্ত দীন বান্দাকে জান্নাত কামনা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির দাওয়াত দিয়েছে। সব নবী রাসূল, সিদ্দীক, শহিদ, সকলেই জান্নাত কামনা করেছেন এবং জাহান্নাম থেকে পানাহ চেয়েছেন। অতএব, যারা জান্নাতের আশায় ও জাহান্নামের ভয়ে ইবাদত করে তাকে মন্দ কর্মচারীর সাথে তুলনা করা বা দুর্বল মুরিদ বলা সঠিক নয়। (মাকাসিদুল মুকাল্লিফীন, আশকার)। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে তাঁর নৈকট্য অর্জনে যথাযথভাবে তাঁর হুকুম-আহকাম ও ইবাদত-বন্দেগি করার তাওফিক দান করুন এবং সমস্ত প্রকার রিয়া থেকে হেফাজত করুন। (আমিন)। 
সংকলক : লেখক ও গবেষক।

্রিন্ট

আরও সংবদ

ইসলাম

প্রায় ২১ দিন আগে

ইসলাম

প্রায় ১ মাস আগে