খুলনা | শনিবার | ১২ জুলাই ২০২৫ | ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

বাড়িতে শোকের মাতম, অভিযানে একাধিক টিম, ভ্যান চালক পুলিশ হেফাজতে

নগরীতে প্রকাশ্যে যুবদল নেতা মাহবুবকে গুলি ও পায়ের রগ কেটে হত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক |
০১:৫৬ এ.এম | ১২ জুলাই ২০২৫


‘আমার বাপেরে আমি আর পাবো না, ও আল­াহ একি হলো, তুমি একি করলে?’ এ কথা বলে ঘরের মেঝেতে বসে বারবার বিলাপ করছিলেন দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত যুবদল নেতা মোঃ মাহবুবুর রহমান মোল­ার মা। অন্য ঘরে বসে একমাত্র বোন শান্তাও ভাইয়ের জন্য অঝোরে কাঁদছিল আর বলতে ছিল ‘ওরে আল­াহ একি হলো’? ফুফুর পাশে বসে মাহবুবের ছোট দুই মেয়ে জান্নাত ও মাওয়াও বাবার জন্য অঝোরে কাঁদতে ছিল।
পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবাই সান্ত্বনা দিয়েও মা, বোন আর দুই মেয়ের কান্না কিছুতেই থামাতে পারছিল না। কান্না আর আত্মচিৎকারে পুরো বাড়ির পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছিল।
জানা গেছে, শুক্রবার নগরীর দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়া শাহী জামে মসজিদে এলাকার সবাই যখন জুম্মার নামাজ আদায়ে ব্যস্ত, ঠিক সেই মুহূর্তে মোটরসাইকেল আরোহী তিনজন দুর্বৃত্ত বাড়ির সামনে এসে তাকে গুলি করার পর পায়ের রগ কেটে নির্বিঘেœ পালিয়ে যায়। এ সময় মাহবুব নিজ বাড়ির সামনে ভ্যানচালক সোলেমান (৩০)-কে নিয়ে নিজের প্রাইভেট কার পরিষ্কার করছিলেন। 
অন্যদিকে, দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক নেতা মাহবুবুর রহমানকে হত্যার ক্লু এখনো পরিষ্কার না। তবে দু’টি বিষয়কে তদন্তে জোর দেয়া হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের সময়ে দুর্বৃত্তের একজনের মাথায় হেলমেট থাকলেও বাকী দু’জনের মুখ খোলা ছিল। হত্যাকারীরা মহেশ্বরপাশা পশ্চিম এলাকা দিয়ে ঢুকে ৩০ মিনিটের কিলিং মিশন সম্পন্ন করে আবার তেলিগাতি দিয়ে বের হয়ে যায়। হত্যাকাণ্ডের সময়ে মাহবুবের সাথে গাড়ি পরিষ্কারের জন্য অংশ নেওয়া ভ্যান চালককে পুলিশ হেফাজতে নিয়েছে।
এদিকে সন্ধ্যার পর যুবদলের ওই নেতার ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রাতে এশার নামাজের পর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন হয়েছে।
মাহবুবের মরদেহ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হয়। তার মৃত্যু খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে আসেন বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলসহ স্বজনরা। 
নিহত মাহবুব মোল­ার বাবার নাম করিম মোল­া। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সে ছিল সবার বড়। দুই মেয়ে জান্নাত ও মাওয়া পল­ী তীর্থ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াশুনা করে। ছোট ভাই মিজানুর রহমান মোল­ার ফুলবাড়িগেট স্টেশনারী ব্যবসার সঙ্গে সে সম্পৃক্ত ছিল। তবে সারাক্ষণ সে রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত থাকতো। দৌলতপুর থানা যুবদলের সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৮ ফেব্র“য়ারি কুয়েটের ছাত্রদের উপর হামলার ঘটনায় সে দল থেকে বহিষ্কার হয়।
নিহত মাহাবুবের বোন শান্তা বলেন, ‘আমার ভাই দলের জন্য খুবই নিবেদিত প্রাণ ছিল। দলের জন্য শেখ হাসিনার আমল থেকে অনেক কষ্ট করেছে। দলের দুঃসময়ে সে সব আন্দোলনে গেছে। কেউ সামনে যায়নি, সে সামনে গেছে। মাইর খাইছে, গুলি খাইছে। দলের সুসময়ে এসে এখন এই হলো।’
মাহবুবের স্ত্রী বিলাপ করে বলেন, আমি গুলির শব্দ শুনেছি। আমি চেচিয়েছি। কেউ আসেনি ওকে ধরতে।  মোটরসাইকেলে হেলমেট পরে এসেছিল সন্ত্রাসীরা। কালো চেক চেক জামা পড়া একজন। যাওয়ার সময় গেটে গুলি করেছে। রাস্তায় গুলি করেছে গালি দিয়ে বলে, কে আসবি আয়। কিছুদিন ধরে ওকে মোবাইলে হুমকি দিচ্ছিল। আমি ওকে দূরে যেতে বলেছি অথবা আমাকে কথা বলতে দিতে বলেছি কিন্তু ও বলেছে আমি কারও ক্ষতি করিনি। আমার কেউ ক্ষতি করবে না। আর মরণ থাকলে তো হবে। আমি বলেছি এটা কোন কথা হয় না। সবার সব থাকবে আমার মেয়েদের কি হবে। 
দৌলতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মীর আতাহার আলী বলেন, দুপুরে বাসার সামনে নিজের প্রাইভেট কার পরিষ্কার করছিলেন মাহবুবুর রহমান। এ সময় হেলমেট পরা অবস্থায় তিনজন একটি মোটরসাইকেলে এসে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে পরে মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার জন্য দুর্বৃত্তরা তাঁর দুই পায়ের রগ কেটে দেয়। ঘটনাস্থল থেকে আমরা চারটি গুলির খোসা উদ্ধার করেছি। তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলি লেগেছে।’
হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ওসি আরও বলেন, ‘ঘটনাটি শোনার ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে আমরা ঘটনাস্থলে হাজির হই। আমরা আসার আগে জখমীয় অবস্থায় মাহবুবকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। আমরা ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছি। সাতটি পিস্তলের গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনার সাথে সন্দেহজনক কারা জড়িত থাকতে পারে এ ব্যাপারে একটি টিম কাজ করছে। একটি টিম অভিযানে আছে। একটা মোটরসাইকেলে তিনজন ছিল, একজন হেলমেট পরা। ঘটনাস্থল থেকে তারা তেলিগাতীর দিকে চলে যায় এমনটি শুনতে পারলাম। তাৎক্ষণিক ভাবে আমাদের একটি টিম তেলিগাতি এলাকায় কাজ করতেছে। আশেপাশে কোথাও সিসি ক্যামেরা আছে কিনা আমরা দেখছি। সিসি ক্যামেরা থেকেও আসামি শনাক্তকরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। পাশাপাশি ডিজিটাল পদ্ধতিতে যে সকল কার্যক্রম, সব রকমটা দিয়েই আমরা কাজ করছি। এই মুহূর্তে ঘটনার সঙ্গে কারা কারা জড়িত সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারবো না। সেটা নিয়ে আরেকটা টিম কাজ করতে পারলে আমরা আশানুরূপ রেজাল্ট পাবো, তখন আপনাদেরকে বলতে পারবো। আমাদের তৎপরতা অব্যাহত আছে। অচিরেই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে গ্রেফতার করে একটা রেজাল্ট আপনাদের সামনে জানাতে পারব বলে আশা করি’। 
তিনি বলেন, সন্ত্রাসীরা ওই ভ্যান চালককে লক্ষ্য করে আরও দু’টি গুলি ছোড়ে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। পুলিশ ভ্যান চালককে হেফাজতে নিয়েছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার তাজুল ইসলাম বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে। এলাকার একটি গ্র“পের সাথে তার দ্ব›দ্ব ছিল। মাদক কান্ডে তার সংশ্লিষ্টতার জনশ্র“তি আছে। আমরা সকল বিষয়কে সামনে রেখে তদন্ত করছি।
তিনি আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের সময়ে ৩ জন সন্ত্রাসী ছিল। তাদের সকলের হাতে পিস্তল ছিল। সেখানে মাহাবুবকে লক্ষ্য করে তারা ৭ রাউন্ড গুলি ছুড়েছে। হত্যাকারীরা মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়া দিয়ে মাহাবুবের বাড়ির সামনে গিয়ে গুলি করে ৩০ মিনিটে হত্যাকাণ্ডটি সম্পন্ন করে তেলিগাতি হয়ে হাইওয়ে রাস্তা দিয়ে বের হয়ে সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যায়। আমরা ঘটনাস্থলের পাশে একটি সিসি টিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। আরও একটি সংগ্রহের চেষ্টায় আছি। তবে এ মামলায় সাধারণ মানুষ যেন হয়রানি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হবে। হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে মূল আসামিদের গ্রেফতার না করা পর্যন্ত কোন কিছুই পরিষ্কার করে বলা যাচ্ছে না।
এদিকে মাহবুবের মৃত্যুর খবর শুনে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান খুলনা মহানগর বিএনপি’র সভাপতি শফিকুল আলম মনা।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শফিকুল আলম মনা বলেন, ‘খুলনায় একটি হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হয়নি। আমরা বারবার বলছি, খুলনার আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন হত্যাকাণ্ডসহ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। নগরীর অলিগলি মাদকে ছেয়ে গেছে। কিন্তু প্রশাসন কোনো কর্ণপাত করছে না। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা মাহবুব হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই। হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।’
বিএনপি’র নগর সভাপতি বলেন, বর্তমান পুলিশ কমিশনার একটি বিশেষ মহলের দ্বারা প্রভাবিত। খুলনার মানুষের নিরাপত্তা নেই। গত ১০ মাসে ২৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে পুলিশ কমিশনার নিজেই স্বীকার করেছেন। আর সবশেষ আজ (শুক্রবার) যুবদল নেতা মাহাবুব হত্যাকান্ড ঘটেছে প্রকাশ্যে।
এছাড়া যুবদল নেতা মাহাবুব নিহত হওয়ার খবরে মহানগর বিএনপি নেতা চৌধুরী শফিকুল ইসলাম হোসেন, বদরুল আনাম বদরুল, মহানগর যুবদলের আহবায়ক আব্দুল আজিজ সুমন, সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম রুবেলসহ বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান।
জানা গেছে, গত ১৮ ফেব্র“য়ারি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবিকে ঘিরে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় শতাধিক মানুষ আহত হয়। ওই সংঘর্ষের সময় রামদা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমানের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন মাহবুবকে বহিষ্কার করে যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি। এরপরও তিনি নিয়মিত দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতেন।
এদিকে সন্ধ্যার পর যুবদলের ওই নেতার ময়নাতদন্ত শেষে লাশ মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়ার বাড়িতে প্রেরণ করা হয়। রাতে এশার নামাজের পর তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ও দ্রুত হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে বিকেলে দলীয় নেতা-কর্মীরা খুলনা- যশোর মহাসড়কের দৌলতপুর, রেলিগেট, কুলিবাগান, পালপাড়া মোড়ে টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে এবং দৌলতপুরে বিক্ষোভ মিছিল বের করে।

্রিন্ট

আরও সংবদ