খুলনা | রবিবার | ১৩ জুলাই ২০২৫ | ২৯ আষাঢ় ১৪৩২

অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা নিহতের পিতার : প্রত্যক্ষদর্শী ও সিসিটিভি’র ফুটেজ নিয়ে তদন্ত চলছে, দাবি পুলিশের

প্রকাশ্যে যুবদল নেতা মাহাবুব হত্যায় গ্রেফতার নেই : শঙ্কিত নগরবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক |
০১:২০ এ.এম | ১৩ জুলাই ২০২৫


নগরীর দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক সহ-সভাপতি মাহাবুবুর রহমান মোল­া হত্যাকান্ডের ৩৩ ঘন্টা পার হলে নৃশংস এ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত কাউকে আটক-গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। গতকাল শনিবার বিকেলে নিহতের পিতা আবদুল করিম মোল­া বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা দায়ের করেন। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি ও আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে তদন্ত এবং হত্যাকারীদের গ্রেফতারে অভিযান একই সাথে চলছে বলে জানিয়েছেন খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের একাধিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। অন্যদিকে একর পর এক হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন নগরবাসী।
এদিকে শনিবার বিকেলে নিহত যুবদল নেতা মাহবুব মোল­ার হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত, বিচার ও দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে দৌলতপুরবাসীর আয়োজনে একটি প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
এর আগে গত শুক্রবার দুপুর দেড়টার দিকে নগরীর দৌলতপুর মহেশ্বরপাশা নিজ বাড়ির সামনে ব্যক্তিগত গাড়ি ধোঁয়া-মোছার কাজ করছিলেন মাহাবুব। এ সময় একটি মোটরসাইকেলে আসা তিন ব্যক্তি খুব কাছ থেকে তার মাথা, মুখসহ শরীরের একাধিক স্থানে গুলি করে। মূহর্মূহ গুলির শব্দে ঘটনাস্থল ও এর আশপাশ এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে। গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন যুবদল নেতা। দুর্বৃত্তরা এ সময় তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে দুই পায়ের রগ কেটে নির্বিঘেœ স্থান ত্যাগ করে।
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ ও স্বজনদের দাবি: ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী গাজী সোলায়মান জানান, জুমার নামাজের কিছু সময় আগে একটি মোটরসাইকেলে তিন জন দুর্বৃত্ত এসে মাহবুবকে গুলি করে। তাদের মধ্যে দুই জনের মাথায় হেলমেট ছিল না। তারা তাকে উদ্দেশ্য করে গুলি করলে তিনি পালিয়ে যান। পরবর্তীতে মাহবুবের পরিবারের লোকজন এসে তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।
নিহত মাহবুবের মা রাবেয়া বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বাবা আর নাই। সন্ত্রাসীরা আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে। আমি খুনিদের বিচার চাই, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি চাই।’
নিহত মাহবুবের স্ত্রী এরিন সুলতানা জানান, ‘রাজনৈতিক বিষয়, কুয়েটের বিষয়, এলাকার আধিপত্যসব বিষয় মিলে আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। আমার স্বামী কারো ক্ষতি করেনি। আক্রোশ ও ভুল বোঝাবুঝির কারণে আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। আশপাশের লোক এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে আমার স্বামীর পায়ের রগ কেটে দেয় দুর্বৃত্তরা। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমার স্বামী পড়ে থাকলেও তাকে উদ্ধারে আশপাশের কাউকে ডেকে পাননি বলে অভিযোগ করেন।’
নিহতের শ্বশুর আজাদ বেগ বাবু জানান, ৫ আগস্টের পরে আওয়ামী লীগপন্থীদের বিরুদ্ধে মামলার একটি চাপ ছিল। মানিকতলায় দলীয় একটি প্রোগ্রামে হট্টগোল হলে সেখানে ছাত্রদলের সাবেক এক নেতা মামলা করেন। ওই মামলায় ১নং ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগপন্থী কিছু দলীয় কাউন্সিলরসহ খানাবাড়ী এলাকার দু’এক জন আসামি ছিল। ওই মামলাকে কেন্দ্র করে মাহাবুবকে প্রায়ই ফোনে হুমকি দেওয়া হতো। কুয়েটে ছাত্রদলের লিফলেট বিতরণকে ঘিরে শিবিরের সাথে সংঘর্ষ হয়। এসব ঘটনাকে ঘিরে তার উপর অনেকের রাগ-ক্ষোভ ছিল। ওই সব কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।
মহানগর যুবদলের আহŸায়ক আব্দুল আজিজ সুমন বলেন, ‘মাহবুবের হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে খুলনা শহরে আমরা বাসা ও বাসার বাইরে কেউ নিরাপদে নেই। দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রশাসনকে এমন একটি লোমহর্ষক ঘটনার সঠিক তদন্ত করে হত্যার মূল রহস্য উদ্ঘাটন করতে না পারলে, প্রশাসনের প্রতি সাধারণ মানুষ আস্থা হারাবে।’
দৌলতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মীর আতাহার আলী বলেন, নিহতের পিতা বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। মামলার এজাহারে হত্যার কোনো কারণ উলে­খ করা হয়নি। এ ঘটনায় হেফাজতে নেয়া ভ্যান চালক মোঃ সোলাইমানকে জিজ্ঞাসাবাদের পরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) তাজুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক তথ্য বলছে, এ হত্যাকাণ্ডে একটি মোটরসাইকেলযোগে তিনজন সন্ত্রাসী আসে। তাদের সকলের কাছে পিস্তল ছিল। মাহাবুবকে লক্ষ্য করে তারা ৭ রাউন্ড গুলি ছুড়েছে। হত্যাকারীরা মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়া দিয়ে মাহাবুবের বাড়ির সামনে গিয়ে গুলি করে ৩০ মিনিটে হত্যাকান্ড সম্পন্ন করে তেলিগাতি হয়ে হাইওয়ে রাস্তা দিয়ে বের হয়ে সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যায়। আমরা ঘটনাস্থলের পাশে একটি সিসি টিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। সেগুলো দেখা হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য নেয়া হয়েছে।
তবে এ রিপোর্ট লেখার সময় শনিবার রাত ১০টা পর্যন্ত হত্যাকান্ডের ৩৩ ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
কেএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার আবু রায়হান মোহাম্মদ সালেহ্ বলেন, কয়েকটি বিষয়কে সামনে রেখে তদন্ত ও হত্যাকারীদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। এছাড়া একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। রাজনীতিক এবং রাজনীতির বাইরে সবদিক বিবেচনা করেই কাজ করছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হত্যাকান্ডের ধরণটি ভিন্ন। সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখছি।
কেএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার মোঃ রাশিদুল ইসলাম বলেন, অত্যন্ত নৃশংস এ হত্যাকান্ডটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সংস্থা কাজ করছি। শিগগরিই অগ্রগতি আশা করছি।
এদিকে, শুক্রবার রাতে নিহত মাহাবুর রহমানের মরদেহ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়। তবে শনিবারও বিএনপি নেতা-কর্মী-সমর্থক ও স্থানীয়দের ভীড় ছিল তার বাড়িতে। অন্যদিকে, যুবদল নেতার হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে দৌলতপুরবাসীর ব্যানারে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল করেছেন স্থানীয়রা। রবিবার বিকেলে নগরীর কেডি ঘোষ রোডস্থ দলীয় কার্যালয়ের সামনে মহানগর যুবদলের উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে দলটি। কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবির পক্ষ-বিপক্ষে সংঘর্ষের ঘটনায় দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দৌলতপুর থানা যুবদলের সহ-সভাপতি মাহাবুবুর রহমানকে বহিস্কার করা হয়। তবে বিগত ১৭ বছর আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি দলের সক্রিয় ছিলেন। দলীয় অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটনায় দৌলতপুর থানায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত একটি মামলার বাদীও তিনি। 
গত ১৮ ফেব্র“য়ারি কুয়েটে ছাত্রশিবির, ছাত্রদল ও বহিরাগতদের মধ্যে যে সংঘর্ষ হয়, সেখানে মাহবুব একটি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এক পক্ষ নিয়েছিলেন। তার দেশীয় অস্ত্র নিয়ে অবস্থানের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এরপর দিনই দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়, তারপরও মাহবুব দলে সক্রিয় ছিলেন এবং তাকে বিভিন্ন দলীয় সভা-সমাবেশে দেখা গেছে।

্রিন্ট

আরও সংবদ